০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

- প্রতীকী ছবি

উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর প্রায় বারো শ’ বছরের পরিক্রমায় এ দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্প্রদায়গত তেমন কোনো বিভেদ সঙ্ঘাত দেখা যায়নি। এর আগে সেন রাজত্বের সময় যা দেখা গিয়েছিল তাদের অত্যাচারে বৌদ্ধ প্রাধান্যের বাংলা বৌদ্ধশূন্য হয়ে পড়েছিল। তাদের বিহার ও জনপদগুলো জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বৌদ্ধরা সমূল ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিল পাহাড়ি অরণ্যে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনে এ দেশের বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসীদের মেলবন্ধনে প্রথম ফাটল শুরু হয়। এর আগে মুসলিম শাসনামলে শাসকদের দরবারে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতিভার ছিল সমান কদর। বিভিন্ন মুসলিম শাসকদের মন্ত্রী সেনাপতিদের তালিকা দেখলে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্রাট হুমায়ুন তার রাখি বোন চিতোরের রাণী কর্ণাবতীর রাজ্য রক্ষার সাহায্যে ছুটে যাওয়ায় হারান দিল্লির সিংহাসন, যা ফিরে পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় পনের বছর। এ ঘটনা এ দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক ঐতিহাসিক মহাকাব্য। এরপরের ইতিহাস আরও গৌরবের, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যাওয়ার আলোকে ভাস্বর। সম্রাট আকবর, শাহজাহান থেকে শুরু করে বাংলার নবাব আলীবর্দী খার রাজ্য শাসনেও দেখা যায় বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসের এবং মেধার মহাসম্মিলন। নবাব সিরাজউদ্দৌলার দরবারে রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, মোহনলাল, জগতশেঠদের প্রভাব প্রতিপত্তির কথা একদিকে যেমন ইতিহাসের স্বর্ণালী অধ্যায়, তেমনি অপর দিকে শঠতা, ষড়যন্ত্র এবং নিমকহারামি ও বিশ্বাসঘাতকতার জীবন্ত দলিল। অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সোনালি অধ্যায় রচনা করেছিল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুকৌশলে সামাজিক সংস্কৃতির এই ধারায় বিভাজন সৃষ্টি করে এ দেশে তাদের ক্ষমুা সুদৃঢ় করে। শুধু তাই নয় অফিস আদালতের সরকারি ভাষা ফার্সিকে পরিবর্তনের মাধ্যমে এই বিভাজনকে আরো গভীর করে তোলে। পরবর্তিতে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা এবং এর গঠন পাঠন পদ্ধতি রচনা ও শিক্ষার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিভাজন এবং আগ্রাসন উপমহাদেশের মুসলিম সমাজকে আরো বেপথ করে তোলে। একই সাথে রাজনৈতিকভাবে প্রশাসন এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সর্বস্তরে মুসলমানদেরকে কোণঠাসা করে ফেলায় তাদের ওপর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের ষোলকলা পূর্ণ হয়। লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার মাধ্যমে মুসলমান ভূস্বামীরা রাতারাতি অর্থনৈতিক দুর্দশায় পতিত হওয়ার পাশাপাশি হিন্দু ধনিক শ্রেণীর অভ্যুদয় ঘটে। ব্রিটিশদের অনুসৃত এই বিভাজন নীতির ফলে হাজার বছর ধরে চলে আসা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবর্তে সৃষ্টি হয় দুই স¤প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা বিদ্বেষ আর অবিশ্বাস। রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সর্বত্রই এদেশের মুসলিম সম্প্রদায় অনুগৃহীত সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। শুরু হয় মুসলিম সাহিত্য সংস্কৃতির আঙিনায় বিজাতীয় অনুপ্রবেশ। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা এবং আনন্দমঠ ও পরবর্তীতে বিমল মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের পাঠকপ্রিয় লেখনীর বদৌলতে মুসলিম সমাজ হয়ে পড়ে সাহিত্য সংস্কৃতি বিবর্জিত পশ্চাৎপদ শ্রেণী। এই দুর্বলতার সুযোগে মুসলিম সাহিত্য সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আবহ।

ক্রমেই আমাদের সাহিত্যে মুসলিম চেতনা বিশ্বাস ও আদর্শের পরিপন্থী শব্দমালার ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে। এ ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুসলিম শব্দের ম্লেচ্ছ রূপান্তরিত হয় এ সময়। সভাপতি পরিবর্তিত হয়ে পৌরহিত্য শব্দে রূপান্তরিত হয়। লাশ হয়ে যায় মরদেহ। কবরস্থ হয়ে যায় সমাধিস্থ। মৃতের জন্য দোয়া অনুষ্ঠান হয়ে যায় পারলৌকিক অনুষ্ঠান। দাওয়াত হয়ে যায় নেমন্তন্ন। আকিকার পরিবর্তে নামকরণ অনুষ্ঠান, খতনার পরিবর্তে মুসলমানী। ওয়ালিমা এখন বৌ-বাত। বিয়ের অনুষ্ঠান এখন বিজাতীয় সংস্কৃতির আদলে চার পাঁচ দিন ধরে চলতে থাকে। এসব অনুষ্ঠানের আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠানগুলো একদিকে যেমন অত্যন্ত ব্যয়বহুল অন্যদিকে তেমনি মুসলিম চেতনার সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। ‘অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই’ শিক্ষার কথা ভুলে বসে আছি। এখন শিশুদের নামাজ শেখানো, কুরআন পড়ার পরিবর্তে প্রায়ই দেখা যায় গানের তালিম দিতে, নাচের স্কুলে ভর্তি হতে। আমাদের ঘরে ঘরে এখন উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির বিষবাষ্প। পরিণতিতে সালামের পরিবর্তে শুভ সকালের প্রচলন। জানাজার পরিবর্তে প্রদীপ জ্বালিয়ে ‘আগুনের পরশমণি জ্বালাও প্রাণে’ গানের ছন্দে মৃত ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা জানানো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৃত ব্যক্তির লাশ উন্মুক্ত স্থানে রেখে শ্রদ্ধা জানানোর প্রক্রিয়া নিশ্চয়ই মুসলিম সমাজ চেতনার সাথে মিল খায় না। মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়ার পরিবর্তে এক মিনিট নীরবতা পালন এখন রাষ্ট্রীয় আচার। বেতার টেলিভিশনে এন্তার শব্দমালা অজান্তেই আমাদের বিপথগামী করেছে।

জুলাই বিপ্লবের চেতনায় আমাদের আদর্শিক ঐতিহ্যের পরিপন্থী টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বন্ধ করা অথবা সীমিত করা উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি; বরং আমাদের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীকে প্রকাশ্য গলায় উত্তরীয় জড়িয়ে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ বলতে বলতে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন করতে দেখা গেছে। এভাবেই আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা ব্রিটিশ ভারত থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতার চেতনা বিপথগামী করার সার্বিক চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সতর্ক না হলে আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং জাতিসত্তার চেতনা, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহ্য এক সময় হারিয়ে যাবে নিঃসন্দেহে।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
বিএনপি দেশ ও দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে : তারেক রহমান গাজীপুরে আরো এক মামলায় খালাস পেলেন তারেক রহমান সিলেট সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা হিন্দু মঞ্চের! সিদ্ধিরগঞ্জে লাশ নিয়ে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক পার্বত্য চুক্তির পুনমূল্যায়ন ও সন্তু লারমার পদত্যাগ দাবি চিন্ময়ের ঘটনায় আইনজীবী হত্যা : ৯ জন শ্যোন এরেস্ট, ৮ জনের রিমান্ড কৃষিবিদ গ্রুপ রিয়েল অ্যাস্টেট একক আবাসন মেলার উদ্বোধন বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতকে ব্যান্ডউইথ নেয়ার অনুমতি দেয়নি বিটিআরসি চট্টগ্রাম বিভাগীয় ২৯তম হুফফাজুল কুরআন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বাংলাদেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ চেয়ে রিট আগরতলার হাইকমিশনে ভাঙচুরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের

সকল