অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতায়ন
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৯:৪৮
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শাসন করছে দেশ। এটি স্বাভাবিক সরকার নয়। একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক উপায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই সরকার। একে বৈপ্লবিক সরকার বলা হবে নাকি গণ-অভ্যুত্থানের সরকার বলা হবে- তা নিয়ে বাহাস করছেন বিদ্বজনরা। যেহেতু এই সরকারটি বর্তমান সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণ করেছে, সুতরাং তাদের সঙ্গত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে এটি তো অস্বীকার করা যাবে না যে, একটি রক্তক্ষয়ী অধ্যায় অতিক্রম করে জন আকাঙ্ক্ষায় এই সরকার ক্ষমতায়িত হয়েছে। এটি একটি মধ্যবর্তী সরকার। অতীত অতিক্রম করে বর্তমানকে আশ্রয় করে ভবিষ্যৎ রচনায় নিমগ্ন এই সরকার। পতিত স্বৈরাচার এবং ভবিষ্যৎ প্রতিনিধিত্বশীল সরকার এর মধ্যে সেতুবন্ধ এই সরকার।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পর্কে সবসময়ই বলা হয়, এর ক্ষমতা হবে সীমিত, মেয়াদকাল সংক্ষিপ্ত এবং নীতিগত সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকবেন তারা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই- প্রথাগত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নয় এটি। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচনকালীন সরকার নয় এটি। সংস্কারের সঙ্কল্পে গঠিত হয় এই সরকার। বিগত ১৫ বছরে যেভাবে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে তার পুনর্গঠন এই সরকারের দায়িত্ব। আওয়ামী লুম্পেন বা লুটপাটকারী সরকার যে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটিয়েছে তার প্রতিকার করতে এই সরকার সঙ্কল্পবদ্ধ। সামাজিকভাবে যে নৈতিক অবক্ষয় পতিত সরকার ঘটিয়েছে তার একটি পুনর্গঠনের দাবি জনগণের পক্ষ থেকে এই সরকারের প্রতি আছে। এই সময়ে যে বিজাতীয় সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তার প্রতিকার চায় জনগণ। সুতরাং অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য গঠিত হলেও এই সরকারের একটি বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।
জনগণের রয়েছে সংস্কার আকাঙ্ক্ষা। আর রাজনৈতিক দলগুলোর রয়েছে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হচ্ছে। এই সরকারের প্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস জনগণের নির্বাচিত সরকারপ্রধান না হলেও জনগণের হৃদয়ের মানুষ। এ জাতির একজন পিতৃপুরুষ হিসেবে জনগণের মঙ্গলের জন্য ব্যাপক সংস্কার সাধন করতে চান তিনি। কিন্তু রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনীতিবিদদের সেই চিরাচরিত পার্থক্য স্পষ্ট। অ ংঃধঃবংসধহ ঃযরহশং ভড়ৎ ঃযব হবীঃ মবহবৎধঃরড়হ. ইঁঃ ঃযব ঢ়ড়ষরঃরপরধহ ঃযরহশং ভড়ৎ ঃযব হবীঃ বষবপঃরড়হ. সেই দ্বিধা-দ্ব›দ্ব ও বিভাজন এখানেও বর্তমান।
একটি জাতিরাষ্ট্র সেই জনগণের স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ ও বিষয় বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিত। ঐতিহাসিকরা এই অঞ্চলের জনচরিত্র সম্পর্কে খুব সুখকর মন্তব্য করে যাননি। মোগল বংশের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দীন মোহাম্মদ বাবর আমাদেরকে অস্থির জাতি বলে অভিহিত করেছেন। অন্যরা আমাদেরকে দ্ব›দ্বমুখর অবিশ্বস্ত ও ঝগড়াটে জাতি বলে চিহ্নিত করেছেন। ইতিহাস প্রমাণ করে, এরা শাসিত হওয়ার উপযুক্ত, শাসক হওয়ার নয়। ব্রিটিশ আমলে আমাদের লোকেরা গোলামির ক্ষেত্রে যে বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিয়েছেন, তা সহজে ভোলার নয়। পাকিস্তান আমলেও তেমন প্রবণতা বহাল ছিল। আর এই বাংলাদেশ আওয়ামী আমলে রীতিমতো জাহেলিয়াত কায়েম হয়েছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই ক্ষমতায়নের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
একটি সরকারের গঠন ও ব্যবস্থাপনায় তাদের অনুসৃত নীতি ও আদর্শ প্রতিভাত ও প্রতিফলিত হবে, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক হলো এই, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারটি কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ ধারণ করে না। পৃথিবীর সব সরকারগুলো রাজনৈতিক দল-আশ্রিত। সংসদীয় ব্যবস্থায় কিংবা রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থায় দলই মুখ্য। কিন্তু বর্তমান সরকার দলনিরপেক্ষ। অবশ্য এ কথার অর্থ এই নয় যে, তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, আদর্শ ও কর্মসূচি থাকবে না। সব সরকার যেমন দলীয় পরিচয় নির্দিষ্ট, এই সরকারের নিরপেক্ষতাই বৈশিষ্ট্য। একটি বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার একটি বিশেষ পরিস্থিতিকে ধারণ করে। সে কারণে তাদেরকে বিপ্লবের গণ-আকাঙ্ক্ষার দিকে বিশেষ নজর রাখতে হয়। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে সরকারটি গঠিত হলো তার বিশেষ তিনটি বৈশিষ্ট্য হলো- নিরপেক্ষতা, গণ-বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করা ও সুশাসন নিশ্চিত করা।
প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে যে সরকারটি গঠিত হলো তাদের এই তিন মাসের কার্যাবলি পর্যালোচনা করলে তিনটি অধ্যায় দেখা যায়। প্রথমত, উপদেষ্টামণ্ডলী গঠন। প্রাথমিকভাবে ৮ আগস্ট যারা শপথ নিলেন তাদের অধিকাংশই প্রবীণ ও অভিজ্ঞ। তাদের অধিকাংশই এ দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদের আবার এনজিও ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে। পরে জানা গেল, তাদের মাত্র চারজন এনজিও থেকে এসেছিলেন। লোকেরা মজা করে বলে- এনজিওগ্রাম সরকার। তবে সরকার গঠনে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করতে পারেননি। তখন তিনি দেশে ছিলেন না। প্যারিসে ছিলেন। সেখান থেকে উড়ে এসে তিনি জুড়ে বসেছেন। তার নিজের ভাষায়- যাওয়ার কথা জেলে কিন্তু তার বদলে তিনি গেলেন বঙ্গভবনে। কারণ গণবিপ্লবের নায়করা তাকে মহানায়ক বানিয়েছে। অস্থির ও দ্ব›দ্বমুখর এই দেশে সবার একমত হওয়ার লক্ষণ খুবই কম। সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম তিনি। রাজনীতিক, সিভিল সোসাইটি ও সাধারণ মানুষ তাকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে মনে করে।
তার অতীত ও বর্তমান কথাবার্তা প্রমাণ করে, এই জাতির জন্য তিনি একটি উত্তম ভবিষ্যৎ রচনা করতে চান। উপদেষ্টামণ্ডলী সততই তার উদ্দেশ্যের অনুবর্তী হবে, এটিই স্বাভাবিক। উপদেষ্টামণ্ডলী সম্পর্কে মৃদু অভিযোগ থাকলেও তাদের সততা ও নিষ্ঠা সম্পর্কে কারো কোনো সন্দেহ নেই। তবে পরবর্তী তিনজন নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হলো তা কাম্য ছিল না। যেটি আগে বললাম তাদের নিরপেক্ষতা, বিপ্লবী চেতনা ও সুশাসন সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। সে বিষয়ে নিশ্চয়ই কোনো ব্যত্যয় বা ব্যতিক্রম ঘটেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই সরকারের রক্ষাকবচ। এই তিন মাসে তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। সুতরাং মৌলিক সিদ্ধান্তে তাদের আস্থায় নেয়া উচিত নয় কি? এই সে দিনের আওয়ামী আস্ফালন সম্পর্কে ভাবুন, জিরো পয়েন্টে শিক্ষার্থীরা না গেলে ছোটখাটো আওয়ামী প্রদর্শনী হয়ে যেত। তবে এ কথার অর্থ এই নয় যে, শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র চালাবে, তারা তা চায়ও না। তারা যখন দেখবে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে, ন্যায়ানুগভাবে এবং গণবিপ্লবের আকাঙ্ক্ষায়- তখন তারা দ্বিমত করবে না।
আমরা তিনটি পর্যায়ে তিন মাসের সরকারকে মূল্যায়ন করব। প্রথমত, উপদেষ্টামণ্ডলীর কার্যক্রম, দ্বিতীয়ত, প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং তৃতীয়ত, শিক্ষাকার্যক্রম। উপদেষ্টামণ্ডলীদের গরিষ্ঠ অংশ একই মতের ও একই পথের। সেখানে বৈচিত্র্যও খুবই কম। অথচ এই জাতির চরিত্র বিশ্লেষণ করে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য নিশ্চিত করা উচিত ছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, নেতৃত্বের জন্য আমাদেরকে এখনো ফার্স্ট জেনারেশনকে বেছে নিতে হচ্ছে। সেকেন্ড জেনারেশন সেভাবে অগ্রবর্তী হয়নি। পরে যে জেনারেশন অর্থাৎ ‘জেন-জি’ নেতৃত্ব দিচ্ছে তাতে জেনারেশন গ্যাপ স্পষ্ট। আমরা ইতোমধ্যে সরকারের প্রশাসনিক পুনর্গঠন লক্ষ করলাম। সচিবালয়ে যে দৃশ্য অবলোকন করতে হয়েছে তা দুর্ভাগ্যজনক।
এবার আসি শিক্ষাঙ্গনে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে নীতিগত অবস্থানের চেয়ে ব্যক্তিগত অবস্থান বেশি নিয়েছে। এখনো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়নি। কিন্তু সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সব পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। বিতর্কিত এক-এগারোর সরকারও একটি নীতিমালার ভিত্তিতে পদায়ন করেছে। এখন কাকে কেন কোন পদে দেয়া হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। যেহেতু এই সরকারটি অন্তর্বর্তীকালীন, স্বল্প সময়ের এবং সংস্কারকার্যক্রম নির্ভর সুতরাং তার দায়িত্ব চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো হবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতায়নের তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত : ১. যে ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে বিগত ১৫ বছরে তার ভ‚মিকা কী ছিল, সে ব্যক্তিগতভাবে বর্তমান সরকারের পালিত নীতিমালা ও আদর্শ ধারণ করে কিনা; ২. ব্যক্তির নিরপেক্ষতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নিশ্চিত কিনা; ৩. ক্ষমতায়নকৃত ব্যক্তির সততা, সামাজিকতা ও ব্যক্তিগত আচরণ গণ-বিপ্লবের সাথে সম্পৃক্ত কিনা।
এই সরকারটি আমাদের সরকার। জনগণের সরকার। বিপ্লবের আশা-আকাঙ্ক্ষায় এটি প্রতিষ্ঠিত। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্টতই বলেছেন, তার কোনো রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নেই। মূলত সংস্কারই প্রত্যাশা। এখনো সংস্কারগুলো সুনির্দিষ্ট হয়নি। সংস্কার কমিশনগুলো এখনো সুনির্দিষ্টভাবে রোডম্যাপ নির্ণয় করেনি। আশা করা হচ্ছে, বর্তমান সীমিত ক্ষমতায়ন দিয়ে তারা ভবিষ্যৎ ক্ষমতায়নের সীমারেখা নির্ধারণ করবেন। ভবিষ্যতে ক্ষমতার জোরে কেউ যেন স্বৈরাচার না হয়ে ওঠেন সেটি নিশ্চিত করাও এই সরকারের দায়িত্ব। সে জন্য বারবারই জনগণের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ণয়ের তাগিদ আছে। প্রবাদ আছে- অনংড়ষঁঃব ঢ়ড়বিৎ পড়ৎৎঁঢ়ঃং ধনংড়ষঁঃবষু. সার্বিক ক্ষমতা সার্বিকভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে। সুতরাং এখনকার জন্য এবং ভবিষ্যতের জন্য ক্ষমতায়নের বিপদ-আপদ সম্পর্কে আমাদের শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে।
গত তিন মাসে যা হয়েছে ভালো-মন্দ মিলিয়ে তা আমাদেরই অর্জন। এখন ভবিষ্যতে গণবিপ্লবের আশা আকাঙ্ক্ষার সাথে মিল রেখে আমাদের ক্ষমতায়ন হতে হবে। সুশাসনের তিনটি বৈশিষ্ট্য- জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে আশা করি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরফ থেকেও দায়বদ্ধতার তাগিদ এসেছে। উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের পর থেকে গণ-অভ্যুত্থানের বিপ্লবী চেতনা ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা। জাতীয় নাগরিক কমিটি মনে করে, জুলাই অভ্যুত্থানে যে ন্যায়বিচার, জবাবদিহি ও অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্বের আহ্বান জানানো হয়েছিল, সরকারের বর্তমান কর্মকাণ্ডে অধিকাংশই তা প্রতিফলিত হচ্ছে না। জুলাই অভ্যুত্থানের কারিগরদের এসব উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতে হয় এই কারণে যে, বিপ্লব বিরোধী অভ্যন্তরীণ স্বৈরাচার শক্তি এবং পার্শ্ববর্তী স¤প্রসারণবাদী শক্তি যৌথ প্রযোজনার মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা নস্যাতে সদা তৎপর রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এসব ষড়যন্ত্র সমূলে উৎপাটনে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে বিপন্ন হবে বাংলাদেশ। অতএব, সাধু সাবধান।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা