‘সবার প্রতি বন্ধুত্ব কারো প্রতি শত্রুতা নয়’
- ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
- ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:৩৭, আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০:৪১
মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি হওয়া উচিত সহমর্মিতার, সৌহার্দ্যরে ও বন্ধুত্বের। সব মানুষ ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সমান এবং সবার মর্যাদার মাপকাঠিও সমতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। কোনো মানুষই কারো পরম বন্ধু কিংবা চরম শত্রু হতে পারে না। স্বাভাবিক সম্পর্ক হওয়া উচিত সবার মধ্যে। পরম বন্ধু অনেকসময় বিশ্বাসঘাতকতায় ও ভুলবোঝাবুঝির পরিপ্রেক্ষিতে চরম শত্রু বনে যেতে পারে। আবার চরম শত্রু অবস্থা ও পাত্রভেদে কালের প্রেক্ষাপটে বন্ধুতে পরিণত হতে পারে। তাই কাউকে চরম শত্রু ঠাউরে দূরে ঠেলে দেয়া সমীচীন নয়। প্রত্যেক মানুষের উচিত হবে তার সম্পর্কের সীমানা মেনে চলা।
পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে নিজের আত্মমর্যাদার বিষয়টি ভেবে ও মেনে চলা উচিত। অন্যের প্রতি অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে ততদূর যাওয়া উচিত যেখান থেকে সসম্মানে ফিরে আসা সম্ভব হয়; আবার নিজের স্বকীয়তার সীমার মধ্যে অন্যের প্রবেশে ততটা সায় দেয়া উচিত হবে প্রয়োজনবোধে তাকে ফিরিয়ে দিতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়। আমি অন্যের চোখে যাতে ভালোভাবে প্রতিভাত হই সে দিকে লক্ষ রাখতে হয়। আমার এমন কিছু করা উচিত হবে না যাতে কেউ আমাকে শোধরানোর জন্য বলতে সঙ্কোচবোধ করবে- সে কারণে আমারই এমনভাবে চলাচল করা উচিত যেন অন্য কেউ তাতে বিব্রতবোধ না করে এবং নিজেকেও যাতে বিব্রত হতে না হয়।
দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে কূটনীতিকরা তাই এ বাক্য যথার্থই আউড়ান, ‘Friendship to all and malice to none.’ সব রাষ্ট্রই তার জনগণের সার্বিক কল্যাণে অন্যের রাষ্ট্রের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। এখানে পারস্পরিক সম্মান, সৌহার্দ্য, সমঝোতা, সমীহা ও সম্ভ্রমবোধ প্রকাশের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। সবার প্রতি ধনাত্মক (positive) দৃষ্টিভঙ্গি বন্ধুত্ববোধ ও বিশ্বাস এই চেতনাকে জাগ্রত এবং সক্রিয় রাখে। পক্ষান্তরে কারো প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ বা প্রকাশের দ্বারা সমঝোতা ও সহানুভূতি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে ফাটল ধরাতে পারে।
পরিবার, সমাজ, দেশ ও বিশ্বসংসারে বসবাসকারী মানুষের সাথে সহাবস্থান করে পরস্পর সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সবার সাথে সমঝোতা ও সুসম্পর্ক রাখা প্রয়োজন। মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনে ‘কল্যাণ’ আছে উল্লেখ করে আল কুরআনে এ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে যে- ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আকাক্সক্ষায় কেউ তা করলে তাকে অবশ্যই আমি মহাপুরস্কার দেবো।’ (সূরা নিসা, আয়াত-১১৪) মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে নবী করিম সা: বলেছেন, ‘কেউ এ নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে কিয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধপক্ষ অবলম্বন করব।’
যারা দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাষ্ট্র পরিচালনায় তারা তাদের শপথবাক্যে এটিও উচ্চারণ করেন যে, কারো প্রতি রাগ-অনুরাগ কিংবা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো কিছু তারা করবেন না। এরূপ শপথবাক্য পাঠের উদ্দেশ্য হলো- সবার প্রতি তারা সমান আচরণ করবেন। তাদের কাছে শত্রুও যা মিত্রও তা। এটিই হওয়া উচিত সবার প্রতি সবার আচার-আচরণ, মনোভাব-দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি। সহাবস্থান ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য সবার সচেষ্ট থাকা উচিত। সমাজে একে-অপরের পরিপূরক বিবেচনায় এনে রাসূল সা: সবাইকে একটি দেহের মতো দেখতে বলেছেন। দেহের কোনো অঙ্গ যদি পীড়িত হয়ে পড়ে তাহলে অপর অংশও নিদ্রাহীনতাসহ তার ডাকে সাড়া দিয়ে থাকে।
মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমতা ও সমঝোতা, বন্ধুত্ব ও সৌজন্য প্রকাশের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, সমতাবোধ মানুষকে পরস্পরকে কাছে আনে, বিভেদকে তাড়ায়, হিংসা বিদ্বেষ ঈর্ষা ও হীনম্মন্যতাবোধ দূরে রাখে। সমঝোতা পারস্পরিক মনোমালিন্য পরিষ্কার করে, শত্রুভাবাপন্ন হতে বাধা দেয়, নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বন্ধুত্ব সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রস্তুতিকে উৎসাহিত করে, আর সৌজন্য প্রকাশ মনের উদারতা বিশালতাকে বিকাশমান করে তোলে মনের কালো ঘুচায় তাতে। কবির ভাষায়- ‘‘পরের কারণে মরণেও সুখ/‘সুখ’, ‘সুখ’ করি কেঁদো না আর/যতই কাঁদিবে, যতই ভাবিবে/ততই বাড়িবে হৃদয়ভার।’’
অন্যের প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করা পারস্পরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি বলেই ইসলামে একে ‘আখলাকে হাসানা’ বা শ্রেষ্ঠ স্বভাব বা চরিত্র বলা হয়েছে। দলিল প্রমাণ ব্যতিরেকে কারো প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা বিধেয় নয়। সাধারণ অবস্থায় অন্যের প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করা অপরিহার্য। সবার প্রতি ভালো ধারণা পোষণের ব্যাপারে সব ধর্মগ্রন্থেই তাগিদ রয়েছে। আর রাসূলুল্লাহ সা: ‘ভালো ধারণা পোষণ’ এবং ‘কু-ধারণা পোষণ’ থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘কু-ধারণা জঘন্যতম মিথ্যা’।
আলোকিত মানুষের মনে এমন এক উজ্জ্বলতা বিস্তার লাভ করে যেখানে মানবিক উদারতা ও ঔদার্য বিকাশ লাভ করে। আলোকিত মনের মানুষ নিজের জন্য তো বটেই অন্যের জন্য পরম আশীর্বাদস্বরূপ, কেননা, তার উজ্জ্বল মনের আলোয় অন্যেরাও হয় আলোকিত।
বর্তমানের প্রতি মনোযোগী হওয়া আবশ্যক। বর্তমান হচ্ছে অতীতের আলোকে এই মুহূর্তের অবস্থান, যা ভবিষ্যতের ভিত্তি নির্মাণ করে। বর্তমান মুহূর্তের মধ্যে অতীত হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতের পথ নির্মাণ করে। বর্তমানের ভালো-মন্দ অতীতের বিচার্য বিষয় হয়ে যায় এবং ভবিষ্যৎ কেমন হবে তার একটি দিকনির্দেশনা নির্ধারিত হয়ে যায়। বর্তমানকে বাদ দিয়ে তাই অতীত হয় না এবং ভবিষ্যৎ ভাবা যায় না। বর্তমান আছে বলে অতীত অর্থবহ হয় আর ভবিষ্যতের আগমন ঘটে।
আমি যদি বর্তমানের প্রতি মনোযোগী না হই তাহলে বর্তমানের কর্মকাণ্ড বা ফলাফল ভবিষ্যতের ইতিহাসে অতীতের ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হবে। আর আমার বর্তমানের অমনোযোগিতার খেসারত ভবিষ্যতে দিতে হবে। ধরা যাক তুমি একজন ছাত্র। তোমার বর্তমানের অন্যতম কাজ হলো ভালো করে পড়াশুনা করা-বিদ্যার্জন করা। তুমি যদি ভালো করে পড়াশুনা করো নিশ্চয়ই পরীক্ষায় তোমার ফলাফল ভালো হবে। এটি তোমার অতীতের রেকর্ড হিসেবে চিহ্নিত হবে। তোমার এই জ্ঞানার্জন এবং ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে তুমি প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে উন্নত অবস্থানে যেতে পারবে। আর এখন যদি তুমি বর্তমানের প্রতি মনোযোগী না হও-পড়ালেখা না করো তাহলে ভবিষ্যতে তুমি ব্যর্থ ছাত্র হিসেবে পরিচিত হবে এবং তোমার ভবিষ্যৎ যে হবে দুঃখময়, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অনেকে বর্তমানের প্রতি বেখেয়াল হয়ে শুধু অতীতের আদর্শ ও ভালো ভালো উদাহরণ এনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এটি নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। ভালো অতীতের শিক্ষা বর্তমানের প্রতি মনোযোগী হওয়ার ক্ষেত্রে প্রেরণা জোগাতে পারে; কিন্তু বর্তমানের প্রতি অমনোযোগিতা কিংবা বর্তমানের ব্যর্থতাকে উদ্ধার করতে পারে না। শুধু ভালো অতীত, ভালো বর্তমান ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে না; পরিশ্রম করে বর্তমানকে ভালো ও কার্যকর করতে পারার মধ্যেই অতীতের শিক্ষার সার্থকতা। আর বর্তমানের সফলতাই একদিন ভবিষ্যতে অতীতের অনুসরণীয় বিষয় হয়ে যাবে। কেউ তার আদর্শবান কিংবা বিখ্যাত পিতার একমাত্র পরিচয়ে বড় হতে পারে না যদি না সে নিজে বড় হওয়ার চেষ্টা করে। আজ নিজে বড় হওয়ার চেষ্টা করলে দু’দিন পরে সে নিজেও তো অতীতের আদর্শ বা অনুসরণীয় হিসেবে বিবেচিত হবে। সে কারণে সবারই বর্তমানের প্রতি মনোনিবেশ করা উচিত। টলস্টয় তাই যথার্থই বলেছেন, ‘The most important time is Now.’
এই মুহূর্তে আমি যা করছি তার প্রতি আমাকে যত্নবান হতে হবে। আমি এই লেখাটি লিখছি। এর প্রতি আমাকে অধিক মনোযোগী হতে হবে। এ সময় Backup হিসেবে আমার অতীতের শিক্ষা লেখার উপায়-উপকরণ নিয়ে মাথায় আসবে, এই লেখা সম্পর্কে আমার ভবিষ্যতের ভাবনা বা পরিকল্পনাও মাথায় আসবে, এটি স্বাভাবিক; কিন্তু অতীত কিংবা ভবিষ্যতের ভাবনায় আমি যদি বেশি ঝুঁকে পড়ি তাহলে এই মুহূর্তে আমি যা লিখছি তাতে অমনোযোগিতাসুলভ অপূর্ণতা থেকে যাবে, এ লেখা হয়তো সর্বাঙ্গ সুন্দর হবে না। আর এই মুহূর্তে আমার যা করণীয় তার প্রতি আমি যদি দায়িত্বশীল ও আন্তরিক না হই তাহলে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী লেখাটি হবে না। লেখা ভালো না হলে একসময় লেখার জন্য ব্যয় করা আমার এ সময়টা অপচয় বলে ধরা হবে এবং লেখক হিসেবে আমার ভবিষ্যৎ অনুজ্জ্বল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সুতরাং আমার উচিত হবে কিভাবে এই মুহূর্তের এই কাজটি, অবশ্যই অতীতের শিক্ষার ও অভিজ্ঞতার আলোকে সুন্দর সুচারুরূপে সম্পাদন করতে পারি তার চেষ্টা করা। সুন্দর পরিবেশ ও পরিস্থিতির সৃষ্টিতে প্রত্যেকের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন। আর তা বর্তমানের প্রতি মনোযোগী হওয়ার মাধ্যমেই।
ধরা যাক, একজন এ মুহূর্তে নামাজ আদায় করছে। তার উচিত হবে নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে তার পালনীয়-করণীয় বিষয়ের প্রতি যত্নবান হওয়া। তাহলে তার নামাজ আদায় সর্বাঙ্গ সুন্দরভাবে সম্পন্ন হবে। নামাজ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সাথে মোলাকাত। সুন্দর ও পবিত্র পোশাকে, স্বচ্ছ সকৃতজ্ঞ মন নিয়ে একাগ্রচিত্তে এই ইবাদতে মশগুল হতে হবে। আর সে যদি নামাজের প্রতি অমনোযোগী হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে ভ‚ত-ভবিষ্যৎ ভাব-কল্পনা স্মৃতিচারণে মশগুল থাকে তাহলে তার নামাজ আদায় পরিপূর্ণ হবে না। নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।
বর্তমানকে ব্যবহার করতে হবে সচেতনভাবে, সযত্নে, তাহলে তাই-ই হবে সফল অতীতের বিষয় আর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সোপান। কৃষক চাষাবাদে মনোযোগী না হলে ভালো ফসল পাওয়ার স্বপ্ন তার ব্যর্থ হতে বাধ্য। অতীতের গৌরবে দীপ্ত জাতি বর্তমানের প্রতি যদি হয় অমনোযোগী এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যে উদাসীন তাহলে সে জাতির ভবিষ্যৎ অবশ্যই অন্ধকার। গৌরবময় ইতিহাস তাকে সোনালি দিনের স্বপ্নে নিয়ে যেতে পারবে না যদি সে বর্তমানে কর্মবিমুখ, অলস ও দায়িত্ব কর্তব্য পালনে হয় উদাসীন।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা