বুদ্ধিমান উকিল ও বোকা গোয়ালার গল্প
- জয়নুল আবেদীন
- ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৩৪, আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৩:২১
মসজিদের সংখ্যাধিক্যের কারণে ঢাকা ‘মসজিদের শহর’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মাদরাসার সংখ্যাধিক্যের কারণে মাদরাসার দেশ বাংলাদেশ বললেও ভুল হবে না। যে হারে মসজিদ এবং মাদরাসা বাড়ছে সে হারে আমাদের চরিত্রের উৎকর্ষতা বাড়ছে না; বরং কমতে শুরু করেছে।
কিছু দিন আগে এ বিষয়ে, ‘এসি চলছে কিন্তু ঠাণ্ডা বের হচ্ছে না’ শিরোনামে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় একটি আর্টিকেল লিখেছিলাম। চরিত্রের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি না পাওয়ার কারণ থেকেই আমাদের মতভেদও বেশি। ‘পলিটিক্স’ একটি বইয়ের নাম। বইটির বয়স প্রায় তিন হাজার বছর। লেখক দার্শনিক অ্যারিস্টটল। বইটি পড়া উচিত রাজা ও শাসকদের। ৩০০ বছরে পলিটিক্স শব্দের অর্থটাই পাল্টে গেছে। এখন প্রতিপক্ষকে হারানোর কৌশলের নাম পলিটিক্স। এখন এলাকা আর পাড়া নয়, ঘরে ঘরে পলিটিশিয়ান। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। অর্থ- কোনো কাজে অনাবশ্যক বেশি কর্মী জুটলে মতভেদের কারণে সে কাজ পণ্ড হয়ে যায়।
মাত্র ১৪৮ হাজার বর্গকিলোমিটার পরিমাণ দেশটিতে রয়েছে প্রায় ৫০টি রাজনৈতিক দল। আর ৯৮ লাখ বর্গকিলোমিটারের দেশ আমেরিকা যেখানে রাজনীতির দল মাত্র দু’টি। ইংল্যান্ডেও রাজনীতির দল দু’টি। বাংলাদেশ থেকে ৬৬ গুণ বড় আমেরিকায় আমাদের তুলনায় রাজনৈতিক দলের সংখ্যা হওয়া দরকার ছিল তিন হাজার ৩০০টি। আমাদের দেশে ধর্মের আবহে রাজনৈতিক দলের সংখ্যাই প্রায় এক ডজন।
প্রায় অর্ধশত রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই মুহূর্তে দেশজুড়ে একটি মাত্র দল দৃশ্যমান। সত্বর নির্বাচনের জন্য তাড়াহুড়ো শুরু করেছে দলটি। তারা ধরেই নিয়েছে, ‘এ দেশের পরবর্তী সরকার তারা’। দলের কেন্দ্রীয় কমান্ড দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সংযত হওয়ার জন্য প্রাণপণ রাস টানছে। দলটি এতই বড় যে, রাস টানতে গিয়েও হাঁপিয়ে উঠছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। ‘আওয়ামী লীগসহ এর অঙ্গ-সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও ভোটারদের নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগপন্থী ভোটাররা কারো না কারো ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেবেনই। কারো ছত্রছায়ায় থেকে রাজনীতি করার চেয়ে প্রকাশ্য রাজনীতি অনেক ভালো। ৫ আগস্ট থেকে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাস তাদের সম্পর্কে দেশের মানুষ যা জানতে পেরেছে তা জানার পরও যদি দেশ ও জাতি তাদের চায় তাহলে সুশীলসমাজ দূরে থাকাই ভালো।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের গণতন্ত্র এমনই এক বিশ্রী অবস্থার ভেতর দিয়ে গমন করতে হয়েছে যা বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না। এক কথায় বলা চলে, ‘উলটপালট করে দে মা চেটেপুটে খাই’। এই চেটেপুটে খাওয়ার সংস্কৃতি থেকে সুশীল ব্যক্তিরা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। যাবতীয় ধর্ম মূল্য প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধিসহ ২০২৪ সালের হজের প্যাকেজ নির্ধারণের সময় ২৯.৭৪ টাকা সৌদি রিয়াল ধরে প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল। এবার তা ৩২.৫০ টাকা বৃদ্ধির পরও হজের খরচ জনপ্রতি প্রায় লক্ষাধিক টাকা কমেছে। হজের নামে, ‘পাট ব্যবসায়ী থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক সাবেক ধর্মমন্ত্রী। যে দেশে হজের নাম করে ধর্মমন্ত্রী কোটি টাকা ব্যবসায় করতে পারে, যে দেশের পার্লামেন্ট চলে পালাগানের শিল্পী দিয়ে, সে দেশের ভাগ্য ভালো হবে কী করে?
দেশের সুশীল ব্যক্তিরা যতদিন রাজনীতিতে ফিরে না আসবেন ততদিন দেশের ভাগ্যসহ সুশাসন আশা করা সম্ভব নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গেছেন, ‘পৃথিবীতে কাহারও অভাবে অধিক দিন কিছুই শূন্য থাকে না।’ পূরণ হবে সুশীল মানুষের অভাবও। অনেকের বিশ্বাস, ‘ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সারা দেশে নিজেদের সাংগঠনিক কাঠামো গোছানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ১৫টি জেলায় তাদের কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে।’ এভাবে সারা দেশ সাংগঠনিক কাঠামো গঠন করে সুশীল ব্যক্তিদের রাজনীতিতে নিয়ে আসা উচিত। দেশের মানুষ নতুন স্বাধীনতায় নতুন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় রয়েছেন।
ফেলে আসা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সব কিছু নতুন করে হোক। ভুলেও NEW বোতল যেন OLD ওষুধ দিয়ে ভর্তি করা না হয়।
মনে রাখা দরকার, শাসকের সংখ্যা যত বেশি, অরাজকতা তত বেশি। এই উক্তিটি রয়েছে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতেও। The Oxford Dictionary of Phrase, 'too many cooks spoil the broth' Proverbial saying, meaning that if too many people are involved in a task or activity, it will not be done well; it is recorded from the late 16th century.
বাংলাদেশের পার্লামেন্ট সদস্য ৩০০। ভারত বাংলাদেশের চেয়ে ২২ গুণ বড়। রাজ্যসভায় (পার্লামেন্ট) লোকসংখ্যা ২৪৫ জন। একই কারণে রাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত অপ্রয়োজনীয় লোকের দ্বারা সুশাসনের চেয়ে দুঃশাসন বেশি হয়। যেখানে নির্বাহী কর্মকর্তা ও তার অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আইন রক্ষাকারী সংস্থা উপজেলা পরিচালনা করতে পারেন সেখানে স্থানীয় সরকারের নামে উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রয়োজন কেন? প্রয়োজন নেই প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে ওয়ার্ড মেম্বারসহ চেয়ারম্যানও। অধিকাংশ স্থানীয় সরকারই নিজের আধিপত্য বহাল রাখার জন্য লাঠিয়াল বাহিনী পালন করে। লাঠিয়ালসহ শাসকের সংখ্যা যত বেশি অরাজকতা তত বেশি, উদাহরণ হিসেবে ‘বুদ্ধিমান উকিল ও বোকা গোয়ালার গল্প’টি মনে পড়ে গেল। গল্পটি কার কাছে শুনেছিলাম মনে নেই। গল্পটি নিম্নরূপ :
মতলব সাহেব একজন বুদ্ধিমান উকিল। ভেজাল ও বাজে খাবার পছন্দ করেন না। বাড়ির পাশে মদন গোয়াল।
একদিন ডেকে আনেন মদন গোয়ালকে। খাঁটি দুধের জন্য চুক্তি করতে চান। বোকা মদন চুক্তিটুক্তি বুঝে না। না বুঝেই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে রাজি হয়। মদন গোয়ালের সাথে খাঁটি দুধ সরবরাহ করার জন্য চুক্তিপত্র করেন। কাগজ-কলমে এক বছরের জন্য চুক্তি। দাম প্রতি লিটার খাঁটি দুধ ৭০ টাকা। এক মাস দুধ দেয়ার পর দুধের দাম সামান্য বেড়ে যায়। মদন পায়ের তলে বসে আপত্তি করে উকিল সাহেবের কাছে। বলে, ‘স্যার গরিব মানুষ, কুলাইতে পারি না, দুধের দামটা একটু বাড়িয়ে দেন।’ উকিল সাহেব ধমক দিয়ে চুক্তিপত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। বাড়াবাড়ি করলে হাজতে পাঠানোর ভয় দেখায়।
নিরুপায় মদন লোকসানের হাত থেকে বাঁচার জন্য সাহেবের চোখের অগোচরে দুধে সামান্য পানি মেশায়। উকিল সাহেবের জিহ্বা পানির বিষয়টি টের পেলেও হাতে-কলমে ধরতে না পেরে কিছু বলতেও পারছেন না, করতেও পারছেন না। উকিল সাহেবও ছাড়ার পাত্র নন। দুধ পরীক্ষার জন্য একজন ইন্সপেক্টর নিয়োগ করেন। বাঁচার জন্য পথ বের করলেন মদন গোয়ালও। ইন্সপেক্টর নিয়োগের পর দুধের স্বাদ আরো কমে যায়। সন্দেহ হয় ইন্সপেক্টর সাহেবের ওপর। সন্দেহ দূর করার জন্য আরো একজন ইন্সপেক্টর নিয়োগ করেন। দুই ইন্সপেক্টর নিয়োগের পর দুধের স্বাদ আরো কমে যায়। গোয়ালাসহ দুই ইন্সপেক্টরকে পরীক্ষার জন্য আরো একজন ইন্সপেক্টর নিয়োগ করেন। উকিল সাহেব মদন গোয়ালের শেষ না দেখে ছাড়বেন না। এভাবে একের পর এক সাতজন ইন্সপেক্টর নিয়োগের পর গোয়ালা উকিল সাহেবের কাছে যা নিয়ে গেলেন তা ছিল ‘খাঁটি জল’। অথচ, সাতজন ইন্সপেক্টরই রিপোর্ট দিয়েছেন ‘খাঁটি দুধ’।
গোয়ালার কাছে উকিল সাহেব হার মানলেন। হার মেনে মাথা নিচু করে প্রকৃত রহস্য জানতে চাইলেন গোয়ালার কাছেই। গোয়ালা হাত জোড় করে বললেন, স্যার দুধের দাম যখন সামান্য বাড়ল তখন আপনার কাছে আবদার করেছিলাম দুধের দামটা সামান্য বাড়িয়ে দিতে। আপনি আমার সত্যিকারের আবদার রক্ষা করেননি। তাই লোকসানের হাত থেকে বাঁচার জন্য দুধের সাথে সামান্য জল মিশিয়েছিলাম। আপনি খাঁটি দুধ পরীক্ষার জন্য নিয়োগ করলেন ইন্সপেক্টর। ইন্সপেক্টরকে খুশি করতে গিয়ে দুধে পানির পরিমাণ আরেকটু বাড়াতে হলো। সাতজন ইন্সপেক্টরকে খুশি করতে গিয়ে দুধের মূল্য সব ইন্সপেক্টরদেরই দিয়ে দিতে হয়েছে। এখন আপনি পানি বললেও লাভ হবে না, কারণ আপনার নিযুক্ত সাতজন ইন্সপেক্টরই লিখিত রিপোর্ট দিয়েছেন ‘খাঁটি দুধ’। প্রথম দিন যদি আমার কথা বিশ্বাস করতেন তবে ‘খাঁটি দুধ’ বলে ‘খাঁটি পানি’ পান করতে হতো না। সবাই কোটিপতি হওয়ার জন্য অপরাধ করে না শ্রমের উপযুক্ত মজুরি না পেলে কেউ কেউ একান্ত দায়ে পড়েও অপরাধ করতে বাধ্য হয়।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা