২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মধ্যবিত্তকে ফেরাতে হবে

লেখক সালাহউদ্দিন বাবর - ছবি : নয়া দিগন্ত

বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে প্রতিটি অনুন্নত দেশ নিয়ত লড়াই করছে নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নের। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট দেশে আয়বৈষম্য দূর করে, তাদের মৌলিক পাঁচ চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করার। এটাই উন্নয়নের সঠিক ন্যারেটিভ। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের সদ্য পতিত লীগ সরকার জনগণকে প্রায় ষোল বছর উন্নয়নের হাজারো স্বপ্নই কেবল দেখিয়েছে। অবশ্য সেটা স্বপ্ন ছিল না, বরং ছিল দুঃস্বপ্ন। বিগত অনির্বাচিত লীগ সরকারের উন্নয়নের যে বয়ান ছিল, তাকে বিশ্বব্যাংক আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অলৌকিক উন্নয়ন বলে অভিহিত করেছে। উন্নয়ন বলতে মানুষের কমনসেন্সে বলে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের কার্যক্রম। অতীতে যদি উন্নতিই হতো, তাহলে প্রশ্ন, দেশে ছাত্র-জনতার এত বড় গণ-অভ্যুত্থান কেন হলো?

উন্নয়ন নিয়ে পতিত সরকারের বয়ান ছিল এমন যে, দেশকে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করাই হাসিনা সরকারের সংগ্রাম। শেখ হাসিনা মানুষের হৃদয়ে সোনার বাংলার স্বপ্ন প্রোথিত করে দিয়েছেন। সোনার বাংলা হবে একটি উন্নত ‘স্থিতিশীল’ ‘অসাম্প্রদায়িক’ রাষ্ট্র, যেখানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা সবার জন্য নিশ্চিত হবে। অথচ বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়নের যে ন্যারেটিভ লীগ সরকার তৈরি করেছিল তার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, ধনীকে ধনবান করা, দরিদ্রকে হতদরিদ্র করা। আর মাঝামাঝিতে যাদের অবস্থান, অর্থাৎ মধ্যবিত্তকে নিঃশেষ করে দেয়া। সে কারণটা কিছু পরে সেটা উল্লেখ করি। এখন শুধু এতটুকু বলে রাখা যায়, রাষ্ট্র-সমাজের ভিত্তিটা সব দেশেই সব সময় মধ্যবিত্তের কাঁধে থাকে। সেই মধ্যবিত্ত সমাজ যদি ভ্যানিশ হয়ে যায়, তবে তার পরিণাম কেমন হতে পারে তার নমুনা হতে পারে শৈশবের একটা ইংরেজি ছড়া। মনে পড়ছে, ‘হামটি ডামটি স্যাট অন অ্যা ওয়াল, হামটি ডামটি হ্যাড অ্যা গ্রেট ফল, অল দ্য কিংস হর্সেস অ্যান্ড অল দ্য কিংস মেন, কুডন্ট পুট, হামটি ডামটি টুগেদার এগেন’। মধ্যবিত্ত সমাজ ভেঙে ফেললে তার ক্ষতিটা হবে ভয়ানক এবং সুদূরপ্রসারী, যা আর কখনওই সারিয়ে তোলা যাবে না। সেজন্য সমাজ-রাষ্ট্রকে সুসংহত করতে হলে ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ক্রমহ্রাসমান ধারা শুধু রুখলেই চলবে না, এ শ্রেণীর মানুষের বিকাশের ধারাটা দ্রুততর করতে হবে। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে মধ্যবিত্তের বিকাশের ধারাটা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। সংখ্যা বৃদ্ধি করলে সব কাজ হয়ে যাবে, এমন চিন্তাটাও যথার্থ নয়। তাদের সম্মুখে অতি অবশ্যই একটা আশার আলো জ্বালাতে হবে। তার কারণটা পরিষ্কার হবে, সাম্প্রতিক এক জরিপের ফল থেকে। ঢাকাস্থ ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যুবক-যুবতীদের ৪২ শতাংশের মধ্যে এমন উদ্বেগ রয়েছে যে, সম্মুখে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে বেকারত্বের চরম অভিশাপ। তাদের এমন পরিণতির জন্য তারা দায়ী করছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগে বৈষম্য এবং পারিবারিক জীবন ও কাজের মধ্যে ভারসাম্যহীনতাকে। এই শ্রেণীর ৫৫ শতাংশ তরুণ বিদেশে চলে যেতে আগ্রহী। এ জনপদের সম্পদ হলো তার জনসম্পদ। এই জনসম্পদের বিদেশ চলে যাওয়াটা এমন, যেন ‘আমারই বধূয়া আনবাড়ি যায়, আমারই আঙিনা দিয়া।’ এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, দেশের সেরা সম্পদ এ যুবকরা অবহেলার শিকার হয়ে দেশ ছাড়তে চায়। জরিপ সূত্রে জানা যায়, ৭৭ শতাংশ তরুণ ও ৫৬ শতাংশ তরুণী ইন্টারনেট ব্যবহার করে। অর্থাৎ এরা সবাই জ্ঞান-গরিমায় অগ্রসর। গোটা বিশ্বটাই এখন এককথায় ওদের হাতের মুঠোয়। তরুণেরা এখন যেসব বিষয়ে অগ্রগতি দেখতে চায়, তার এক নম্বরে আছে শিক্ষা। এর অর্থ হচ্ছে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার যে মান ও পাঠ্যক্রম, তা নিয়ে তারা সন্তুষ্ট নয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা মনে করে সরকারের মৌলিক কাজ হবে মানবাধিকারের সুরক্ষা দেয়া। তারা দেখতে চায়, সরকার বৈষম্যহীনভাবে আইন ও নীতি কার্যকর করছে এবং রাষ্ট্র জনস্বার্থভিত্তিক আকাক্সক্ষার বাস্তব রূপায়ন ঘটাচ্ছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ৫ আগস্টের বিপ্লবীদের যে লক্ষ্য তার সাথে জরিপের এ ফাইন্ডিংসগুলোর যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশে যাদের বার্ষিক আয় ৩ লাখ থেকে ১৪ লাখ টাকার মধ্যে, তারাই মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে রয়েছেন। মধ্যবিত্তরা রাষ্ট্র সমাজ বিনির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তারা প্রতিবাদ করতে জানে। তারাই সমাজ পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেয়। চিন্তাচেতনার অগ্রসরতার কারণে নেতৃত্বও মধ্যবিত্তরাই দিয়ে থাকে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া এসব ক্ষেত্রেও যারা নেতৃত্বে থাকে, তাদের প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে উঠে এসেছে। এ শ্রেণী থেকেই আসে বিচারক, শিক্ষক, সাংবাদিক, পেশাজীবী, কূটনীতিকসহ বিজ্ঞানী ও সবধরনের ব্যবস্থাপকরা, রাষ্ট্রের পুনর্গঠন এবং বিন্যাসের সব কিছুর মোকাবেলায় এ মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ভ‚মিকা রাখতে হয়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে শীর্ষপর্যায়ে থেকে প্রায় সব স্তরের নেতৃত্ব ছিল এ শ্রেণীর হাতে। এ বছরের ৫ আগস্টের যে বিপ্লবে তরুণ-তরুণী ছিল অগ্রভাগে, তারা সবাই বলতে গেলে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর সন্তান-সন্ততি। তারাই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। আর এ সম্ভব করার জন্য এদেরই চরম মূল্য দিতে হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে উচ্চবিত্তের সদস্যদের অবদান ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়।

’৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল এ বাক্যের মধ্য দিয়েই, যেটা ছিল ‘উই রিভোল্ট’। বাক্যটিকে উচ্চারণ করেছিলেন, কে শহীদ জিয়াউর রহমান। তিনি কি কোনো ধনীর দুলাল ছিলেন? এখন আয়বৈষম্য বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে। সাধারণ জনগণের কাছে তা এখন বোধগম্য। আর মানুষ যেসব বিষয় থেকে তা অনুভব করতে পারছে, সেগুলো হলো : ১. দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মা-বাবার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে; ২. দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ৩. দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুরোপুরি বাজারীকরণ হয়ে গেছে; ৪. ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কাছে কুক্ষীগত হয়ে যাচ্ছে ও ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; দেশের জায়গা-জমি, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাটের দাম প্রচণ্ডভাবে বেড়েছে; ৬. বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মকভাবে বাড়ছে; ৭. ঢাকা মহানগরীতে জনসংখ্যা দুই কোটি ৩০ লাখে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিবাসী; ৮. দেশে গাড়ি, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি দ্রæত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৯. বিদেশে বাড়িঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ১০. ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ১১. উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবাহ বাড়ছে; ১২. উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘন ঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩. প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রæত বাড়ছে; ১৪. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; ১৫. দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও/এ লেভেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মহোৎসব চলছে; অন্য দিকে দরিদ্র জনগণের সন্তানদের জন্য মানহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে; ১৬. প্রধানত প্রাইভেটকারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত করছে এবং ১৭. দেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি বেড়ে জনজীবনকে পদে পদে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের বেশির ভাগ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এমন সব সূচক দেশকে ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে চলেছে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে ভ‚মিকা ছিল পতিত লীগ সরকারের। এসবই ছিল তাদের আলটিমেট গোল। বাংলাদেশকে বিপন্ন করে তোলা তথা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। এমন হেজিমনি সৃষ্টির কারণ হচ্ছে, এ দেশটা কারো হাতে তুলে দেয়ার পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করা। পতিত সরকারের যত মন্ত্রী, নেতা-নেত্রী, তাদের খয়েরখাদেরও আখের গুছিয়ে দেয়া হয়েছিল। এজন্যই লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। যাতে ওইসব ব্যক্তি অন্য কোথাও বাকি জীবন রাজার হালে কাটাতে পারে, এ দেশ কোন ছার।

পৃথিবীতে দেশ বাঁচাতে যত অভ্যুত্থান বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, সেখানে মধ্যবিত্ত ছিল; আবার প্রতিবিপ্লব ঠেকিয়েছে মধ্যবিত্তের সব তরুণ। বাংলাদেশেও এখন পতিত সরকারের উচ্ছিষ্টভোগীরা নানা ছদ্মবেশে, কখনো বন্ধুবেশে, নানা ছিদ্র পথে অনুপ্রবেশ করে প্রতিবিপ্লবের পথ-নকশা তৈরিতে ব্যস্ত। অবাক হতে হয়, উচ্ছিষ্টভোগীদের চিন্তার দৈন্য দেখে। একান্ত নিজের স্বার্থে বা কয়েকজন ব্যক্তির স্বার্থে এদের বংশধরদের অগ্নিগর্ভে নিক্ষেপের কাজটা করছে নির্দ্বিধায়। যে ভ‚মিতে তাদের চৌদ্দপুরুষ শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকবে। সে ভূমি বেদখলের প্রক্রিয়ার সাথে এরা সবাই জড়িত। আর হবেই না কেন, তারা তো এক মহিলা পীরের মুরিদ। তিনি পরিষ্কার করেই বলেছেন, তিনি এ দেশের মানুষকে শিক্ষা দেবেন, প্রতিশোধ নেবেন। প্রতিশোধ তো ইতোমধ্যে নিয়েই ফেলেছেন। এ ভূখণ্ডের রূপ-রস, গন্ধ-বাস সবই সহায়সম্পদ লুটেপুটে নিয়েছেন। তবে আশার কথা, বদ্বীপের নদীবেষ্টিত মানুষ মচকায় কিন্তু ভাঙে না, কারো কাছে হার মানে না, প্রতিবাদ প্রতিরোধ করে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানুষ নিয়ত নদীভাঙনের শিকার, এটাই ইতিহাস হয়। তবে নদীর এপাড় ভাঙে ওপাড়ে গিয়ে তারা ঘর বাঁধে, পরাজয় মানে না। এখন আর রোদনের সময় নয়, ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। এ অভিযাত্রায় দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর জন্য মধ্যবিত্তকে ফেরাতে হবে, তাদের নেতৃত্বে আসতে হবে।

তবে সবচেয়ে ভয় ও আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, যে পতিতরা এ জনপদকে বিরান ভ‚মিতে পরিণত করার অবিরাম চেষ্টা করেছে- তারা আবার নিজেদের পুনর্বাসনের স্বপ্ন দেখছে। তাদের তৈরি করা নানা বিষ-বৃক্ষের ওপর ভর করে, এ প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে এগিয়ে নিতে চলেছে। প্রথমত, সৃষ্টি করা হচ্ছে বিভেদ বিভাজন, সংশয়, সঙ্ঘাত, আত্মকলহ, ডিভাইড অ্যান্ড রুল এবং হতাশা, চলতি প্রশাসনকে অদক্ষ অপারগ হিসেবে প্রমাণিত করা, তাদের ত্যক্ত বিরক্ত করা, জনগণকে বর্তমান প্রশাসনের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেয়া।

একটা এক ‘মশহুর’ ন্যারেশন আছে যে, কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। অনুরোধ করছি অন্তত একবার হায়দরাবাদের ইতিহাসটা পাঠ করুন। ইনকিলাবকে জিন্দা রাখতে হবে।
ndigantababar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement