২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বৈষম্য, আরো কিছু কথা

লেখক সালাহউদ্দিন বাবর - ছবি : নয়া দিগন্ত

গত দেড় দশকের বেশি সময় থেকে হাজারো সঙ্কট সমস্যা আর দুর্নীতির এক ভূখণ্ডে পরিণত হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। দুর্নীতিবাজদের যেন এক চারণভূমিতে পরিণত হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। বিশ্ব এই দেশকে দুর্নীতির সমার্থক বলে বিবেচনা করত। দুর্নীতির আঁতুড়ঘর হচ্ছে তথাকথিত সেই গণভবন। সেই ভবনের প্রতিটি ইট বালুকণা পর্যন্ত ‘হা’ করে থাকত কিছু প্রাপ্তির প্রত্যাশায়। ঠিক এভাবে গত ১৬টি বছর অন্য কোথাও কোনো প্রবৃদ্ধি না ঘটলেও দুর্নীতির প্রবৃদ্ধি ঘটে জ্যামিতিক হারে। ক্রমাগত গত দেড় দশক এই প্রবৃদ্ধিটা ঘোরাফেরা করেছে শুধু ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান অ্যান্ড উইম্যান’দের মধ্যে বৃত্তাকারে। তবে তার অর্থ এই নয় যে, নিচের দিকে সবাই শুদ্ধাচারের অনুশীলন করেছে বা কৃচ্ছ্রতার পথ ধরে চলেছে। দুর্নীতি নিচেও ছিল, তবে সেই ব্যক্তি সমষ্টির ভাগ্যে জুটেছিল কেবল উচ্ছিষ্ট।

দুর্নীতি এই নেতিবাচক শব্দটির প্রতিশব্দ হচ্ছে নীতি বা সুনীতি। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, দুর্নীতির দূর সুনীতি চর্চাটা শুরু করতে হলে অর্থনীতিকে অবশ্যই সাথে রাখতে হবে। সুষ্ঠু অর্থ ব্যবস্থাপনা সব অপচয় অনিয়মকে রুখতে পারে। সেই সাথে অর্থ বিলি-বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসানও হতে পারে। তবে অর্থনীতিকে ঘিরে রাখতে হবে নীতির বর্ম দিয়ে। শুধু মুখে বা বাক্যবচনে দুর্নীতির অবসান চাইলেই হবে না। চিড়া ভিজাতে যেমন রস বা পানির প্রয়োজন তেমনি নীতি-সুনীতির সুষ্ঠু চর্চা নিশ্চিত না হলে দুর্নীতিকে সরানো কঠিন হবে। গত প্রায় ১৬ বছরে রাজনীতি তথা ক্ষমতার ছত্রছায়াই দুর্নীতি মহীরুহ হয়ে উঠেছিল। আগামীতে যে রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসবে, তারা কতটা নীতির পৃষ্ঠপোষকতা করবে, তার ওপরই ভবিষ্যতে দুর্নীতি-সুনীতির ভাগ্য নির্ভর করবে। সেই ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো কোনো বার্তা দেয়া সম্ভব নয়। সব কিছুই এখনো কুয়াশাচ্ছন্ন। দুর্নীতিকে নামাতে হলে সুনীতির আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা অপরিহার্য।

যা হোক, দুর্নীতি যে গত প্রায় ১৬ বছরে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এতে কারো কোনো দ্বিমত নেই। দেশের একজন সাধারণ মানুষকে পর্যন্ত দুর্নীতি আঘাত করেছে। দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেটদের কারসাজিতে দরিদ্র মানুষকেও দ্বিগুণ-ত্রিগুণ মূল্যে সব পণ্য কিনতে হচ্ছে। কৃচ্ছ্রতার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে দেশের মানুষ। কেবল ফুলেফেঁপে উঠেছিল ওইসব প্রাইম মিনিস্টার্স ম্যান অ্যান্ড উইমেন। যদি ওই সব ম্যান আর উইম্যানদের পরিসংখ্যানটা হচ্ছে মাইক্রোস্কপিক্স মাইনরিটি। অথচ গত ১৬ বছরে এরাই রাষ্ট্রীয় সম্পদের পুরো ননি মাখনটাই খেয়েছে। হার ম্যাজিস্ট্রিজ প্রাইমমিনিস্টারের আনুকূল্য পেয়ে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, যিনি এভাবে অনুকূল্যে দেখিয়েছেন, একেবারে নিঃস্বার্থে তো নয়ই, নিজের পুরো স্বার্থটা যাতে নির্বিঘ্ন থাকে। পার্শ্বচরা যাতে সে ক্ষেত্রে কোনো রা শব্দ না উঠায়। এভাবে সমাজে বৈষম্যের পাহাড় নির্মিত হয়েছে। সেটি নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা ছিল না।

আর এটাও একটি জরুরি তথ্য এই যে, রাষ্ট্রযন্ত্র সেটি তো দৃশ্যমান নয়। তবে রাষ্ট্রের পরিধিতে যে ১৮ কোটি মানুষ বসবাস করে, তারা কেবল দৃশ্যমান নয় দীপ্যমানও বটে। তারাই তো এ রাষ্ট্রের স্বত্বাধিকারী। তাদের প্রাপ্যটা গত ১৬ বছরে লাভেলোকসানে কোথায় জমল। তার হিসাবটা কোথায় কেউ কি জানে? রাষ্ট্র তো কারো জমিদারি নয় যে, হিসাব-পত্র চাইবার প্রজার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু গত ১৬ বছর হ্যার ম্যাজিস্ট্রি বাংলাদেশকে নিজের ‘তালুক’ হিসেবেই ভাবত। তাই হিসাব-পত্র দেয়ার কোনো প্রয়োজন কখনো অনুভব করত না। তার সব অনুগত দাসানুদাসদের সারাক্ষণের একমাত্র জনমত ছিল ‘কুইন ক্যান ডু নো রং’। দিন কখনো সমান যায়, এই বাংলায় লক্ষ্মণ সেন যেমন পেছন দরজা দিয়ে পালিয়েছিল, তার দীর্ঘ ব্যবধানে ‘কুইন’ দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি ঠিক লক্ষ্মণ সেনের মতো পশ্চাৎদ্বার দিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উড়াল দেয়। এটি শুধু এ ভূখণ্ডেই নয়, বিশ্বের অন্যত্রও এমন উদাহরণ বিরল নয়। দুর্নীতির এমন সব রাজা-রানীদের একই সাথে বলতে হবে স্বৈরতন্ত্রের খলনায়ক নায়িকা। খলনায়ক নায়িকাদের কখনো কোনো জনভিত্তি থাকে না। বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা গেছে, প্রতিনায়ক-নায়িকাদের অবশেষে দেশত্যাগ করতেই হয়। এর অন্যতম কারণ তাদের গণবিচ্ছিন্নতা। তাদের জনরোষানলে পরে পালানোই তখন একমাত্র পথ।

দুর্নীতির বয়সটা খুব কম নয়। নীতি-দুর্নীতি পরস্পরবিরোধী হলেও সবসময় সমান্তরালভাবেই চলে থাকে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলামসহ সব ধর্মেই সুনীতির কথা রয়েছে। সুনীতির জন্য পুরস্কারের কথা যেমন আছেন, তেমনি দুর্নীতির জন্য শুধু তিরস্কার নয়, আরো ভীতিকর দুঃসংবাদও আছে। অন্যান্য ধর্মেও দুর্নীতি ও সুনীতির জন্য পুরস্কার, তিরস্কার উভয় বর্ণিত আছে। অথচ মানুষ এতই দুর্বিনীত যে, সুনীতির পুরস্কারকে ওমর খৈয়ামের মতো মনে করে, ‘দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক। নগদ যা পাও হাত পেতে নাও।’ এই বোধকে গত ১৬ বছরে ভীষণভাবে উসকে দেয়া হয়েছিল। যেমন দুর্নীতিটাই এখানে হয়ে উঠেছিল নীতি-নৈতিকতা। আর বৈষম্য বঞ্চনা হয়ে উঠল সুবোধ। সমাজের যাদের বলা হয় ‘ওয়াচ ডগ’, গত ১৬ বছরে ওই ওয়াচ ডগের বীরত্বটাও দেখা গেছে। যেমন একজন ট্রাফিক পুলিশ কোনো বাসের হেলপারের কাছ থেকে ১০০ টাকা গ্রহণ করেছেন। তার ছবিটা ছেপে আমরা বীরত্বের বাহবা যানজা করেছি। কিন্তু বেনজীরের রিসোর্ট কিংবা হারুনের ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’ নিয়ে কখনো কোনো ছবি ছাপা হতে দেখেনি। ছাত্র-জনতা যখন দুঃসহ সেই অতীতকে ওলট-পালট করে দিলো, তখন আমাদের সাহস আর বীরত্ব যেন হাজার গুণ বেড়ে গেল। অতীতে করেছি আপস, আর এখন করছি সন্ধি। কী বিচিত্র এই দেশ, আমরা শক্তের ভক্ত আর নরমের যম। বৈষম্যের সৃষ্টিকারীদের রসে আমরা এতকাল কতটা মজে ছিলাম। সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল ছিল যে, আমরা যা চাই বা ভাবি। এ নিয়ে কারো সাথে ভাগবাঁটোয়ারা করা যাবে না। আমাদের স্বপ্নে থাকবে আমি আর আমার পরিজন নিয়ে সুখে থাকা। আমি চাইব কেবল আমার পরিজনের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ। আমার মতো করে আর কারো স্বপ্ন পূরণ হোন না হোক। সেটা আমাদের কারো বিবেচনায় ছিল না। এমনকি বিগত ১৬ বছর তো রাষ্ট্রযন্ত্রের ছিলই না। এতকাল কেবল বৈষম্যের আরাধনা করা হয়েছে। এখন দুর্নীতি অপসারণের জন্য অর্থনীতিকে এগিয়ে আসতে হবে। বৈষম্য দূর করার সবপথ কণ্টকাকীর্ণ করে রাখা হয়েছিল। সুগম্য ছিল অর্থ পাচার, অপচয় ও আত্মসাতের সব পথ। এখনো ওই সবের বহু ফাঁকফোকর, পথ ছিদ্র পথ আছে। তাতে ছিপি আঁটা হলে দূর করতে অর্থের অনেকটা সংস্থান হয়ে যেতে পারে। দেশে দায়বদ্ধতার যে সংস্কৃতি সেটি ছিল না। আর তৈরিও করা হয়নি। অতীতে স্বভাব চোরকে স্বাগত আর অভাব চোরকে ধরে রাজপথে পেটানো হয়েছে। স্বভাব চোর যে ভয়ঙ্কর সে তো রাষ্ট্র সম্পদে ভাগ বসায়। রাষ্ট্রীয় মালকে গণিমতের মাল হিসাবে মনে করে। এভাবেই এ রাষ্ট্রকে শেষ করে দেয়ার অভিপ্রায় নিয়ে দেশে এসেছিল পতিতদের নেত্রী। এটা কোনো আড়ারে আবডালের কথা নয়। গোটা বিশ্বকেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল সে কথা।

এখন যারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তারা সভা-সমাবেশ সেমিনার করছেন প্রতিদিন প্রতিক্ষণ। সব আলোচনার এক কথা এক সুর। দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে। জাতিও নির্বাচনের জন্য এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছে। নির্বাচনের অর্থই বৈধভাবে ক্ষমতায় যাওয়া। রাজনীতিকরা এটা চাইবেন সেটি খুব স্বাভাবিক। রাজনৈতিক সংগঠন তো আর কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়। তা ছাড়া গত দেড় বছর পার হয়ে গেছে, কেউ ভোট দিতে পারেনি, তাদের প্রচণ্ড ভোটক্ষুধা রয়েছে। তবে যেনতেন নির্বাচন জনগণের ভোটক্ষুধা মেটাতে পারবে না। ভোটক্ষুধা মেটানোর জন্য মানসম্মত নির্বাচন হতে হবে। সে জন্য পরিবেশ পরিস্থিতি অনুক‚ল থাকতে হবে, ভোটদাতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ভোট যারা করাবেন, তাদের বেছে বেছে নিয়োগ দিতে হবে। এজন্য আইন প্রণয়নসহ যাবতীয় ব্যবস্থা দরকার। ভবিষ্যতে আর যেন অতীতের মতো দুর্গন্ধযুক্ত নির্বাচন না হতে পারে সে নিশ্চিয়তা বিধান করতে হবে। আগামীতে মানুষ সব কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নেবে। সে জন্য তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। সময়মতো সব কাজ শেষে ভোটের ব্যবস্থা। যদি কেউ খুব বেশি তাড়াহুড়ো করতে চান। তবে তাদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে দিন। জনগণ বুঝে নেবে কতটা ধানে কতটা চাল।

কাউকেই ভুলে গেলে চলবে না, ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ আর আগের বাংলাদেশ নেই। দেশে এখন বহু বোদ্ধা তৈরি হয়ে গেছে।

ভালো একটি নির্বাচনের জন্য অর্থ নয় আরো অনেক কিছুর দরকার। রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। ধ্বংসস্ত‚পের ওপর দাঁড়িয়ে আছে দেশ। এর একটি কিনারা করার চেষ্টা করছে যারা, তাদের সাহায্য সহযোগিতা করাই এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। নির্বাচন দাবি করে বহু সভা-সমাবেশ হচ্ছে। এটাও যেমন ঠিক কিন্তু একই সাথে এটাও সঠিক জনগণ যাদের পরবর্তী সরকার হিসাবে দেখতে চায়, তাদের রাজনীতিতে আচরণ পরিকল্পনায় ভবিষ্যতের কোনো বার্তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন। অতীত মধুর হতে পারে। সেটা কেবল অবকাশে স্মৃতিচারণ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। কিন্তু কাল সকালের কথা মানুষ শুনতে চাইবে সে কী পেল।

গত দুই দশকে দেশের মানুষ বিশ্বের বহু পরিবর্তন দেখেছে। এতে মানুষ এখন সতর্ক। তা ছাড়া সদাসতর্ক এমন একটি জনসমাজ তৈরি হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক স্বৈরাচারবিরোধী যে ছাত্র-জনতার আন্দোলন জনগণ দেখেছে, সেখানে কিশোরী যে ভাব-ভাষা ও ভঙ্গি নিয়ে কথায় বলেছে, সেখানে বুদ্ধিবুৎপত্তির যে স্ফুরণ দেখা গেছে। আগামীতে যারাই ক্ষমতায় আসুক, তাদের পান থেকে চুন খসলে এসব তরুণ-তরুণী-কিশোর-কিশোরী আরো মুখর হয়ে উঠবে কোনো সন্দেহ নেই। এসব এখন থেকেই ভাবতে হবে। তারা কিন্তু চুলচেরা সব বিশ্লেষণ করবে। এ দিকে লক্ষ রাখা খুব জরুরি। একটি কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা, ড. ইউনূসের বিশ্বব্যাপী যে মর্যাদা এবং উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম থেকে তার দিকে যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে, আমাদের রাজনীতিকরা তেমন কিছু স্বপ্ন ও আশা করতে পারে না। তাকে রাষ্ট্র মেরামতের যে কঠিন কাজটা দেয়া হয়েছে সেটিও দেশের রাজনীতিকদের পক্ষে করা অসম্ভব। মাত্র দু’মাসে যতটুকু হয়েছে গত ৫০ বছরেও সে পথে কেউই অগ্রসর হতে পারেননি। এ জন্য যে, পরিকল্পনা সক্ষমতা যোগ্যতার দরকার ছিল আর কারো এমনটা ছিল সেটা বলা দুষ্কর। যা তিনি করতে চাচ্ছেন, সেটি সম্পন্ন হলে দলমত জাতি সবাই উপকৃত হবে। এটার কোনো ব্যত্যয় ঘটলে বিপদ থেকে কেউই রক্ষা পাবে না। আর ড. ইউনূসকে কেউ ব্লাঙ্ক চেক দেয়নি। এটা আমরা জানি। সময়মতো এবং যথাযথ কাজ না হলে তাকেও জবাবদিহি করতে হবে।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement