১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আশঙ্কা বিতর্ক ও সমাধান

লেখক মাসুম খলিলী - ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও গন্তব্য নিয়ে নানা বিতর্কের মধ্যে নতুন নতুন আশঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে। এ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মতো বৈশ্বিক থিংকট্যাংক থেকে শুরু করে বিবিসি আলজাজিরা ইকোনমিস্টের মতো খ্যাতনামা মিডিয়া বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনের সাফল্য ও পরবর্তী গন্তব্য নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মূল্যায়ন আসছে। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস এ নিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে দীর্ঘ ভাষণ দিয়েছেন, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন আলজাজিরাসহ কিছু দেশী বিদেশী গণমাধ্যমে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ে যে বিতর্ক এবং এ বিষয়ে যে আশঙ্কা তার সমাধানের বিষয়ে একটি ব্যবধান থেকে যাচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দেবার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা কার্যকর রয়েছে। এই পরিকল্পনার পেছনে কারা রয়েছে এবং কারা এতে মদদ দিচ্ছে তা একবারে অস্পষ্ট তা হয়তো নয়। কারণ এটি তো অজানা নয় যে যারা ব্যাংকব্যবস্থা থেকে চার লাখ কোটি টাকা বের করে পাচার করেছে তারা কারা। আর সেই টাকা উদ্ধার এবং এর জন্য দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রচেষ্টাকে তারা কেন সফল হতে দিতে চাইবে?

প্রফেসর ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার এটি জেনে বুঝেই রাষ্ট্রকে সংস্কার করে সামনে অগ্রসর হবার চ্যালেঞ্জ নিয়েছে বলে মনে হয়। এ চ্যালেঞ্জ জয় করা গেলে একটি নতুন যুগের অভিযাত্রার স্বপ্ন সফল হতে পারে। অধিকাংশ বাংলাদেশী শেখ হাসিনার পতনকে ‘দ্বিতীয় মুক্তি’ হিসাবে অনুভব করে, তারা বড় পরিবর্তনের ব্যাপক আকাক্সক্ষার কথা বলে। কিন্তু আকাক্সক্ষা লালন করা যতটা সহজ তা বাস্তবায়ন করা ঠিক ততটাই কঠিন।

স্বপ্ন বাস্তবায়নে দুই চ্যালেঞ্জ
এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে দুই প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন আর দ্বিতীয়টি হলো বিপ্লবের স্টেকহোল্ডার ও অধিকাংশ জনগণের সরকারের পাশে থাকা। দু’টি বিষয়ই সহজ কোনো কিছু নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে শক্তি বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রিত একটি দেশ করে রাখতে চেয়েছিল তারা রাডার থেকে বের হয়ে স্বাধীনভাবে পথ চলার প্রচেষ্টায় চুপ করে বসে থাকবে তা আশা করা যায় না। তারা নিজেদের শক্তি এবং ক‚টনৈতিক ও ইন্টেল নেটওয়ার্ক দিয়ে দ্বিতীয় স্বাধীনতার অভিযাত্রা বন্ধ করতে চাইতেই পারে। সরকার হয়তোবা সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার বিষয়ে বেশ সচেতন ও আস্থাশীল। প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে দেয়া সর্বশেষ ভাষণে সেটিই মনে হয়।

তবে কিছু বাস্তবতা এরপরও উপেক্ষার মতো নয়। আগামী ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রশাসনে পরিবর্তন হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছেন। ট্রাম্পের বাছাই করা নীতিপ্রণেতাদের পটভূমি ও ভাবনা সংযোগগুলোর ব্যাপারেও উদ্বেগ রয়েছে। বিশেষত পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা প্রধান ও গোয়েন্দা প্রধানের বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচনায় আসছে। এ সবের প্রভাবও বিবেচনায় রাখার প্রয়োজন রয়েছে।

দ্বিতীয়টি হলো বিপ্লবের স্টেকহোল্ডার ও সমর্থক সাধারণ জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জনের বিষয়টি। সরকারের বাইরে থাকা স্টেকহোল্ডার হিসাব করা হলে তাতে মোটা দাগে তিনটি শক্তি দেখতে পাই। যার মধ্যে রয়েছে ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী শক্তি-বিএনপি, ইসলামিক শক্তি বিশেষত জামায়াত ও হেফাজত এবং সেক্যুলার ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তি।

জাতীয়তাবাদী শক্তি তথা বিএনপি বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক শক্তি, যাদের আগস্ট বিপ্লবে জনগণ পর্যায়ে ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। তিনবার সরকার গঠন করার কারণে প্রশাসন, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিএনপির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। উদার গণতান্ত্রিক দল হিসাবে পশ্চিমা অংশীদারদের কাছে এটি বেশ গ্রহণযোগ্য।

এরপর আন্দোলনের নেটওয়ার্ক তৈরি এবং সেটিকে সংগঠিত করে সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবার পেছনে বড় রাজনৈতিক ভ‚মিকা ছিল ইসলামিক শক্তির। আগস্ট বিপ্লবে নিহতদের একটি বড় অংশ হলো এই ঘরানার। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে ইসলামপন্থী শক্তি প্রধান ভূমিকা পালন করে। জুলাইয়ের শেষের দিকে যখন বিক্ষোভ বেড়ে যায়, তখন জামায়াতের সদস্যরা হেফাজতে ইসলাম এবং অন্যান্য ইসলামপন্থী কর্মীদের সাথে ছাত্র বিক্ষোভে যোগ দেয়। এই জোটের মধ্যে জামায়াত ভাবমূর্তি কিছুটা পুনরুদ্ধার করেছে। দলটি তার নিবন্ধন পুনরুদ্ধারের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে এবং এটি স্পষ্টতই ইউনূসের সংস্কার এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্তি হবে। আইসিটিতে জামায়াত-সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের নিয়োগ এবং স্কুলের পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনার দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি কমিটি ভেঙে দেওয়াসহ ইসলামপন্থীদের স্থান দেওয়ার জন্য তাকে ইতিমধ্যেই আপস করতে হয়েছে।’

আইসিজির প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ‘হাসিনা শাসনের একটি শিক্ষা হলো যে দেশের রাজনৈতিক ফ্যাব্রিক থেকে ইসলামপন্থী দলগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা ফলপ্রসূ হতে পারে না।’ একজন পর্যবেক্ষকের উল্লেখ করে রিপোটর্টিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ কখনোই ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ হতে যাচ্ছে না। ইসলামিস্টদেরকে প্রান্তের দিকে ঠেলে না দিয়ে তাদের সম্পৃক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।’

আইসিজির মতে, ‘তাদের (ইসলামপন্থী) অত্যন্ত অনুপ্রাণিত সমর্থকরা রাজপথে একটি শক্তিশালী শক্তি, কিন্তু জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলো- যারা একটি বিষয়ে আলোচনায় রয়েছে। তারা একটি সীমিত নির্বাচনী হুমকি সৃষ্টি করে, ব্যালটের ১০ শতাংশের বেশি তারা জয়ী হয়নি। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংগ্রহের ক্ষেত্রে তারা অবশ্য বড় দলগুলোর কাছে একটি অপরিহার্য সমর্থন প্রমাণ করতে পারে।’
ইসলামিস্টদের বিষয়ে আইসিজির এই মূল্যায়নকে অত্যন্ত বস্তুনিষ্ট বলে মনে হয়।

আগস্ট বিপ্লবের তৃতীয় স্টেকহোল্ডার হলো, কর্তৃত্ববাদবিরোধী সেক্যুলার শক্তি, যেটাকে সাধারণভাবে টিআইবি-সিপিডি-প্রথম আলো-স্টার ঘরানা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। জনগণ পর্যায়ে এই শক্তির বিপ্লবে উল্লেখযোগ্য কোনো অংশ সেভাবে ছিল না। তবে বিপ্লব যখন প্রবলভাবে শক্তি অর্জন করে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে তখন সেক্যুলারদের পৃষ্ঠপোষক বৈশ্বিক শক্তি এর পেছনে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনীগুলোর গণহত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখায় সরকারকে সমর্থন যোগাতে অস্বীকৃতির পেছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল এই বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রক শক্তির। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামিস্টদের প্রভাবিত মাঠ কমান্ডারদের অবস্থান নেবার পাশাপাশি এটিও অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক ছিল।

স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে ভারসাম্য
এই তিন শক্তির সুসমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার হলে সে সরকারের শক্তিমত্তা নিঃসন্দেহে প্রবল হতো; কিন্তু ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক শক্তির জাতীয় সরকারে অংশ নিতে অস্বীকৃতিতে সে প্রচেষ্টা সামনে অগ্রসর হয়নি। তবে অন্তর্বর্তী অরাজনৈতিক সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এসব অংশীজনের পরামর্শ নোবেল জয়ী প্রফেসর ইউনূস ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা নিয়েছেন। এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকারে বিপ্লবের স্টেকহোল্ডারদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব না থাকলেও বিপ্লবপন্থীরা সেটিকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে প্রশাসনিক ও অন্যবিধ শাসন বিন্যাসে বিপ্লবের তৃতীয় স্টেকহোল্ডার সেক্যুলারদের প্রভাব প্রবল হয়ে ওঠে। বিএনপি ও ইসলামিস্টদের প্রভাব কমিয়ে রেখে সেক্যুলারদের সামনে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় স্পষ্ট হয়ে ওঠার পর বিপ্লব বেহাত হবার আশঙ্কা পরিবর্তনের প্রথম দুই স্টেক হোল্ডারের মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে।

সেক্যুলারিস্ট পক্ষের ‘নিরপেক্ষদের’ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আনার প্রচেষ্টায় প্রকারান্তরে ফ্যাসিবাদের বেনিফিশিয়ারিরা সামনে চলে আসে। ফলে ফ্যাসিবাদের মুখ্যব্যক্তিরা নানা ধরনের আশ্রয়প্রাপ্তি ও অর্থকড়ি নিয়ে বিদেশের পালানোর সুযোগ পেয়ে যায়। আর বঞ্চনাবোধ থেকে বিপ্লবের প্রধান দুই স্টেকহোল্ডার অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়ে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে।

এর সাথে আরেকটি বাস্তবতা যুক্ত হয়। সেটি হলো ফ্যাসিবাদী শক্তি তাদের লুটপাটের রাজত্বকে এমন এক অবস্থায় রেখে দেশ ছাড়ে যে, পরবর্তী সরকারকে এখন রাষ্ট্র চালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেশের রিজার্ভ প্রায় শূন্য, ব্যাংকগুলো থেকে নগদ অর্থ সরিয়ে অচলাবস্থার মুখে ঠেলে দেয়া হয় প্রাক আগস্টে। প্রতিবেশী দেশের আকস্মিক বাঁধ খুলে দেয়ায় সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি এবং বিদ্যুৎ জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে প্রতিবেশী দেশের ভূমিকা সরকারের জন্য নিত্যপণ্য ও সেবা সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহ অব্যাহত রাখা কঠিন করে তুলে।

এ ধরনের বৈরি পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের অধিকাংশ উপদেষ্টাই যথেষ্ট যোগ্য ও নিবেদিত। তাদের কারো বিষয়ে এখনো পর্যন্ত দুর্নীতি বা নিয়মবহিভর্‚ত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ওঠেনি। এর পরও ফ্যাসিবাদের রেখে যাওয়া পরিস্থিতির কারণে অনেক ক্ষেত্রে অবস্থার অবনতি ঘটেছে। যার প্রভাব পড়ছে সরকারের প্রতি জনসমর্থনে।

এক্ষেত্রে বাস্তবতা বোঝার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) মূল্যায়নটি সামনে আনা দরকার। আইসিজি বলেছে, ‘আন্তর্জাতিক সমর্থনে, অন্তর্বর্তী সরকারকে জনগণকে পাশে রাখতে কিছু দ্রুত অর্জনের দিকে নজর দেয়া উচিত। গণ-অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের তিন মাস পর, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার এজেন্ডা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে এর পথে থাকা সমস্যাগুলোও। নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে, প্রশাসন আরো এক বছর এবং সম্ভবত আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য অফিসে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।’

আইসিজি আরো বলেছে, ‘হাসিনার শাসনের ১৫ বছর পর, বাংলাদেশে শাসনব্যবস্থার উন্নতি করার এবং এমন ব্যবস্থা তৈরির সুযোগ রয়েছে যা আরেকটি স্বৈরাচারী শাসনের উত্থান থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরত রাখবে। আর অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হলে, দেশটি অস্থিতাবস্থায় ফিরে যেতে পারে, এমনকি সামরিক শাসনের মেয়াদে প্রবেশ করতে পারে।’

কী করা উচিত
এ অবস্থায় কী করা উচিত সে সম্পর্কে আইসিজির বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়েছে, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত আরো উচ্চাভিলাষী সংস্কারের জন্য জনসমর্থন বজায় রাখতে দ্রæত ফলাফল তৈরি করা। তাকে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা এড়িয়ে চলতে হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন ব্যবস্থা নিয়ে ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। বহিরাগত অভিনেতাদের এ ক্ষেত্রে সাহায্য দেওয়া উচিত; বাংলাদেশের জনগণের কাছে ভারতের ভাবমূর্তি মেরামতের জন্য কাজ করা উচিত দিল্লির।’

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর শেখ হাসিনার প্রশাসন গভীরভাবে অজনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য, তার সরকার পদ্ধতিগতভাবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে পুলিশ, বিচার বিভাগ এবং আমলাতন্ত্রের স্বাধীনতা খর্ব করেছে। ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিরোধীদের ওপর নিয়মিত দমন-পীড়ন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, চরম সামাজিক বৈষম্য এবং ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি আওয়ামী লীগের সমর্থনকে দুর্বল করে দিয়েছে। দেশব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ এবং মারাত্মক ক্র্যাকডাউনসংবলিত হাসিনার নৃশংস প্রতিক্রিয়া ছাত্র আন্দোলনকে একটি জনপ্রিয় বিদ্রোহে রূপান্তরিত করে যা তাকে দ্রুত দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করে। আর হাসিনার বিদায়ের সাথে যে উচ্ছ¡াস ছিল তা দীর্ঘস্থায়ী হলেও সামনের পথের রূঢ় বাস্তবতা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে খারাপ অবস্থায় থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতি এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা বিক্ষোভ এবং উত্তরণের অনিশ্চয়তার কারণে আরো আঘাত পেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করছে, মূলত এমন একটি পুলিশ বাহিনীর ওপর নির্ভর করে যা ব্যাপকভাবে প্রতিবাদবিরোধী দমন-পীড়নে জড়িত ছিল। এ অবস্থায় জনসমর্থন বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।

আইসিজির মতে, ‘প্রধান রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের সমর্থন বজায় রাখা ইতোমধ্যে চ্যালেঞ্জিং প্রমাণিত হচ্ছে : কেউ কেউ আগাম নির্বাচনের সুবিধার জন্য দাঁড়িয়েছেন, এমনকি ইউনূসের মিত্ররাও সাংবিধানিক সংস্কার এবং হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত নৃশংসতার জন্য জবাবদিহির মতো বিষয়গুলো সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। ইউনূসকে আওয়ামী লীগপন্থী দল ও ব্যক্তিদেরও বাধার মুখে পড়তে হতে পারে।’

ক্রাইসিস গ্রুপের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য হলো, ‘অন্তর্বর্তী সরকার যত বেশি সময় ক্ষমতায় থাকবে, আগাম নির্বাচনের আহ্বান তত বেশি হবে এবং এর বৈধতা নিয়ে বৃহত্তর সন্দেহ বাড়বে। ইউনূসকে অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হবে, যার মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কার যাতে সমাজের দুর্বল অংশগুলোকে আঘাত করার মতো বিষয় থাকতে পারে। আর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উল্লেখযোগ্যভাবে অবনতি হলে সামরিক শাসনের সময়কাল শুরু হতে পারে। ইউনূসের প্রশাসনের জন্য যারা এটিকে দুর্বল করতে চাইছেন তাদের বিরুদ্ধে সর্বোত্তম বীমা হবে ফলাফলের একটি স্থির প্রবাহ প্রদান করা, যাতে এটি জনসমর্থন বজায় রাখতে সক্ষম হবার মতো গভীর সংস্কার শুরু করতে পারে। দ্রæত জয়ের মধ্যে পাবলিক সার্ভিসে ক্ষুদ্র দুর্নীতি মোকাবেলা, বিদ্যুৎ সরবরাহের উন্নতি এবং উচ্চ মূল্য কমানোর পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জোরালো জনসমর্থন অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে, অন্তর্বর্তী সরকারকে রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য মূল দলগুলোর মধ্যে মতৈক্যের জন্য নিরলস হওয়া উচিত। একটি বাস্তবসম্মত সময়সীমার মধ্যে একটি সংস্কারকৃত ভোটদান পদ্ধতির অধীনে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করা উচিত, যা আঠারো মাসের বেশি বাড়ানো উচিত নয়।’

আইসিজির বাংলাদেশবিষয়ক প্রতিবেদনের অনুসিদ্ধান্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, ‘সংস্কার প্রক্রিয়ার যে ঝুঁকি উন্মোচন হতে পারে তা ভয়াবহ। অন্তর্বর্তী সরকারকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে এবং বাংলাদেশের জনগণ যাতে এর পেছনে দৃঢ়ভাবে থাকে তা নিশ্চিত করতে স্থির ফলাফল প্রদান করতে হবে। বিকল্পগুলো বাংলাদেশ এবং এর অংশীদার উভয়ের জন্যই অপ্রিয় হবে। একটি ভবিষ্যৎ সরকারের ওপর চেক এবং ভারসাম্য রাখার জন্য সংস্কার ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠান আরেকটি স্বৈরাচারী শাসনের উত্থান হতে পারে। একটি সামরিক টেকওভার আরো বড় ধাক্কা হবে। আন্তর্জাতিক অভিনেতাদের উচিত অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে তার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলোকে সমর্থন করার জন্য কাজ করা এবং বাংলাদেশের রাজনীতিকে একটি নতুন যুগে নিয়ে যেতে সহায়তা করা।’
সার সংক্ষেপ

এক. অন্তর্বর্তী সরকারকে জনসমর্থন বজায় রাখতে পণ্য ও সেবা পরিস্থিতির উন্নতি নিশ্চিত করতে হবে।

দুই. অন্তর্বর্তী সরকারের এক দিকে ঝুঁকে পড়াকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে সব স্টেকহোল্ডারকে প্রশাসন ও সংস্কার কাজে অংশ বানাতে হবে।

তিন. ডিসেম্বরের মধ্যে প্রধান সংস্কার পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে সেটি বাস্তবায়নের রূপরেখা দিতে হবে।

চার. যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। সেটি হতে পারে প্রথমে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং পরে সংস্কার কাঠামোর মধ্যে জাতীয় নির্বাচন।

পাঁচ. লুটপাট অর্থপাচার ও গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। আগে হওয়া প্রশাসনিক ও বিচারিক অবিচারের উপশমে পদক্ষেপ নিতে হবে।

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement