শ্রীলঙ্কার মন্ত্রিসভায় মুসলমান নেই
- মো: বজলুর রশীদ
- ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:৪৬
শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট অনুঢ়া কুমারা দিশানায়েক ১৮ নভেম্বর ২৫ সদস্যের যে মন্ত্রিসভা ঘোষণা করেছেন তাতে মুসলমানদের প্রতিনিধি নেই। এটি ভবিষ্যতে সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে। লঙ্কান গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণধর্মী এক প্রতিবেদনে এমন শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। পত্রিকা বলেছে, এটিকে ‘শ্রীলঙ্কার সমাজের সংহতির জন্য সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি পরিণতির সাথে পদ্ধতিগত বৈষম্যের প্রকাশ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুধু নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে উসকে দিতে পারে না, তবে তারা এমন পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারে, যেখানে আগ্রহী দলগুলো, ভুল উদ্দেশ্য নিয়ে, সরকারের একটি বিভ্রান্তিকর ভাবমর্যাদা চিত্রিত করতে এবং দেশের অভ্যন্তরে বিভাজন বাড়াতে উসকানিমূলকভাবে ব্যবহার করতে পারে।’ অতীতেও কোভিডের সময় মুসলমানদের লাশ দাফন করার পরিবর্তে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশনার পদক্ষেপের কারণে লঙ্কা সরকারকে খেসারত দিতে হয়েছে।
২০২৪ সালের হিসাব অনুসারে লঙ্কার জনসংখ্যা দুই কোটি ৩১ লাখ ৫৩ হাজার। এর মধ্যে মুসলিম ৯.৮ শতাংশ এবং খ্রিষ্টান ৭.৩ শতাংশ। মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। ২০২২ সালে অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় জনরোষ ও বিক্ষোভে গোতাবায়া রাজাপাকসে ক্ষমতাচ্যুত হন। ২০২৪ সালে নির্বাচনে বামপন্থী অনুঢ়া কুমারা দিশানায়েক প্রেসিডেন্ট হন। মন্ত্রিসভার কাজ শুরুর প্রাক্কালে লঙ্কার সমালোচকরা বলছেন, যে প্রদীপ আলো দেয়, সে যেন নিজেকে নিভিয়ে না ফেলে। শ্রীলঙ্কার বহুত্ববাদী আদর্শের প্রতি এই বর্জন চ্যালেঞ্জ হতে পারে। লঙ্কান সমাজকাঠামোতে মুসলমানদের অবদান অনেক বেশি। বিভিন্ন সময়ে সেটি প্রমাণিত।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ও মুসলিম দেশগুলোর সাথে ক‚টনৈতিক টানাপড়েন কী হতে পারে তা বড় বিষয়। লঙ্কার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বিশ্বরাজনীতিতে সবার নজর কেড়েছে। ইস্টার সানডের হামলা, একের পর এক দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারগুলো দেশকে দেউলিয়া জাতিতে পরিণত করা এবং অবশেষে সুস্পষ্ট বর্ণবাদের মাধ্যমে গোতাবায়ার ক্ষমতায় আরোহণ এবং তার অনানুষ্ঠানিক ক্ষমতাচ্যুতি। মাহিন্দ্র শাসন এবং তারপর গোতাবায়া শাসন বিশ্বকে পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছে যে, কিভাবে এই দ্বীপে সামাজিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিকভাবে বর্ণবাদ ও বৈষম্য, মহামারী হয়ে উঠেছে।
এনপিপি, ন্যাশনাল পিপল’স পাওয়ার, সৌভাগ্যক্রমে শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বরাজনীতির মানচিত্রে ফিরিয়ে এনেছে। এটি বর্ণবাদের সব রূপ এবং বিষয় জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য জনগণের ধর্মীয় ভাবাবেগের অপব্যবহার করতে অস্বীকার করেছে। নিপীড়িত ও বৈষম্যের শিকার মানুষের জন্য এনপিপি আশা ও পরিত্রাণের এক ঝলক। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে তামিল ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ই অপ্রতিরোধ্যভাবে এনপিপির পাশে দাঁড়িয়েছিল। শুধু তাই নয়, যেসব দেশে দুর্নীতি ও বৈষম্যমূলক শাসনের রাজনীতি তাদের পরাধীন ও নিপীড়িত করেছে, সেখানে বসবাসরত লাখ লাখ মানুষের জন্য এনপিপি আশার আলো হয়ে উঠেছিল। বলতে গেলে, এনপিপি অজান্তেই বিশ্বরাজনীতিতে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।
কমপক্ষে একজন মন্ত্রী নিয়োগ না করা মুসলিম সম্প্রদায়কে অপমানজনক পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়ার মতো। বিষয়টি নতুন করে বৈষম্য ও প্রান্তিকতার দিকে যাওয়া বলে অনেকে দেখতে পারে। মন্ত্রিসভায় মুসলিম প্রতিনিধিত্ব বাদ দেয়ার অর্থ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মুসলমানদের সাথে বৈষম্য সৃষ্টি করা। দেশটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, বৈদেশিক বিনিয়োগ, বৈদেশিক রেমিট্যান্স এবং আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সাথে অন্যান্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রয়োজন। এই সম্ভাবনাগুলো নেতিবাচক হওয়া উচিত নয়। তা ছাড়া বিশ্বায়নের যুগে শ্রীলঙ্কা বিচ্ছিন্নভাবে বাঁচতে পারে না। ভবিষ্যতে কোনো-না-কোনো সময় আন্তর্জাতিক উদ্বেগের বিষয়ে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে বন্ধুত্বপূর্ণ আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন ও সহযোগিতার প্রয়োজন অবশ্যই সামনে আসবে। এই ক‚টনৈতিক সহযোগিতার সাথে কোনো মূল্যেই আপস করা যাবে না। এনপিপি সরকার অন্তর্ভুক্তি এবং সংখ্যালঘু অধিকারের নীতি সমর্থন না করে যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সরকারের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
মন্ত্রিসভায় মুসলমান প্রতিনিধিত্ব না থাকায় আরো বেশ কিছু উপসর্গ তৈরি হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করবে। সমান নাগরিক হিসেবে মুসলমানদের সম্মান ও সততা ক্ষুণ্ন হবে। তারা নিজের দেশেই বিচ্ছিন্নতা বোধে আক্রান্ত হবে। এতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দেবে। মন্ত্রিসভায় প্রতিনিধিত্ব না থাকলে মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্বেগ, চাহিদা, অভিযোগ এবং আকাক্সক্ষাগুলো কিভাবে নীতিনির্ধারণের টেবিলে উপস্থাপন হবে? ফলে সামাজিক সংহতির ক্যানভাসটি ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়বে।
২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার গির্জা, হোটেলসহ কয়েকটি স্থানে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৩৫৯ জনের প্রাণহানি হয়, আহত হয় ৫০০ শতাধিক। তামিল টাইগারের সাথে দীর্ঘ দিন যুদ্ধের পর শান্ত দেশটিতে এটিই সবচেয়ে বড় ঘটনা। বিদেশী নাগরিক নিহত হয়েছে ৪০ জন, আহত ৩০ জন। এই ঘটনায় ন্যাশনাল তৌহিদ জামাতের কথা মিডিয়ায় বারবার টেনে আনা হয়েছে। ফলে কোনো প্রমাণ ছাড়াই মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করা হয়, দোকান ও ঘরবাড়ি লুট করা হয় এমনকি মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। মাহিন্দ্র রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেয়ার পর তিনি এই হামলাকারী নেতাদের মুক্তি দেন। মাইতি রানিল সরকার মুসলমান ইস্যু এড়িয়ে চলে। তিনি পশ্চিমা ধাঁচে বিশ্বাসী। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আরএসএস ও বিবিএস-এর উত্থান। আরএসএস এক হিন্দু উগ্র সংগঠন ও অন্যটি বৌদ্ধ উগ্রবাদী সংগঠন। দক্ষিণের সিংহলি বৌদ্ধরা মনে করে শ্রীলঙ্কা শুধু বৌদ্ধদের দেশ। এখানে খ্রিষ্টান ও মুসলমানরা বহিরাগত, এ দেশে তারা থাকবে কেন?
শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে মুসলিম-খ্রিষ্টান দাঙ্গার কোনো উল্লেখযোগ্য বিবরণী নেই। কিন্তু অহিংস বৌদ্ধরা বারবার খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের ওপর সহিংস আক্রমণ চালিয়েছে। সংসারত্যাগী ভিক্ষুরা জীবনভর বিনাপয়সায় খেয়েদেয়ে সহিংসতা করছে, রাজনীতিতে জড়িয়েছে, দা-ছুরি দিয়ে মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের পাইকারি হত্যা করেছে, মাদকের ব্যবসা করছে, গেরুয়া পোশাকের আড়ালে অনেকে অস্ত্র ব্যবসা করছে।
মগদের ‘মা বা থা’র মতো বুদু বালা সেনা শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে অবস্থিত সিংহলি বৌদ্ধদের সংগঠন। সঙ্ঘের নেতারা ইসলামী ধর্মান্তকরণ ও টেররিজমের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক র্যালি শুরু করে। সিংহলি চরমপন্থী ভিক্ষুরা সরকারের কাছে মধ্যপ্রাচ্যে লঙ্কান নারীদের কাজ করার অনুমতি না দেয়া, মধ্যপ্রাচ্যের সহায়তায় কোনো মসজিদ নির্মাণ না করা, কাউকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে না দেয়া, বোরকা নিষিদ্ধ করা, সিলোন জামিয়াতুল উলামার হালাল সনদ প্রদান পদ্ধতি বাদ দেয়া ইত্যাদি ১০টি দাবি জানায়। তাদের মতে শ্রীলঙ্কা শুধু সিংহলি বৌদ্ধদের। র্যালির সময় তারা মুসলমানদের একটি বড় ফ্যাশন হাউজে আক্রমণ চালায়। বার্মার মা বা থার অশ্বিন ওয়ারিথু মাঝে মধ্যেই শ্রীলঙ্কায় এসে বুদু বালা সেনাকে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোর বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলে। বুদু বালা সেনার আচরণে সেখানকার রাজনীতিবিদ, মানবাধিকার দল, অন্যান্য বৌদ্ধ ভিক্ষু ও মুসলমানরা সমালোচনা করে আসছেন। এভাবে তিন দশক ধরে শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা নৃতাত্তি¡ক সহিংসতার ‘বলি’ হয়েছে। শ্রীলঙ্কার সংবিধানের আর্টিকেল ২৯ (২) ধারা ও উপধারায় ‘মাইনরিটি রাইট ও ‘ধর্মীয় নিরাপত্তার’ কথার উল্লেখ রয়েছে। এখন উগ্র বৌদ্ধদের ‘মহানায়ক’রা সংবিধান সংশোধন করে সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়গুলো বাদ দিতে চান। মুসলিম সম্প্রদায় এখনো আলাউথগামা, দিগানা এবং ইস্টার সানডের হামলার ক্ষত নিয়ে দিন কাটাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে, অনুঢ়া কুমারা দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন গত ২৩ সেপ্টেম্বর। দিশানায়েকের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে যখন তিনি জেভিপির ছাত্র শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িত হন, বিশেষত ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে অশান্ত সময়ে। বছরের পর বছর ধরে, তিনি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় সংগঠক এবং জেভিপি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে উঠে এসেছেন। ২০০০ সালে, দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার সংসদে প্রবেশ করেন এবং পরে দুই বছর কৃষি, পশুসম্পদ, ভূমি ও সেচমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে তিনি জেভিপির নেতা হন এবং শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক অভিজাত এবং অর্থনৈতিক নীতির একজন সোচ্চার সমালোচক হন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার নির্বাচন শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বলা যেতে পারে, যা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক আদেশাবলি সম্পর্কে জনসাধারণের হতাশার প্রতিফলন ঘটাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
দিশানায়েকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মুসলিমবিরোধী কার্যকলাপে তার জড়িত থাকার রেকর্ড নেই। তিনি শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যের ওপর জোর দেন এবং পুনর্মিলন ও অন্তর্ভুক্তি প্রচারে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। তবে বৌদ্ধদের আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি কখনো দাঁড়াননি। সরকারকে সহিংসতা ও শ্রেণিবিদ্বেষ দূর করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
শ্রীলঙ্কার সহিংস সঙ্ঘাত বন্ধে, দাঙ্গা ও বিদ্বেষ দূর করতে ইসলামফোবিয়ার প্রকৃত রূপ সিংহলিদের বোঝাতে হবে, দাঙ্গায় পুলিশ ও গোয়েন্দা অফিসার যারা গোপন আঁতাত করেছে তাদের দায়মুক্তি দেয়া যাবে না। এ জন্য সব রাজনৈতিক দল ও নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে সার্বজনীন ঘোষণাপত্র গ্রহণ করতে হবে। শীর্ষ ধর্মীয় সম্মেলনের আয়োজন করে, বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের মমর্বাণী আলোচনা করে ‘হিংসা’ ও ঘৃণার বিষয়গুলো উন্মোচিত করে তা দূর করার নীতি নির্ধারণ করা দরকার। এসব কাজে রিকনসিলিয়েশন সেক্রেটারিয়েট গঠন করা যেতে পারে। সবাইকে এক দেশ স্লোগানের আওতায় আনার আগে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে একই মঞ্চে টেনে আনার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সংখ্যলঘুদের সিভিল সার্ভিস, পুলিশ ও নিরাপত্তা ফোর্সে নিয়ে আসার পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারকে অবশ্যই জাতির ঐক্য ও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য সব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা