শব্দের প্রভেদ অনুসন্ধান
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ০২ নভেম্বর ২০২৪, ২১:০৪, আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১৪
কথা বলা ও শোনার বদ্ধ দুয়ারগুলো সম্প্রতি খুলে যাওয়ার পর অনেক মূল্যবান কথা শোনার পাশাপাশি এমন কিছু কথাও কানে আসছে যা একেবারেই নিরর্থক, অসার এবং অকল্পনীয়। কেউ কেউ এমন সব দাবিদাওয়া, আবেদন-নিবেদন করছেন যা থেকে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এসব নিছকই আবদার অনুরোধমাত্র। যারা এসব আবদার নিয়ে সামনে আসছে তারা হয়তো এমন ভাবনায় বিভোর যে, এখন যারা ক্ষমতায় আসীন তারা যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে নিয়ে বসে আছেন। চাহিবামাত্র সেটি তাদের কোলে এসে পড়বে। এরা শুধু আত্মপ্রচারই নয়, অনেককেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বলেও মনে হচ্ছে। কারণ, তাদের এসব কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্ট যে, নেপথ্যে থেকে কিছু কূটকৌশলী কুমন্ত্রণা দিয়ে এদের পথে নামিয়েছে। মন্ত্রণা পেয়ে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই উদ্বাহু নৃত্য জুড়েছেন তারা।
বোদ্ধাদের অভিমত, রাজপথের এমন দাপাদাপি ও রঙতামাশার হেতু হচ্ছে, তারা সরকারের সহনশীলতা, ধৈর্য আর উদারতাকে দুর্বলতা বলেই ধরে নিয়েছে। মন্ত্রণাদাতারা ভাবছে, এটাই মোক্ষম সময় লেজ নাড়ানোর। রাজপথের এমন দাপাদাপি, দুষ্কর্মকে ‘দুরভিসন্ধি’ ধরে নিয়ে যুৎসই দাওয়াই বা প্রতি-উত্তর দেয়া জরুরি। একই সাথে খুঁজতে হবে কোথা থেকে আসছে এসব মন্ত্রণা? কালক্ষেপণের অবকাশ নেই। প্রকৃত সত্যটা হচ্ছে, ১৬ বছরের চরম দুর্যোগ তথা স্বৈরাচারের ভ‚ত কাঁধ থেকে ছুড়ে ফেলা গেছে বটে; কিন্তু মূল্য দিতে হয়েছে অনেক। হাজারো শহীদ, শত শত যুদ্ধাহত এবং লাখো গাজীর ত্যাগের ফসলকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত। দুর্বলতার এতটুকু ছিদ্রপথ ধরেই প্রবেশ করতে পারে দুষ্কৃতকারীরা। কোনো ক্রমেই নতুন স্বাধীনতার গায়ে কোনো আঁচড় লাগতে দেয়া যাবে না।
যা হোক, অতীতে কিছু শব্দাবলি, বাক্যাবলি অশুদ্ধভাবে জাতির সম্মুখে নিয়ে আসা হতো বিভ্রম সৃষ্টির জন্য। এখন হঠাৎ করে তারই যেন পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। যেমন রাজপথের যে দাপাদাপি, তাকে গণতন্ত্র বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। গণতন্ত্রের সাথে স্বৈরতন্ত্রকে এক করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। গণতন্ত্রের নতুন ব্যাখ্যারও প্রয়োজন নেই। গণতন্ত্রের ব্যাকরণ আন্তর্জাতিকভাবে স্থিরীকৃত। এখানে যোগ-বিয়োগের অবকাশ কোথায়। অক্ষরজ্ঞান থাকলেই কাউকে শিক্ষিত, জ্ঞানী বোদ্ধা বলা যাবে না। যদি না কারো মধ্যে বোধবিবেচনার স্ফুরণ লক্ষ করা যায়। কোনো বিষয়ের বা তথ্য ও তত্তে¡র সঠিক উপলব্ধি, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ না করে যদি অপব্যাখ্যা দেয়া হয়- তবে সেটি অযথার্থ এবং বর্জনীয়। নিকট অতীতে এমন ধরনের ব্যক্তিদেরই দেয়া হয়েছিল শিক্ষিতের স্বীকৃতি। সেই সাইনবোর্ড নিয়ে এখন হঠাৎ করেই এসব জ্ঞানীর তৎপরতা দেখা যাচ্ছে মানুষকে বেকুব বানানো ও বিভ্রান্ত করার জন্য। মনে রাখতে হবে নানা মৌসুমে বিভিন্ন সরীসৃপ খোলস পাল্টায়।
ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই যে, বিশ্বাস আর বিশ্বস্ততার মধ্যে বাস্তবে প্রায়ই দূরত্ব থাকে অনেকটাই। বিশ্বাস একটা বোধ আর সেই বোধের বাস্তব চর্চাই হলো বিশ্বস্ততা। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বাসের চর্চা এখন কেমন বাংলাদেশে? গত প্রায় ১৬ বছর কী ধরনের বিশ্বাস ও বিশ্বস্ততার চর্চা বা অনুশীলন করা হয়েছে?
প্রথম উদাহরণ দেশের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তুলে ধরা যেতে পারে। এখনো বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ নিম্নবিত্তের বেড়াজাল থেকে বেরুতে পারেনি। নতুন মধ্যবিত্ত সৃষ্টি হওয়া এখন তো স্বপ্নের মতো ব্যাপার। যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি তৈরি হয়েছিল, সেটি গত ১৬ বছরে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে। মধ্যবিত্তের যতটুকু অস্তিত্ব ছিল, তাও শেষ হয়ে গেছে। পতিত সরকারের যত মাফিয়া চক্র অক্টোপাসের আট হাতে প্রায় সব ব্যাংক থেকে টাকা পাচার করে। পাচারকৃত অর্থের বেশির ভাগ ছিল মধ্যবিত্তের। তারা তাদের সামান্য সঞ্চয়টুকু বিশ্বাস ও আস্থার ওপর ভর করে ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দিয়েছিল সঞ্চয় হিসেবে। ওই সব প্রতিষ্ঠান কি মানুষের আমানত রক্ষায় বিশ্বস্ত ছিল? ওই সব প্রতিষ্ঠানের ওপর পতিতদের চোখ পড়েছিল, তাদের কলো হাতের বীভৎস থাবা প্রসারিত হয়েছিল। সেই গণবিরোধী, দেশ ও জাতিবিরোধী অপরাধের দায় কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ কি আছে? আজ তাদের সেই অবিশ্বস্ততার দায় ও চাপ এসে পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। অন্য দিকে, পাচার করা অর্থ যাতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হয়, তার কসরৎ শুধু রাজপথে রঙতামাশার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সর্বত্রই এর ডালপালা নড়েচড়ে উঠছে। পতিত শক্তি জাতির প্রতি যতটা নির্মম নৃশংস ছিল, তাদের জন্য জবাবটা ততটাই কঠোর হতে হবে। এখানে কোনো আবদার আকুতি শুনে করুণা করা বা দয়া দেখানোর সুযোগ নেই। সেটি হলে তা হবে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়ার শামিল।
ভেবে দেখতে হবে, স্বজ্ঞান এবং অজ্ঞান সমার্থক কি না। স্বজ্ঞান তিনি, যার পঞ্চ ইন্দ্রিয় সর্বদা সতর্ক। মুহূর্তে যিনি রঙের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারেন। কালোকে কালো বলতে যার চোখের পাতা ফেলতে হয় না- অর্ধমুদিত চোখেও সাদাকে সাদা বলতে এক নিমেষও ব্যয় করতে হয় না। অনুসন্ধান আর অনুমান কি সমার্থক? জানা আর অনুমানের মধ্যে দূরত্ব কি যোজন যোজন দূরত্বে নয়!
পতিত সরকারের কর্মকাণ্ড জাতিকে জ্ঞানের পথ থেকে সরিয়ে অজ্ঞান করে রাখার চেষ্টায় প্রতি মুহূর্ত ব্যস্ত ছিল। জ্ঞান তৈরি হলেই মানুষ বুঝতে পারবে তার প্রাপ্য কী এবং কোথায়। এই বোধ সৃষ্টি হলেই তো পতিতদের স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটবে। মূর্খদের ওপর ছড়ি ঘোরানো সহজ। জ্ঞান তো মানুষের সব ইন্দ্রিয়কে সতেজ করে। পতিত সরকার নিছক নিজ স্বার্থে দেশের স্বার্থকে বিকিয়ে দিতে তৈরি ছিল; দিয়েছেও। সেটি আমাদের ছাত্রসমাজ বুঝতে পেরেছিল। সেই বোধ তারা সফলভাবে সব জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পেরেছিল বলে স্বৈরাচারের পতন সম্ভব হয়।
জাতির মননে এটাই ঢোকানোর চেষ্টা ছিল যে, অনুমান করে পথ চলতে হবে। এটা করলে ওটা হবে। যেমন উন্নয়নের যেসব বয়ান ছিল, সেগুলো ছিল নিছক কল্পনাপ্রসূত অনুমানভিত্তিক। অনুমান করে বলা হতো, সব উন্নয়নই অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে, জাতি লাভবান হবে। এখন অনুসন্ধানে প্রমাণ, সব মেগা প্রকল্পই জীবনভর খুঁড়িয়ে চলবে। এগুলো লোকসান থেকে কস্মিনকালেও লাভের মুখ দেখবে না। তথাকথিত এসব উন্নয়নের লক্ষ্য ছিল পতিতদের শুভাকাক্সক্ষী ও গোষ্ঠীর স্বার্থকে সুরক্ষা দেয়া। ১৮ কোটি মানুষের ঘাড়ে চাপানো হলো লোকসানের ঘানি টানা। আর যে বিপুল পরিমাণ ঋণের দায় চাপিয়ে দেয়া হলো তারও দীর্ঘমেয়াদি চাপ নিতে হবে এই জাতিকেই।
ভুলে যাওয়া ক্ষমা করা অবশ্যই মহৎ গুণ, মহত্ত্বের লক্ষণ; কিন্তু সব ক্ষেত্রেই কি সেটি ন্যায্যতা পেতে পারে?
পতিত শক্তি ও তাদের সুবিধাভোগী এবং পৃষ্ঠপোষকদের ভূমিকায় গত ১৫ বছর ছিল এক দুঃস্বপ্নের কাল। সেটি ভুলে যাওয়া কারো জন্যই ঠিক হবে না। কেউ আদর্শিক অবস্থান ও মহত্তে¡র অবস্থান থেকে মনে করছেন, ফেলে আসা ভুল-ভ্রান্তিগুলো এখন আর স্মরণে না রাখি। সন্দেহ নেই, এসবই শ্বাশত শিক্ষা, উত্তম আচরণ এবং তাদের চারিত্রিক ধারাবাহিকতা। কিন্তু যাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে অকৃতজ্ঞতা, ঘৃণা-বিদ্বেষ আর প্রতিহিংসা- তাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনের অবকাশ থাকে কি? যারা নিষ্ঠুর, হিংস্র, অতিসম্প্রতি যাদের হাতে গোটা জাতি জিম্মি ছিল- সেই তাদের ক্ষমা করা হলে ১৮ কোটি মানুষের কাছে কী বার্তা যাবে? শত সহস্রবার কথাটি ভাবতে হবে। তবে লঘু পাপে যেন গুরুদণ্ড না হয়। যারা চাপে ছিল সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের পরই তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হতে পারে। ক্ষমাকে যারা সম্মান করে স্মরণ করে তাদের প্রতি ক্ষমা হতে পারে।
ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে রিকনসিলিয়েশন। বাংলায় তার অনুবাদ হতে পারে অতীত ভুলে গিয়ে সমঝোতায় পৌঁছা, পুনর্মিলন। এমন একীভূত হওয়ার অপরিহার্য কিছু শর্ত থাকে। এই একীভূত হওয়ার বয়ানটা ইদানীং শোনা যাচ্ছে। তাই প্রসঙ্গটা নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। যে শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা হলো প্রথমত দুই পক্ষকে এ জন্য একমত হতে হবে। প্রথম পক্ষ নিকট অতীতে দ্বিতীয় পক্ষকে ধ্বংসের কোনো চেষ্টাই বাদ রাখেনি। তবে দ্বিতীয় পক্ষ কোন কারণে প্রথম পক্ষকে আবার সুযোগ দেবে তাকে হত্যার জন্য? দুই পক্ষের চিন্তা-আদর্শ-বোধ-বিবেচনার মধ্যে বিন্দুমাত্র সামঞ্জস্য না থাকলে রিকনসিলিয়েশন হয় কিভাবে? তেল আর পানি কখনো মেশে? দুই মহাসমুদ্রের পানিও সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই পৃথক হয়ে আছে। রক্তের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সাথে সহাবস্থান করতে পারে না। তা ছাড়া প্রশ্ন আরো বিস্তৃত, হাজার শহীদের রক্তের ঋণ কে কার পক্ষে ছাড় দেয়ার অধিকারী।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা