স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন
- ইকতেদার আহমেদ
- ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৯:৫৯
গণতন্ত্র আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি। সাধারণ অর্থে গণতন্ত্র বলতে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনকে বুঝায়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমতের প্রতিফলনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটপ্রাপ্ত দল একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সরকার পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে। এরূপ শাসনব্যবস্থায় যেকোনো নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া কাম্য। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত না হলে সে সরকারের পক্ষে স্বচ্ছতার সাথে জবাবদিহিমূলকভাবে সরকার পরিচালনা সম্ভব নয়।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনুসৃত হয় পৃথিবীর এমন সব দেশে সংবিধানের বিধিবিধানের আলোকে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই ব্যবস্থায় অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনে নির্বাচনপরবর্তী সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে। পৃথিবীর প্রায় সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাধারণ নির্বাচন পূর্ববর্তী সংসদ ভেঙে দিয়ে ছোট পরিসরের মন্ত্রিসভা নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে। পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচনকালীন দায়িত্বরত সরকার নির্বাচনের কাজে প্রশাসনকে প্রভাবিত করেছে এমন নজির বিরল। সেসব দেশে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দলীয় সরকার পরাভ‚ত হওয়ার বহু নজির রয়েছে। আমাদের দেশে নির্বাচনকালীন ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দলীয় সরকারের পরাভূত হওয়ার কোনো নজির নেই।
সংবিধান ও অন্যান্য নির্বাচনী আইনে নির্বাচন কমিশনের যে বিদ্যমান ক্ষমতা রয়েছে ওই ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব কি না এ বিষয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সন্দেহ বিরাজ করছে।
নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক সংস্থা। এর গঠন, ক্ষমতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সংবিধানের সপ্তম ভাগে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ ভাগে ১১৮ অনুচ্ছেদ থেকে ১২৬ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত ব্যাপৃত ৯টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সম্পর্কে সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত¡াবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং নির্বাচন কমিশন এ সংবিধান ও আইনানুযায়ী (ক) রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন; (খ) সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন; (গ) সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করবেন এবং (ঘ) রাষ্ট্রপতির পদের এবং সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত করবেন।’
নির্বাচন কমিশন একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যূন চারজন নির্বাচন কমিশনার সমন্বয়ে গঠিত। এরা সবাই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
নির্বাচন কমিশনাররা শপথের অধীন এবং শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে তারা তাদের কার্যভার গ্রহণ করেন। নির্বাচন কমিশনারদের পদের মেয়াদ কার্যভার গ্রহণের তারিখ থেকে পাঁচ বছর। একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অবসরগ্রহণ পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভের জন্য যোগ্য নন যদিও একজন নির্বাচন কমিশনার অবসর পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ লাভের জন্য যোগ্য।
নির্বাচন কমিশনারদের পদে আসীন হওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়সের সীমারেখা দেয়া না থাকলেও বাংলাদেশ অভ্যুদয় পরবর্তী এযাবৎকাল পর্যন্ত ১৩টি নির্বাচন কমিশনে যারা প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ লাভ করেছেন এদের সবাই নিয়োগ লাভ পূর্ববর্তী প্রজাতন্ত্রের কর্মে উচ্চ ও অধস্তন আদালতের বিচারক বা অসামরিক বা সামরিক কর্মকর্তা পদ থেকে অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন। ইতঃপূর্বে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে এমন একাধিক ব্যক্তি নিয়োজিত ছিলেন যারা ৭০-৮০ বছর বয়সসীমার মধ্যে অবস্থানকালীন কর্মে বহাল ছিলেন। সুতরাং শারীরিক সুস্থতা থাকলে একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চতর বয়সে উত্তীর্ণ হওয়া অর্থাৎ ৮০ বছর অতিক্রম করা বারিত নয়।
নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে ২৯ জানুয়ারি ২০২২ তড়িঘড়ি করে যে আইনটি প্রণীত হয়, এ আইনটি পর্যালোচনায় দেখা যায় এটি ইতঃপূর্বে একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রাক্কালে যে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল অনেকটা উভয়ের অনুরূপ। প্রণীত আইনের সার্চ কমিটির সাথে প্রথমোক্ত সার্চ কমিটির একমাত্র পার্থক্য হলো এটিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত দু’জন বিশিষ্ট নাগরিক, যাদের একজন নারী অন্তর্ভুক্তির বিধান করা হয়েছে। দ্বিতীয় সার্চ কমিটি প্রণীত আইনের সার্চ কমিটির মতো সমসংখ্যক ছয় সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হলেও এটির অতিরিক্ত দু’জন সদস্যের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং অপরজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় সার্চ কমিটিতে যে চারজন সাংবিধানিক পদধারীর সন্নিবেশন ঘটেছিল প্রণীত আইনটিতেও সমরূপ সাংবিধানিক পদধারী অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
ইতঃপূর্বেকার সার্চ কমিটি প্রতিটি পদের বিপরীতে দু’টি নাম সুপারিশ করতে পারত। প্রণীত আইনটির ক্ষেত্রেও দেখা যায় সার্চ কমিটি প্রতিটি পদের বিপরীতে দু’টি নাম সুপারিশের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। সার্চ কমিটি তার দায়িত্ব পালন সম্পন্ন পরবর্তী সুপারিশগুলো রাষ্ট্রপতি বরাবর পাঠানোর যে বিধান প্রণীত আইনে রয়েছে আগেকার সার্চ কমিটির ক্ষেত্রেও অনুরূপ বিধান ছিল।
এখানে যে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন তা হলো সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে তার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট দু’টি দায়িত্ব যথা প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ব্যতীত অপর দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ব্যতিরেকে কার্য সম্পন্নের কোনো ক্ষমতা প্রদান করেছে কি না। এক কথায় এর সহজ-সরল উত্তর- সংবিধান রাষ্ট্রপতি কর্তৃক এককভাবে এরূপ ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়ে নিশ্চুপ। উপরোক্ত আলোচনা থেকে ধারণা পাওয়া যায় আগেকার সার্চ কমিটি কর্তৃক সুপারিশ পরবর্তী নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অত্যাবশ্যক ছিল প্রণীত আইনেও এর ব্যত্যয় রাখা হয়নি।
দেশ ও জাতি ইতঃপূর্বে প্রত্যক্ষ করেছে সার্চ কমিটির সুপারিশে গঠিত একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচন কমিশন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচনের আয়োজন করে চরমভাবে বিতর্কিত হয়েছে। প্রণীত আইনের সার্চ কমিটি বাস্তবতার নিরিখে আগেকার সার্চ কমিটির চেয়ে অধিকতর গ্রহণযোগ্য সুপারিশ প্রদানে যে ব্যর্থ তা ত্রয়োদশ কমিশনের কার্যাবলি পর্যবেক্ষণে ইতোমধ্যে দেশবাসীর কাছে স্পষ্টরূপে প্রতিভাত।
সংবিধানে বলা হয়েছে- উপরোল্লিখিত দায়িত্বসমূহের অতিরিক্ত কোনো দায়িত্ব সংবিধান বা অন্য কোনো আইনের অধীন নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা হলে নির্বাচন কমিশন সে দায়িত্বও পালন করবে।
সংবিধান প্রণয়নকালীন নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে বলা ছিল- প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিতসংখ্যক কমিশনার সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালে প্রণীত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা কমিশনারের সংখ্যা নির্ধারিত করে বলা হয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন কমিশনার সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। পঞ্চদশ সংশোধনী পূর্ববর্তী গঠিত ১০টি নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং এক থেকে অনধিক পাঁচজন কমিশনার সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল। এ সময়কালের অধিকাংশ নির্বাচন কমিশনে কমিশনারের সংখ্যা এক বা দু-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। শুধু নবম নির্বাচন কমিশন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও পাঁচজন কমিশনার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজন কমিশনার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল।
বাংলাদেশে এ যাবৎকাল পর্যন্ত ১৩টি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ নির্বাচন কমিশন গঠনকালীন আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা কার্যকর ছিল। এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত ছিল এবং নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োগ বিষয়ে রাষ্ট্রপতি তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেন। নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও দ্বিতীয় নির্বাচন কমিশন প্রায় আট বছরকাল দায়িত্ব পালন করে। চতুর্থ নির্বাচন কমিশন গঠনের অব্যবহিত পর গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হলে তদকর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনও ১১ মাসের মাথায় পদত্যাগে বাধ্য হয়। ষষ্ঠ নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে দেখা যায় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধানাবলির আলোকে গঠিত অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন দেশের প্রথম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কার্যভার গ্রহণের পর ষষ্ঠ নির্বাচন কমিশনকে চতুর্থ নির্বাচন কমিশনের ন্যায় মেয়াদ পূর্তির আগে এক বছর পূর্ণ করার প্রাক্কালে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।
চতুর্থ ও ষষ্ঠ নির্বাচন কমিশনের মতো নবম নির্বাচন কমিশনও নির্ধারিত মেয়াদ পূর্তির আগে প্রায় এক বছর আট মাসকাল দায়িত্ব পালনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত গভর্নরের নেতৃত্বাধীন অসাংবিধানিক সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা আরোহণে পদত্যাগে বাধ্য হয়। সপ্তম নির্বাচন কমিশন প্রথম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক গঠিত হলেও এর প্রধানের বিষয়ে তৎকালীন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে অব্যাহতভাবে অনাস্থা ব্যক্ত করা হতে থাকলে মেয়াদ পূর্তির ১১ মাস আগে আত্মসম্মান রক্ষার্থে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্র্তৃক গঠিত দশম নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করলেও এর মাধ্যমে পরিচালিত নবম সংসদ নির্বাচন দেশের তৎকালীন বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় এ নির্বাচন কমিশনটির গঠন ও দায়িত্ব পালন তদের কাছে যথার্থ ছিল না।
বাংলাদেশে ইতঃপূর্বের ১৩টি নির্বাচন কমিশনের কর্মতৎপরতা পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় দলীয় সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে একমাত্র অষ্টম নির্বাচন কমিশন ব্যতীত প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ- এ ছয়টি নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল দলীয় সরকারের অনুক‚লে যায়। কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকার, সাংবিধানিকভাবে গঠিত প্রথম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং অসাংবিধানিকভাবে গঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত গভর্নরের নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কালে গঠিত পঞ্চম, সপ্তম ও দশম এ তিনটি নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে দেখা যায় কমিশন কর্তৃক ঘোষিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল কমিশন গঠন অব্যবহিত আগেকার ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতিকূলে যায়। উল্লেখ্য, অষ্টম নির্বাচন কমিশন দলীয় সরকার কর্তৃক গঠিত হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন সাংবিধানিকভাবে গঠিত দ্বিতীয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্বে ছিল; অপর দিকে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ- এ ছয়টি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকালীন যে দলীয় সরকার কর্তৃক কমিশনগুলো নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিল সে সরকারগুলো ক্ষমতাসীন ছিল। চতুর্থ, ষষ্ঠ ও নবম- এ তিনটি নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলসমূহের দাবি ও জন-আকাক্সক্ষার কারণে মেয়াদ পূর্তির আগে অপরিপক্ব বিদায় নিতে হওয়ায় এ কমিশনগুলোর পক্ষে কোনো জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অবকাশ সৃষ্টি হয়নি।
ইতঃপূর্বে আমাদের দেশে দলীয় সরকার কর্তৃক গঠিত নির্বাচন কমিশন ও দলীয় সরকারের শাসনামলে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচন দেশের মূল বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল উভয়ই ক্ষমতাসীনদলীয় সরকার হিসেবে নির্বাচন কমিশন গঠন ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করেছে; যদিও ক্ষমতাসীন দলীয় সরকার কর্তৃক নির্বাচন কমিশন গঠন এবং ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে বড় দু’টি দলের অবস্থান ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতার বাইরে থাকা অবস্থায় ভিন্নতর।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হচ্ছে, যে মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়, সে মুহূর্র্ত থেকে কমিশন কর্তৃক নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত সব ব্যক্তি নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে গণ্য হন এবং তারা সবাই নির্বাচনী কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত কমিশনের অধীনে প্রেষণে কর্মরতরূপে বিবেচিত হন। এ সময়ের মধ্যে কোনো কর্মকর্তাকে কমিশনের আদেশ অমান্য বা এর আদেশ প্রতিপালনে অসম্মতি প্রকাশ করলে কমিশন নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর বিধান অনুযায়ী আদেশ অমান্যকারী কর্মকর্তাকে দু’মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করতে পারে এবং আদেশ অমান্যকারী কর্মকর্তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ বা বরখাস্তের নির্দেশনা দিতে পারে। উপর্যুক্ত বিধান দ্বারা এটা সুস্পষ্ট যে, নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার নিরপেক্ষতা অর্জন বিষয়ে কমিশনের পর্যাপ্ত ক্ষমতা রয়েছে।
আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় যে, ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক মনোনীত এবং পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনাররা বিরোধী দলের কাছে আস্থাভাজন না হওয়ায় কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নতুনভাবে কমিশন পুনর্গঠন করা হয়েছিল।
তাই বিতর্ক পরিহার্থে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপরাপর নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ প্রক্রিয়া সংসদ বহাল থাকাবস্থায় সংসদের সংসদীয় কার্য উপদেষ্টা কমিটিকে দেয়া যেতে পারে, যে কমিটির প্রধান হবেন স্পিকার। সরকারি ও বিরোধী দল উভয় দলের নেতা এবং সংসদের অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এ কমিটির সদস্য হবেন। যদি এ নিয়োগ প্রক্রিয়াটি অপর কোনো কর্তৃপক্ষকে দেয়া হয়, তাহলে সংসদীয় কার্য উপদেষ্টা কমিটির মতো ফলপ্রদ হবে না।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনা থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট। এর একটি হলো দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দলীয় সরকারবহির্ভূত সরকার কখনো নির্বাচিত হয়নি আর অপরটি হলো দলীয় সরকার ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় গঠিত নির্বাচন কমিশন দলীয় সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে কমিশনের স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নির্বাচন পরিচালনা করে ক্ষমতাসীনদের বিজয় পুনঃনিশ্চিত করেছে।
বিগত ক্ষমতাসীনরা একক উদ্যোগে রাজনৈতিক সমঝোতা ব্যতিরেকে নির্দলীয়
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছিল। তাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বা আগামীতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতাসীন হবেন তাদের উদ্যোগ নিতে হবে। বিগত ক্ষমতাসীনরা জনদাবির উপেক্ষা ও অবজ্ঞায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় জন-আকাঙ্ক্ষা ও জনরোষে তাদের অপমানজনক বিদায়ের সম্মুখীন হতে হয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে সুমুন্নত রাখতে হলে বর্তমানে যারা অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দেশ ও জনগণের স্বার্থের কথা চিন্তা করে তাদের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতাই হতে পারে সাংবিধানিক শাসন অব্যাহত রাখার একমাত্র পাথেয়।
তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান থাকা বা না থাকা অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের মতো একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানে সৎ, যোগ্য, দক্ষ এবং সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির নিয়োগ নিশ্চিত করতে না পারলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করেন দেশ ও জনগণের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য। একটি দলীয় সরকারের মেয়াদ অবসান পরবর্তী কী ব্যবস্থায় সরকার পরিচালিত হবে এবং কোন ধরনের ব্যক্তি সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে সে বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে জনগণের মঙ্গল ও কল্যাণের বিষয়গুলো পর্যুদস্ত হবে।
বিগত সরকারের বিদায়পরবর্তী সে সরকারটির সময়কালে গঠিত সর্বশেষ ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশনটিও পদত্যাগের মাধ্যমে বিদায় নেয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যে কাজ তা হলো একটি কার্যক্ষম নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান। সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে যেসব দলের আন্দোলনের ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আগমন ঘটেছে তাদের সাথে আলোচনা ব্যতিরেকে নির্বাচন কমিশন গঠন ফলপ্রসূ হবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বিগত সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে যে আইন প্রণয়ন করেছিল সে আইনের বিধানাবলির আলোকে সার্চ কমিটি গঠন করেছে। এ সার্চ কমিটি যদিও নির্বাহী আদেশে গঠিত ইতঃপূর্বেকার অপর দু’টি সার্চ কমিটির অনুরূপ; তারপরও দেশবাসীর প্রত্যাশা দলীয় সরকারের প্রভাববিহীন পরিবেশে দায়িত্ব পালনে সার্চ কমিটি রাজনৈতিক দলসমূহের কাছ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের নামের প্রস্তাব গ্রহণ পরবর্তী এগুলো যাচাই-বাছাইপূর্বক স্বচ্ছতার সাথে যে সুপারিশ প্রস্তুত করবেন তা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের পথ সুগম করবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা