২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সমস্যার সমুদ্রে দৃঢ়তাই সম্বল

সমস্যার সমুদ্রে দৃঢ়তাই সম্বল - নয়া দিগন্ত

‘দশে মিলি করি কাজ হারি-জিতি নাহি লাজ’-এ কথা বহু দিনের অভিজ্ঞতার বিবরণ। সবাই মিলেমিশে কোনো কাজ করলে তাতে সফলতা আসবেই। যদি সে কাজ সফল না হয় তার জন্য কাউকে এককভাবে দুঃখিত কিংবা লজ্জিত হতে হয় না। সফলতা যেমন সবার, ব্যর্থতাও তেমনি সবার। আমরা সবাই এই গল্পটি জানি- এক বৃদ্ধ তার মরণকালে তার ১০ ছেলেকে ডেকে প্রত্যেকের হাতে একটি করে লাঠি দিয়ে বললেন, এটি ভাঙো তো। প্রত্যেকে খুব সহজে এক-একটি লাঠি ভেঙে ফেললে। এরপর বৃদ্ধ ১০টি লাঠি একত্র করে আঁটি বেঁধে প্রত্যেককে বললেন, এবার এই আঁটি ভাঙো তো। কেউ সে আঁটি ভাঙতে পারল না।

তখন বৃদ্ধ বললেন, বাবা সব! সবসময় তোমরা যদি এই আঁটির লাঠিগুলোর মতো একত্রে থাকো তাহলে কেউ তোমাদের ভাঙতে বা ক্ষতি করতে পারবে না। আর যদি তোমরা একেকজন আলাদা হয়ে যাও তাহলে তোমাদের অনৈক্যের সুযোগে অন্যরা তোমাদের একেকজনের সর্বনাশ সাধন সহজে করতে পারবে। সে জন্য কথায় বলে- একতাই বল। ইংরেজিতে একটি চমৎকার প্রবাদবাক্য আছে- ‘টহরঃবফ বি ংঃধহফ, ফরারফবফ বি ভধষষ’, একতার বলে আমরা দাঁড়াই, বিভক্তিতে ঘটে আমাদের পতন। এ কথা সব ক্ষেত্রে খাটে। যেকোনো কাজে, যেকোনো সঙ্কট সন্ধিক্ষণে সমস্যার সমুদ্রে সবার সম্মিলিত সমন্বিত প্রয়াস প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। যেকোনো কঠিন কাজ হোক না কেন সবাই মিলেমিশে বুদ্ধি খাটিয়ে শক্তি দিয়ে করলে তা সমাধা করা সহজতর হয়।

এই সমাজে বা সংসারে কেউ একা একা কিছু করতে পারে না। আমরা প্রত্যেকে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। আমার যা আছে আরেকজনের হয়তো তা নেই- আবার অন্যের যে শক্তি, দক্ষতা ও সামর্থ্য আছে আমার হয়তো সেটি পুরোপুরি নেই- তাই আমাদেরকে অবশ্যই সামর্থ্যরে ভাগাভাগি করতে হবে। দুই-দুইয়ে যেমন চার হয় তেমনি আমাদের সবার সম্মিলিত শক্তি একেকজনের একক শক্তি ও সামর্থ্যরে চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। দেশের যেকোনো বড় ধরনের সমস্যা মোকাবেলায় সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এখানে ঐক্যের ব্যাপারটি বেশ বড়। লাঠিগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় তা ভাঙা যেমন সহজ হয়েছিল তেমনি দেশের বড় সমস্যা মোকাবেলায় দেশবাসী যদি ঐকবদ্ধ হয় তা হলে তা মোকাবেলা করা সহজ হয়; বরং পরস্পরের মধ্যে অনৈক্য, একে অন্যের ওপর দোষারোপ ও নির্ভরশীলতার সমস্যার সমাধান শুধু কঠিনই হয় না; সমস্যা আরো বাড়ে বৈ কমে না। কেননা, অনৈক্যের মধ্যেই সে সমস্যা আরো বাড়ার সুযোগ পায়, সমস্যা সম্প্রসারিত হয়। বড় কিছু অর্জন করতে হলে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন, সবার বুদ্ধি পরামর্শ ও অংশগ্রহণ আবশ্যক। আর সবার সজাগ দৃষ্টিতে সব ভুল ও সমস্যা সহজে দূর করা সম্ভব হয়। ইতিহাসে বহু প্রমাণ আছে, কোনো দেশে যদি জনগণের মধ্যে একতার অভাব দেখা দেয়, তখন নিজেদের মধ্যে অনৈক্য ও ভুল বোঝাবুঝি বাড়ে, একে অন্যের ওপর দোষারোপের প্রবণতা বাড়ে- তখন সে দেশে বাইরের শত্রুরা এসে সহজে নানান সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ ঘটিয়েই বড় বড় সংসারে ভাঙন সৃষ্টি হয় এবং সংসার ভাঙার সে সুযোগ গ্রহণ করে বাইরের কোনো ষড়যন্ত্রকারী।

ক্ষুদ্র প্রাণী পিপীলিকা, মৌমাছি এরা সবাই একতাবদ্ধ হয়ে সারিবদ্ধ হয়ে চলাচল করে খাদ্য সংগ্রহ করে। কোনো খাদ্যের সন্ধান পেলে কাক তারস্বরে অন্য কাকগুলোকে ডাকে। আবার একটি কাক যদি বিপদগ্রস্ত হয় ডাকাডাকি করে সব কাক একত্রে সমস্বরে তার প্রতি সমবেদনা জানায়। এসবই একতাবদ্ধ থাকার প্রেরণা থেকে। বনের পশুপাখিরাও প্রতিকূল পরিবেশে একত্রে সহাবস্থান করে নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে।

মানুষ সংসারে নানান উপায় ও উপলক্ষে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে থাকতে চায়। পরিবারে ভাইবোন পিতা-মাতা সবাই একত্রে, বিদ্যালয়ে সহপাঠীদের সাথে, মেসে বা হলে হলমেট বা কক্ষ সাথীর সাথে, চাকরিতে ব্যাচমেট, প্রবাসে জেলাবাসী ও এলাকাবাসী হিসেবে সমিতি করে। তারা নিজেদের মধ্যে ঐক্যের ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেয়। উৎপাদনকারী ব্যবসায়ী শিল্প-কারখানার মালিক-শ্রমিক সবাই সমিতি গঠনের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার ও উন্নয়নে সবার সম্মিলিতভাবে সজাগ, সোচ্চার ও সক্রিয় হতে চায়। জাতিসঙ্ঘ সবল ও দুর্বল সব রাষ্ট্রেরই সঙ্ঘবদ্ধ সংস্থা। বিচ্ছিন্ন ইউরোপীয় দেশগুলো এখন ইউনিয়নভুক্ত হয়ে শক্তিশালী ইউরোপ গড়ার স্বপ্ন দেখছে।

একতাবদ্ধ হওয়ার জন্য প্রত্যেকের ঐকান্তিক ইচ্ছা এবং পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব থাকতে হবে। প্রত্যেকে আমরা পরের তরে এ উপলব্ধি সবার মধ্যে থাকা জরুরি। নিজের শক্তি সামর্থ্য ভাগাভাগিতে সহযোগিতার মনোভাব না থাকলে একতা গড়ে উঠবে না। সবার সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে তার সমাধানে সবাইকে ব্রতী হতে হয়। এ ক্ষেত্রে নিজের স্বার্থ হয়তো কিছুটা ছেড়ে দিতে হতে পারে। শুধু নিজের লাভের চিন্তা এখানে অত্যন্ত বেমানান। বড় কিছু অর্জন করতে হলে, বৃহত্তের ঐক্যের স্বার্থে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থবোধকে উৎসর্গ করতে হয়। সবার সম্মিলিত প্রয়াস প্রচেষ্টায় অনেক কঠিন কাজ সহজে করা সম্ভব। সুতরাং সে উদ্দেশ্য সাধনে নিজের আত্মত্যাগও জরুরি।

মানবিক অধিকারের স্বীকৃতি, সাম্য এবং সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে সব ধর্মে ও মতবাদে এ সত্য প্রতিফলিত হয় যে, কোনো মানুষ অপর মানুষকে যেন নীচ ও ঘৃণ্য মনে না করে; বরং নিজের বংশগত মর্যাদা, পরিবার অথবা ধনসম্পদ ইত্যাদির ভিত্তিতে গর্ব না করে। কেননা, এগুলো প্রকৃত গর্বের বিষয় নয়। এ ধরনের গর্ব ও অহঙ্কারের কারণে পারস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষের পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সর্বজনীনতার শিক্ষা হলো- সব মানুষ একই পিতা-মাতার সন্তান হওয়ার দিক দিয়ে ভাই ভাই এবং পরিবার গোত্র অথবা ধন-দৌলতের দিক দিয়ে যে প্রভেদ প্রভু নিরঞ্জন রেখেছেন, তা গর্বের জন্য নয়, পারস্পরিক পরিচয়ের জন্য।

আসমানি কিতাব আল কুরআনে ব্যক্তিদের পারস্পরিক হক, আদব ও সামাজিক রীতিনীতি নির্দেশ করা হয়েছে এভাবে-

‘তাদের অধিকাংশ অনুমানেরই অনুসরণ করে, সত্যের পরিবর্তে অনুমান কোনো কাজে আসে না। তারা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’ (১০ সংখ্যক সূরা ইউনুস, আয়াত-৩৬)

২. তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না; ঈমানের পর মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। হে মুমিনরা! তোমরা বহুবিধ অনুমান করা থেকে দূরে থাকো, কারণ অনুমান কোনো ক্ষেত্রে পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না...।’ (৪৯ সংখ্যক সূরা হুজুরাত, আয়াত : ১১-১২)

উপরের নির্দেশনাবলিতে- ১. অনুমান করা; ২. কারো গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করা; ৩. কাউকে ঠাট্টা ও উপহাস করা; ৪. কাউকে দোষারোপ করা এবং ৫. কারো পশ্চাতে নিন্দা করা বা গিবতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনুমান বা ধারণা করা থেকে বিরত থাকার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে- কতক ধারণা পাপ। প্রত্যেক ধারণাই পাপ নয়। অতএব কোন ধারণা পাপ তা জানা জরুরি সাব্যস্ত করতেই সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন রয়েছে। নিষিদ্ধ ধারণা অনেক ক্ষেত্রে অপবাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কোনো ব্যক্তির প্রতি শক্তিশালী প্রমাণ ব্যতিরেকে কোনো দোষ আরোপ করা সমীচীন নয় শুধু, রীতিমতো অপরাধও।

কারো গোপনীয় বিষয় বা দোষ অনুসন্ধান প্রসঙ্গে বলা যায়, যে দোষ প্রকাশ্য তা ধরা যায়; কিন্তু যে দোষ প্রকাশ্য নয়, তা সন্ধান করা উচিত নয়। হাদিস শরিফে আছে- রাসূল সা: বলেছেন, ‘মুসলমানদের গিবত করো না এবং তাদের দোষ অনুসন্ধান করো না। কেননা, যে ব্যক্তি মুসলমানদের দোষ অনুসন্ধান করে, আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন, তাকে স্বগৃহেও লাঞ্ছিত করে দেন।’ কাউকে ঠাট্টা বা উপহাসের বিষয়ে বলা যায়- কোনো ব্যক্তির দেহে, আকার আকৃতিতে কিংবা কর্মকাণ্ডে কোনো দোষ দৃষ্টিগোচর হলে তা নিয়েও কারো হাসাহাসি বা উপহাস করা উচিত নয়। কেননা, এটি হয়তো জানা নেই যে, এই ব্যক্তি সততা, আন্তরিকতা ইত্যাদির কারণে প্রকৃত প্রস্তাবে উপহাসকারীর চেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ। এ প্রসঙ্গে রাসূলে করিম সা:-এর একটি হাদিস বিশেষভাবে উল্লেখ্য- ‘আল্লাহ মুসলমানদের আকার আকৃতি ও ধন-দৌলতের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না; বরং তাদের অন্তর ও কাজকর্ম দেখেন।’ কারো দোষ বের করা, দোষ প্রকাশ করা এবং দোষের কারণে ভর্ৎসনা করাকে আত্মঘাতী প্রবণতার সাথে তুলনা করা হয়েছে।

একে-অপরের প্রতি দোষারোপকে ‘একে-অন্যকে হত্যা করা’র সাথে তুলনা করার কারণ এই যে, অপরকে হত্যা করা যেমন নিজেকে হত্যা করার শামিল, তেমনি কেউ অন্যের দোষ বের করলে সেও তার দোষ বের করবে। পারস্পরিক দোষারোপের ফলে শত্রুতা বৃদ্ধি পায়, অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং মানবিক মূল্যবোধে অবক্ষয় সৃষ্টি হয়। সুস্থ ও সম্মানজনক সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠে এক দুঃখজনক প্রতিবন্ধকতা।

লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


আরো সংবাদ



premium cement