০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

আবরার ফাহাদ র‌্যাগিংয়ের কারণে খুন!

আবরার ফাহাদ - ছবি : সংগৃহীত

দুর্নাম বা অপবাদ যে হিসেবেই দেখি না কেন, বাংলাদেশের জনসমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে, ভ‚তপূর্ব পূর্ববাংলা, আজকের বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতি খুব দুর্বল। এখানকার মানুষ সহজে ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে সাধারণ তো বটেই উপরন্তু তীব্র ঝড় ও আলোড়ন তোলা বা স্মরণে রাখার মতো ঘটনাও অতি দ্রুত ভুলে যান। সেই সুযোগে সুযোগসন্ধানী-মতলবি কলমবাজরা অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে আলোচিত ঘটনাগুলোর অভিমুখ ভিন্ন দিকে লেখার চেষ্টা করেন। যেমন- দোষী জেনেও মক্কেলকে নির্দোষ প্রমাণে পেশাদারত্বের কথা বলে অনেক আইনজীবী আইনের মারপ্যাঁচে আসামি খালাসে মরিয়া থাকেন; ঠিক তেমনি খণ্ডিত ও অর্ধসত্য কাহিনী বর্ণনা করে প্রকৃত ঘটনাপ্রবাহ আড়াল করতে সচেষ্ট হন অনেকে।

আবরার ফাহাদের মৃত্যুর কারণ সেই তীরে বিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। এটি পতিত স্বৈরাচারী হাসিনার পুলিশের বয়ানের প্রতিধ্বনি। হালফিল খবর হলো, আবরার ফাহাদ নাকি র‌্যাগিংয়ের কারণে মরা গেছেন।
ভাবছেন, আমরা কথার কথা বলছি। কথাটি সর্বৈব ভুল। মাত্র পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অভিমুখ বদলানোর সাধ্য কারো নেই। একটি জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকীয় পড়ে আবরার হত্যার বয়ান পাল্টে নতুন ন্যারেটিভ তৈরির চেষ্টা চলছে বলে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান রয়েছে। সম্পাদকীয়টি থেকে আংশিক উদ্ধৃত করছি, ‘র‌্যাগিং নিছক আনন্দ বা পরিহাস নয়। এটি মূলত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের এমন এক ঘৃণ্য রূপ, যা ভুক্তভোগীদের আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্ব বিকাশকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে। বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ কিংবা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিংয়ের নামে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। কখনো তা শারীরিক নিপীড়ন, কখনো মানসিকভাবে হয়রানি কিংবা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং কিছু ক্ষেত্রে এর মাশুল দিতে হয়েছে জীবন দিয়ে। বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড এই বাস্তবতারই করুণ চিত্র’; (২৮ নভেম্বর, ২০২৪, পৃষ্ঠা ৮, প্রথম আলো)।

অন্য দিকে দেখুন তখন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের পরিবেশিত খবরটিতে কী বলা হয়েছে। রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছিল, ‘ভারতের সাথে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের পানিচুক্তির সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়’।

উপরিউল্লিখিত সম্পাদকীয়র বক্তব্য পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনীর প্রতিধ্বনি ছাড়া অন্য কিছু কি? আবরার হত্যার ঘটনাটি তদন্ত শেষে হাসিনা জমানার দলান্ধ পুলিশ কর্মকর্তা তখনকার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘আবরার ফাহাদকে শিবির হিসেবে সন্দেহ করার বিষয়টি হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল, কিন্তু সেটিই একমাত্র কারণ নয়। অভিযুক্তদের সমীহ করে সালাম না দেয়ার বিষয়টিও আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্যতম কারণ। তারা র‌্যাগিংয়ের নামে আতঙ্ক তৈরি করেছে।’ (বিবিসি বাংলা, ৭ অক্টোবর, ২০২৪)।

এখানে আমাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, ছাত্রলীগের ভাবমর্যাদা রক্ষায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে র‌্যাগিংকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন- ’২৪-এর বিপ্লবের আইকন আবু সাঈদ হত্যা মামলার এজাহারে এমন সুকর্ম! (পড়তে হবে কুকর্ম) করা হয়। পুলিশ যে সরাসরি গুলি করে আবু সাঈদকে হত্যা করেছে, তা পুলিশের দায়ের করা প্রথম এজাহারে বেমালুম গুম করা হয়েছিল ।

এখন দেখা যাক, র‌্যাগিং বলতে আমরা কী বুঝি। ইংরেজি র‌্যাগিং শব্দের অর্থ পরিচিত হওয়া, তিরস্কার করা অথবা আবেগে কিছু করা ইত্যাদি। আরো ভালোভাবে বললে, র‌্যাগিং শব্দের প্রচলিত অর্থ হচ্ছে ‘পরিচয় পর্ব’ অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষার্থীদের সাথে পুরনো শিক্ষার্থীদের একটি সখ্য গড়ে তুলতে যে পরিচিতি প্রথা তা-ই র‌্যাগিং বলে অভিহিত। ইদানীং আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের অগ্রজরা সিনিয়রের সাথে শিষ্টাচার শেখানোর নামে অনুজদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করে বিকৃত আনন্দ পায়। এটি বিকৃত মানসিকতা। এটা এখন র‌্যাগিং কালচার নামে সর্বমহলে পরিচিত। বিকৃত র‌্যাগিং কালচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। এটি রাজনীতি বা আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত নয়।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মীর রাতভর নির্মম নির্যাতনে নিহত হন আবরার ফাহাদ। আবরারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ওই ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছিলেন তাতে তারা বলেছিলেন; সেদিন কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়ি থেকে বুয়েটে এসে শেরেবাংলা হলে নিজের ১০১১ কক্ষে এসেছিলেন আবরার। ফেসবুকে ভারতবিরোধী একটি পোস্টের জেরে রাত ৮টার দিকে তাকে ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। পরে রাত ৩টার দিকে জানা যায়, আবরারকে হত্যা করে একতলা ও দোতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি ফেলে রাখা হয়েছে। আবরারকে ‘শিবির আখ্যা’ দিয়ে দুই দফায় দু’টি কক্ষে নিয়ে মারধর করা হয়।

বাস্তবে ফ্যাসিস্ট হাসিনা জমানায় যে কয়েকটি ঘটনায় ছাত্রলীগ (বর্তমানে সন্ত্রাসের দায়ে নিষিদ্ধ) তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিল; বুয়েটের ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি। আবরার ফাহাদ হত্যা ঘিরে পাঁচ বছর আগে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বুয়েট। এর জেরে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সোচ্চার হয়ে ওঠে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। ফলে বাধ্য হয়ে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হয়েছিল তখন শাসকদলকে। এই মর্মান্তিক ঘটনা তখন শিরোনাম হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। আবরার দেশবাসীর কাছে হয়ে ওঠেন ‘ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী’ আন্দোলনের একটি প্রতীক। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনও ‘ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধিতাকারী’ হিসেবে আবরার ফাহাদকে উল্লেখ করেন। যেমন ২০২৪-এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শহীদ আবু সাঈদ। লক্ষণীয়, এবারের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ফ্যাসিবাদবিরোধী যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতেও আন্দোলনকারীদের মিছিল, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার ও স্লোগানে আবরার ফাহাদের নাম উঠে এসেছে বারবার।

আমাদের স্মৃতি দুর্বল হলেও দেশবাসী জ্ঞাত আছেন, আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনা কোনো র‌্যাগিং নয়, রাজনৈতিক কারণে বিশেষ করে ফেসবুকে ভারতবিরোধী পোস্ট দেয়ায় ছাত্রলীগের রোষানলে পড়ে হত্যার শিকার হন তিনি। হত্যার শিকার হওয়ার দু’দিন আগে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন আবরার ফাহাদ, যার বিষয়বস্ত ছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। আবরার হত্যার পর বুয়েটের শিক্ষার্থীদের অনেকে দাবি করেন, মূলত এ পোস্টের কারণে আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এই বাস্তবতা সবাই কবুল করে নিয়েছেন।

পোস্টে আবরার ফাহাদ লিখেছিলেন, ‘১. ৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ছয় মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিচ্ছিল। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে। ২. কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চায় না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দেবো। ৩. কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তরভারত কয়লা-পাথর রফতানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দেবো। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব। ...’।

আবরার ফাহাদ হত্যার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেছেন, ‘আবরার হত্যাকাণ্ড একটি মাইলফলক ঘটনা, যে ঘটনার কারণে ক্ষমতাসীনদের প্রতি তীব্র ক্ষোভের পাশাপাশি ছাত্ররাজনীতির প্রতি চরম বিতৃষ্ণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। তখন ছাত্ররাজনীতি বন্ধের যে দাবি উঠেছিল তাতে পুরো জাতির সমর্থন প্রকাশ পাচ্ছিল। এ থেকেই ঘটনাটির গুরুত্বের গভীরতা আঁচ করা যায়। ভারত বিরোধিতার বিষয়টি আছে; কিন্তু তার চেয়ে বড় বিষয় হলো এটি সন্ত্রাসনির্ভর ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।’ (বিবিসি বাংলা, ৭ অক্টোবর, ২০২৪)।

পরিশেষে আমরা বলতে চাই, উল্লিখিত সম্পাদকীয়তে যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে আববার ফাহাদের হত্যার কারণ শুধুই র‌্যাগিং। এটি কোনো মামুলি প্রতিবেদন নয়, রীতিমতো সম্পাদকীয় স্তম্ভের সুচিন্তিত মতামত। আর সবার জানা, পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতি এখানে প্রতিফলিত হয়। তাই আমরা এই মতকে পত্রিকাটির নিজস্ব মতামত হিসেবে ধরে নেবো। এতদিন জানা ছিল, সংবাদমাধ্যমে কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা দুর্নীতির অবগুণ্ঠন উন্মোচনে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে জনমানসে পত্রপত্রিকাটির গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়ে যায়। পাঠবেকর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এখন দেখছি অনুসন্ধানী সম্পাদকীয় লেখার অভিনব কসরত চলছে! অবশ্য, ভাবুকরা একে সাহিত্যের ভাষায় বলতে পারেন নিরীক্ষাধর্মী সম্পাদকীয়।


আরো সংবাদ



premium cement
চোরতন্ত্রে পরিণত হয় দেশ বাংলাদেশে সুইডেনের বিনিয়োগ বৃদ্ধির আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা বিএনপি ক্ষমতা পেলে ফ্যামিলি ও ফার্মার্স কার্ড দেয়া হবে পশ্চিমতীরকে যুক্ত করে নিতে ইসরাইলের খসড়া পরিকল্পনা তৈরি দেশ স্থিতিশীল রাখতে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই : ডা: শফিক তাঁবেদার রেজিম উৎখাতে ভারতের নীতিনির্ধারকরা এখন বেসামাল বাংলাদেশী সংখ্যালঘুদের দলে দলে ভারত পালানোর তথ্য সঠিক নয় ৫ আগস্টের পর ভারতের সাথে সম্পর্কে সমস্যা চলছে : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাতে মোদির কাছে আবদার মমতার মুক্তিযুদ্ধ চূড়ান্ত অধ্যায়ে রূপ নেয়

সকল