২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আমি নভেম্বর বিপ্লব দেখেছি

- প্রতীকী ছবি

এখন যেমন ৩৬ জুলাইয়ের গণবিপ্লবের পর একটি স্বস্তির পরিবেশ ফিরে এসেছে ঠিক তেমনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর জাতীয় জীবনে স্বাধীনতার পরিবেশ নিশ্চিত হয়। ১৫ আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে আনন্দ উল্লাস লক্ষ করা যায়। এমনকি সূর্যসেন হলের গেটে এসে হাজির হয় সেনাবাহিনীর ট্যাংক। ছাত্ররা সেই ট্যাংকের উপরে উঠে যে আনন্দনৃত্য করেছে তা সারা পৃথিবী দেখেছে। অবাক হওয়ার বিষয়, আওয়ামী দুঃশাসনের ফলে সৃষ্ট দুর্মূল্য আকস্মিকভাবেই স্বল্পমূল্যে পরিণত হয়। সর্বত্রই শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসে। এ জন্য ক্ষমতাসীনদের নতুন আইন আরোপ করতে হয়নি, কোনো ধরনের বিধি-নিষেধ ঘোষণা করতে হয়নি। এভাবে মানুষের শান্তি ও স্বস্তির মধ্যে এমনি এমনি চলছিল দেশ। মাত্র ৭০-৭৫ দিন এ সময়ে আমরা মানে ছাত্ররা স্বাভাবিকভাবেই দিন যাপন করছিলাম।

অক্টোবরের শেষ দিকে উত্তর বাড়িতে কিছুটা গুমোট আবহাওয়ার আভাস পাওয়া যায়। এ দেশের সব গুজবই যেন সত্য হয় : উত্তর বাড়িতে তারা নিজেরা নিজেরা ঝগড়া করছে। পণ্ডিত ব্যক্তিরা কেউ কেউ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যাকরণ মোতাবেক বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের কথা বলছিলেন।

অবশেষে ৩ নভেম্বর আমরা দেখলাম শাহবাগে রেডিও স্টেশনে, সচিবালয়ে ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নতুন সেনাদের আনাগোনা। একসাথে রেডিও টেলিভিশনে ঘোষিত হলো নতুন সরকারের কথা। বলা হলো খন্দকার মোশতাক আহমেদ পদত্যাগ করেছেন। সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ। টিভিতে দেখানো হলো যে, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানদ্বয় খালিদ মোশাররফকে দু-কাঁধে ব্যাজ পরিয়ে দিচ্ছেন। মানুষ এসব দেখে এবং শুনে আতঙ্কিত ও আশঙ্কিত হলো। তাহলে কি আবারো আওয়ামী প্রেতাত্মারা ফিরে আসছে? আবার কি আমরা আধিপত্যবাদের কবলে নিপতিত হচ্ছি? পরদিন ৪ নভেম্বর এর একটি দৃশ্যমান উত্তর নাগরিকরা প্রত্যক্ষ করল।

আমি তখন এক নম্বর হোস্টেল, বর্তমান স্যার এ এফ রহমান হলের বাসিন্দা। সকাল ১০টার দিকে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটি মিছিলের সংবাদে। মিছিলটি খুব বেশি লোকের নয় তবে, মিছিলের পুরোভাগে রয়েছেন খালেদ মোশাররফের বৃদ্ধ মা। আরো রয়েছেন খালেদ মোশাররফের ভাই আওয়ামী এমপি রাশেদ মোশাররফ। সবাই নিশ্চিত হলো প্রতিবিপ্লবের রাজনৈতিক পরিচয়। অবশ্য এর একটি অন্য ভাষ্যও আছে। খালিদ মোশাররফ আওয়ামী পরিবারের সন্তান ছিলেন বটে। তার আনুগত্যও ছিল সেখানে। কিন্তু ৩ নভেম্বরের বিপ্লব আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার জন্য হয়নি। কারণ খালেদ মোশাররফ জানতেন সেনাবাহিনীর নাড়ির খবর। সিপাহি থেকে সেনাপ্রধান পর্যন্ত সবারই আওয়ামী লীগের প্রতি আক্রোশ ছিল। জনশশ্রুতি এ রকম যে, খালেদ মোশাররফ তার মা ও ভাইকে বলেছিল- এই মিছিলের দ্বারা তোমরা আমার পতন নিশ্চিত করেছ। যাই হোক, ১৫ আগস্টের পরিবর্তনের বিপক্ষে যেকোনো উদ্বেগকে সেনাবাহিনী ও জনসাধারণ ভালো চোখে দেখেনি। সুতরাং নিয়তির নির্মমতায় বিদ্ধ হলেন খালেদ মোশাররফ এবং প্রতিবিপ্লবের অন্যরা।

খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়। এই সরকার মাত্র তিন দিন স্থায়ী ছিল। তাদের নতুন করে মন্ত্রিপরিষদ গঠন বা উপদেষ্টামণ্ডলী গঠনের সময় হয়নি। ৩ থেকে ৬ নভেম্বর সাধারণ মানুষ ছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। আর সেনানিবাসগুলোতে ছিল ভয়াবহ আতঙ্ক। প্রথমত সিনিয়র জুনিয়রদের দ্বন্দ্বে ও আনুগত্যের প্রশ্নে গোটা সেনাবাহিনী ছিল দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে সিনিয়রদের কমান্ড, অপর দিকে আতঙ্ক। বিশেষত সাধারণ সৈনিকরা ছিল ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে। তারা গৃহযুদ্ধ তথা ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তপাতের আশঙ্কা করছিল। একদিকে চাকরি অপরদিকে দেশপ্রেম। কী করবে তারা? দিশেহারা সৈনিকরা দিশার জন্য, নির্দেশনার জন্য অনেকের সাথেই যোগাযোগ করে। এই অনেকের মধ্যে প্রধান ছিলেন কর্নেল তাহের। বলে নেয়া প্রয়োজন যে, জাসদ গোপনে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে গণবাহিনীর অনুকরণে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নামে কতিপয় সেল গঠন করে। আমার গবেষণা মতে, এ ধরনের ছেলের সংখ্যা ছিল ৩৬টি। পরবর্তীকালে এদের অনেকের ইন্টারভিউ নিয়েছি আমি। তুলনামূলকভাবে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে এদের প্রভাব ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু এই দুঃসময়ে সৈনিক সংস্থার বাইরের অনেকেই কর্নেল তাহেরের দ্বারস্থ হয়। তাহের নারায়ণগঞ্জে বসবাস করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি আহত ছিলেন। ট্রেনে করে তাকে ঢাকায় আনা হয়। এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাসায় তিনি আশ্রয় নেন। ৩ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত সেখানে সিরিজ অব মিটিংস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে খালেদ মোশাররফের সরকারকে উৎখাত করে বিপ্লবী সরকার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অবশেষে তাদের সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে নতুন সরকার যাত্রা শুরু করে। কৌশলগত কারণে বিচারপতি সায়েম প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকেন। পরবর্তীকালে একটি মেধাবী ও অভিজ্ঞ উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান এই জাতির অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করেন।

কর্নেল তাহের দৃশ্যত নেতৃত্ব দিলেও তার প্রতি সাধারণ সৈনিকদের আনুগত্য ছিল না। আনুগত্য ছিল সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের প্রতি। এমনিতেই স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে, সৎ মানুষ হিসেবে এবং দক্ষ সাহসী সজ্জন হিসেবে সেনাবাহিনীতে তার সুনাম ছিল। খালেদ মোশাররফ যখন তাকে সেনাপ্রধান থেকে সরিয়ে দেয় এবং গৃহবন্দী করে তখন সাধারণ সৈনিকরা ভেতরে ভেতরে ফুঁসে ওঠে। কর্নেল তাহেরের পরিকল্পনা ছিল জিয়াকে মুক্ত করে তার কাছে এনে জিম্মি করা। তার নির্দেশনা মোতাবেক জিয়াউর রহমানকে চলতে বাধ্য করা। কিন্তু পরিকল্পনামাফিক বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকেরা যখন তাকে মুক্ত করার জন্য অগ্রসর হয়, তখন শত শত সৈনিক অনুগমন করে। তারা জিয়াউর রহমানকে কাঁধে তুলে নাইট ড্রেসেই ‘সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি’ সদর দফতরে নিয়ে আসে। তাহেরের লোকেরা নানা ছলে-বলে-কলে-কৌশলে আবারো তাহেরের কাছে নিয়ে আসতে চায়। জিয়াউর রহমান তার দূরদৃষ্টি ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে উল্টো কর্নেল তাহেরকে সেনানিবাসে নিয়ে আসেন। যখন কর্নেল তাহের বুঝতে পারেন, জিয়াউর রহমানের কাঁধে বন্দুক রেখে তার তথাকথিত বিপ্লব সম্ভব নয়, তখন তিনি বন্দুকের নল ঘুরিয়ে ধরেন। এবার স্লোগান তোলা হয় সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই অফিসারের কল্লা চাই। তাহেরের লেলিয়ে দেয়া লোকেরা বেশ কয়েকটি রক্তপাত ঘটায়। তাহেরকে পরে আটক করা হয়। ভারতের হাই কমিশনারকে হাইজ্যাক করে তাহেরকে মুক্ত করার অপচেষ্টা চলে। সে এক দুঃখজনক ইতিহাস। (বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন : লেখকের জিয়াউর রহমান আচ্ছাদিত ইতিহাস)

খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে। তাকে অপসারণ করে নিজেই সব ক্ষমতা কুক্ষীগত করে। খালেদের একজন শক্ত সহযোগী ছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল। তিনি বঙ্গবন্ধু প্রীতিতে ভুগতেন। ‘হট হেডেড’ বলে তার দুর্নাম ছিল। জুনিয়র মেজরদের শায়েস্তা করার ব্যাপারে তার প্রতিজ্ঞা ছিল। বিপ্লব ব্যর্থ হলে তিনি বঙ্গভবনের দেয়াল টপকাতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন। গবেষণা কর্মের প্রয়োজনে ১৯৮৮ সালের দিকে আমি খুঁজছিলাম তাকে। কাকতালীয়ভাবে এক অফিসে তার সাথে দেখা হয় আমার। আমি তার মধ্যে অস্থির কিছু দেখিনি। তিনি তখন সদ্য গড়ে ওঠা উত্তরায় থাকেন। আমি তার সাথে সেখানে দেখা করি। তিনি আন্তরিকভাবে কথা বলেন। পরবর্তীকালে তার বক্তব্যের কয়েকটি পুস্তিকা আমার হাতে আসে। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার এই যে, আওয়ামী লীগের কু-বুদ্ধিজীবীরা যখন জিয়াউর রহমানকে আগস্ট হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করছিলেন তখন কর্নেল শাফায়াত জামিল এ কথা সমর্থন করেননি। এমনকি আওয়ামী লীগ জমানায় এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি আজো বেঁচে আছেন।

৬ নভেম্বর রাত ১২টাকে তারা ‘জিরো আওয়ার’ বলে ঘোষণা করে। এই জিরো আওয়ারে সিদ্ধান্ত হয় যেসব সৈনিক অস্ত্রাগার থেকে জোরপূর্বক অস্ত্র গ্রহণ করবে এবং গুলি ছুতে ছুড়তে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে বেরিয়ে আসবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিটি ট্রাকেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার একজন নেতা বা কর্মী উপস্থিত থাকবেন। তিনি যেভাবে পরিচালনা করেন সেভাবেই সাধারণ সৈনিকদের চলতে হবে। কর্নেল তাহের তাদের স্লোগান শিখিয়ে দেন। এসব স্লোগান এর মধ্যে ছিল- ‘বিপ্লব বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’, ‘সিপাহি জনতা এক হয়েছে, এক হয়েছে’। কিন্তু সাধারণ সৈনিকদের আধিক্যে সেই শেখানো স্লোগান হারিয়ে যায়। তাদের মুখে উচ্চারিত হয়, ‘নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবার’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, ‘জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’, ‘খন্দকার মোশতাক জিন্দাবাদ’। রাত ৩টার দিকে ঘুমন্ত অবস্থায় আমরা এসব স্লোগান শুনে হলের বাইরে এসে দাঁড়াই। তখন সৈনিকরা আমাদের হাত উত্তোলন করে স্বাগত জানায়। আমরাও তাদের প্রতি হাত নেড়ে অভিনন্দন জানাই।

আমার এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সাথে পরে যুক্ত হয়, গবেষণার প্রমাণাদি। আমার গবেষণার শিরোনাম ছিল- ‘তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা : জিয়াউর রহমান সমীক্ষা’। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে সেনাবাহিনীর শাসনকে সুনজরে দেখার উপায় ছিল না। কিন্তু জিয়াউর রহমানকে যতই জেনেছি, ততই মুগ্ধ হয়েছি। বুঝতে পেরেছি যে তাকে নিঃশেষ করে দেয়ার মাধ্যমে এই জাতির প্রাণ কেড়ে নেয়ার চক্রান্ত হয়েছে। নীরবে নিভৃতে শহীদ জিয়ার জন্য কেঁদেছি অনেক। সে অন্য কথা। ফিরে যাই ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলিতে। পরবর্তীকালে আমি ৭ নভেম্বর বিপ্লবের অংশীজনের সাথে কথা বলি। হাসানুল হক ইনুর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। তিনি অকপটে তার নিজ হাতে লিখিত আত্মজীবনী আমাকে ব্যবহার করতে দেন। সেখানে নভেম্বর বিপ্লবের আনুপূর্বিক ঘটনাবলি বিবৃত ছিল। একেবারে ‘জিরো আওয়ার’ থেকে ঘণ্টা মাসিক বিবরণ আছে। অবশেষে ব্যর্থতার ইতিহাসও আছে। এই আত্মজীবনীটি পরবর্তীকালে আলোর মুখ দেখেনি সম্ভবত তার আওয়ামী প্রীতির কারণে।

৭ নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনিবার্য ঘটনা। এটি শুধু ক্ষমতার পালাবদলের ইতিহাস নয়, জাতির আদর্শিকভিত্তির প্রথম প্রস্তর। সেদিন কর্নেল তাহের সৈনিকদের দিয়ে যা ঘটাতে চেয়েছিলেন, হলো তার বিপরীত। সমাজতন্ত্রের স্লোগানের পরিবর্তে ধ্বনিত হলো-আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব। এটি কেউ তাদের শিখিয়ে দেয়নি। তাদের হৃদয় সাধারণ মানুষদের হৃদয়। এ দেশের সাধারণ সৈনিকরা সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই সেদিন তাদের মুখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হয়েছে আল্লাহু আকবার। পরবর্তীকালে শহীদ জিয়াউর রহমান যথার্থভাবেই জনগণের নাড়ির টান অনুভব করেন। সংবিধানে সংযোজিত হয়, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। মূল নীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা পরিত্যক্ত হয়। সমাজতন্ত্র নতুনভাবে ব্যাখ্যাত হয়। আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস সংবিধানের মূলমন্ত্র বলে গৃহীত হয়। মুসলিম বিশ্বের সাথে মৈত্রীকে সাংবিধানিক বাধ্য-বাধকতা দেয়া হয়। সঙ্গতভাবেই জিয়াউর রহমান পরবর্তীকালে জনগণের হৃদয়ে স্থায়ী আসন লাভ করেন।

আবার ফিরে আসি মূল ঘটনায়। রাত ৩টায় সিপাহিদের স্লোগানে মুখরিত হয় ঢাকা নগরী। হলের সব ছাত্র আমরা বেরিয়ে আসি নীলক্ষেতের বড় রাস্তায়। অনেকে স্ব-ইচ্ছায়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৈনিকদের সাথে ট্রাকে উঠে যান। কোত্থেকে আরো আরো ট্রাক হাজির হয়। সে কি আনন্দ! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ভরে যায় আবেগে-উচ্ছ্বাসে, স্লোগানে-মিছিলে। সকালে মিষ্টির দোকানগুলো খালি হয়ে যায়। আনন্দ আবেগ আর মিছিলে ঢাকা মহানগরী উত্তাল ও মুখর হয়। এ যেন এক ঈদ। আমার জীবনে আমি মানুষকে এত খুশি হতে দেখিনি কখনো।

আমার একটি অভ্যাস ছিল, রিকশায় করে ঘুরে বেড়ানো। সেদিন আমি ১১টার দিকে ঘণ্টা হিসেবে একটা রিকশা নেই। সেই সফর চকবাজার থেকে মিরপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আমি দেখেছি মুখর প্রান্তর। আমি দেখেছি, উল্লাসে ক্লান্ত শ্রমজীবী মানুষ। আবেগ আপ্লæত চাকরিজীবীর মুখ। সবাই অপার আনন্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। পুরো নগরীটাই যেন মিছিল, মিছিল আর মিছিলে পরিপূর্ণ এক অপূর্ব সমাবেশ। জিয়াউর রহমান বারবার রেডিও টিভিতে সৈনিকদের ব্যারাকে ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানান। জিয়াউর রহমানের সাহস, ধৈর্য ও কুশলতা অস্তিত্ব বিলীনের মুখোমুখি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। একজন পাশ্চাত্য গবেষক মন্তব্য করেন যে- ‘It was Zia himself who said the army from an impending doom’. (Marcus Franda, Bangladesh : The First Decade, 1982)

অর্ধশতাব্দী আগে যে বিপ্লব বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে নতুনভাবে নিশ্চিত করেছিল, সেটি আজও প্রাসঙ্গিক। ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাইয়ের গৌরবময় বিপ্লবের সাথে রয়েছে এর চেতনা, সংযোগ ও পরম্পরা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছাত্ররা সূচনা করেছিল, জনগণের রক্তদানের মধ্য দিয়ে সফলতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল এই গণবিপ্লব। আর এই বিপ্লবকে পরিপূর্ণতা দানে এগিয়ে এসেছিল আমাদের প্রিয় সেনাবাহিনী। গণবিপ্লবের সফলতার পেছনে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা বিভিন্ন সেনা আবাসিক এলাকায় যে আন্দোলন করেছেন, তা সেনা নেতৃত্বকে আন্দোলিত করেছে। আবারো সেনাপ্রধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অবদান রেখেছেন। তিনি সঠিক দায়িত্ব পালন না করলে, আরেকটি রক্তক্ষয়ের দিকে ধাবিত হতে পারত দেশ। ছাত্র-জনতা ও সেনাবাহিনীর সেই সংযোগ, ধারাবাহিকতা ও নেতৃত্ব ৩৬ জুলাইয়ের বিপ্লবকে করেছে মহিমান্বিত। এই জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে প্রত্যাশিত ইস্পাত কঠিন ঐক্য যদি বহমান থাকে তাহলে কখনোই পরাজিত হবে না বাংলাদেশ।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement