১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভূমিপুত্র ও দলদাস

লেখক অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম - ছবি : নয়া দিগন্ত

মানুষের অভাব, অভিযোগ, আকাঙ্ক্ষা, অভিলাষ, স্বপ্ন, অধিকার, দায়িত্ববোধ- সবকিছুই নির্ভর করে একটি দেশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ওপর। দেশের বাইরে থেকে এসে কেউ কোনো জাতির স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দিতে পারে না। বর্তমানের জাজ্বল্যমান প্রমাণ সদ্য পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার কিছু মহাপরাক্রমী সদস্য, যারা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করে দিয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ঘনিষ্ঠ ও স্নেহভাজন এমন ২৪ জনের খবর পাওয়া গেছে যারা বিদেশী নাগরিক। বিদেশী নাগরিক হয়েও তারা ছিলেন সরকারের নীতিনির্ধারক। ৫ আগস্টের মুহূর্ত আগে বা পরে তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, কেউ ধরা পড়েছেন এবং জেলে আছেন। এদেরকে নিয়ে দেশপ্রেমিক (?) উন্নয়নমুখী মন্ত্রিসভার উপহার দেশের ফোকলা অর্থনীতি। প্রতিটি দেশের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা এমনভাবে ঢেলে সাজানো হয়, যাতে ভিন্ন পরিচয়ে ভিনদেশী কোনো নাগরিক দেশের পরিচালনা, পরিকল্পনা বা দেশের অতি গোপনীয় তথ্যাদি বেহাত করে দিতে না পারে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৬ নম্বর অনুচ্ছেদ এমন নিশ্চয়তার চাবিকাঠি। বিদ্যমান আইনের বিধানে কোনো ব্যক্তি বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিক থাকাকালে বা অর্জন করলে, নাগরিকত্বের অন্যতম প্রধান শর্ত উদ্দিষ্ট দেশের আনুগত্যের শপথ করলে তিনি বাংলাদেশের সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হতে পারেন না। বিদেশী কোনো নাগরিক যেন ফাঁক গলে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে না পারেন সেটি দেখার বা নিশ্চিত করার সার্বিক দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এর ব্যত্যয় জাতির সাথে প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। স্বার্থপরায়ণ মনোভাবের কারণে একটি সম্ভাবনাময় জাতির ভবিষ্যৎ হারিয়ে যেতে পারে। থমকে যেতে পারে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রা।

এর ওপরে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়। যারা সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী তাদের আদ্যোপান্ত প্রধানমন্ত্রী বরাবরে উপস্থাপন করার কথা। তাদের ব্যর্থতা এবং যিনি প্রধানমন্ত্রীর আসনে আসীন তার অবহেলা বা ব্যর্থতা কোনোভাবেই ক্ষমাযোগ্য নয়। একই সাথে দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশনকে প্রশাসনিক স্বাধীনতা দেয়া জরুরি। কোনো অবস্থাতেই কমিশনকে রাজনীতির অনুগামী হতে দেয়া উচিত নয়। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করা দরকার। শুধু সংসদ নয়, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে ভিনদেশী নাগরিকত্বের শপথ যেন প্রশাসনকে দুর্বল করে দিতে না পারে সে ব্যাপারেও কঠোর আইনি ব্যবস্থার প্রয়োজন।

একজন সংসদ সদস্যের দায়িত্ব আইন প্রণয়ন করা। দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তি পর্যালোচনা করা। আর এ জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সর্বনিম্ন মাপকাঠি প্রয়োজন। নইলে গায়ক-অভিনেতা বা ভাঁড়সর্বস্ব রাজা মানিকচন্দ্রের সংসদ বা মন্ত্রিসভাই হবে জাতির পরিণতি। এটি রোধের জন্য নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন হওয়া, সর্বস্তরে নিজস্ব জনবলের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনার সক্ষমতা থাকা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চেতনার দাবি। ভারতের নির্বাচন কমিশন ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর মতবিরোধের ঘটনা এ ক্ষেত্রে স্মরণীয়। রাজীব গান্ধী কোনো বিশেষ আসনে নির্বাচনী কর্মকর্তা পদায়নের পরামর্শ দিলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। এতে প্রধানমন্ত্রী ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন। রাষ্ট্রপতি রাজীব গান্ধীকে এই বলে নিবৃত্ত করেছিলেন যে, নির্বাচন কমিশনার তার সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রয়োগ করেছে মাত্র। অথচ আমাদের দেশের পরপর তিনটি কমিশন, তিনজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার দলীয় আজ্ঞাবহ ভ‚মিকা পালন করায় জাতির ওপর দুর্ভাগ্যের কালো আঁধার নেমে এসেছে। সংবিধান সংস্কারের সময় এ বিষয়গুলো গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিচার বিভাগ ও আইন সভার ভেতর ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করা। দলীয় এবং সরকারপ্রধান- বারবার একই ব্যক্তির ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর দায়মুক্তির পথ সুগম করে। ফলে তারা দেশের সবাইকেই দলদাসে পরিণত করেন। আবার বিপদ দেখলেই যে দেশের আনুগত্য তিনি করেন সে দেশে পালিয়ে যান। তারা পালিয়ে গেলেও থেমে যান না; বরং বিদেশে বসে ষড়যন্ত্রের ছক তৈরি করেন, কিভাবে সামনে আরো শাসন-শোষণের ফাঁকফোকর বের করা যায়, কিভাবে দেশে অশান্তি সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা যায়, কিভাবে বিদেশী প্রভুদের সহায়তায় আবার ক্ষমতার মসনদে ফিরে আসা যায়। বিদেশী নাগরিক হওয়ার সুবাদে তাদের ভেতর কোনো দেশপ্রেম জাগ্রত হয় না, জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণের ব্যাপারে তাদের কোনো মাথাব্যথা থাকে না। তারা তাদের নিজেদের স্বার্থে ষড়যন্ত্র পাকায়। এদের ফেরার পথকে সাংবিধানিকভাবে চিরতরে বন্ধ করা দরকার। এ জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে, সংস্কারের ব্যাপারে জাতীয় নেতারা বিভাজিত। চলমান ক্রান্তিকালে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে জাতি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি প্রত্যাশা করে।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement