২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দেশে বাম রাজনীতির গতি-প্রকৃতি

-

(প্রথম কিস্তি)
কার্ল মার্কস ও তৎপরবর্তী কমিউনিস্ট দার্শনিকদের চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিবেশ সৃষ্টি হলে তার প্রভাব ভারতীয় উপমহাদেশেও এসে পড়ে। এর ফলে ভারতের মধ্যবিত্ত কিছু হিন্দু শিক্ষিত ব্যক্তি ১৯০২ সালে ‘অনুশীলন সমিতি’ নামে একটি বাম সংগঠন গড়ে তোলেন। পূর্ব বাংলায় প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সূচনা হয় ১৯০৭ সালে। ১৯০৮ সালে কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে ভুলক্রমে মিসেস কেনেডিকে হত্যা করলে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। ১৯৩০ সালে চট্টগামে অস্ত্রাগার লুট করতে গিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন মাস্টারদা বলে পরিচিত সূর্যসেন। এছাড়াও বহু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে কমিউনিস্টরা সরকার ও জনগণের কাছে পরিচিতি পায়।

১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হলে ভারতের গুপ্ত সংগঠনের নেতারা অনুপ্রাণিত হয়। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে সমিতির নেতাদের মদদে শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা ঘটে। রাশিয়ায় কমিউনিস্ট বিপ্লবের মতাদর্শ সমগ্র বিশে^ ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে গঠন করা হয় ‘থার্ড ইন্টারন্যাশনাল’ যা ‘কমিনটার্ন’ নামে পরিচিত ছিল। ১৯২০ সালে ভারতের কয়েকজন বামপন্থী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নেতৃত্বে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে লেনিনের সঙ্গে দেখা করে সেখানে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রবাসী শাখা গঠন করেন।

ভারতের কমিউনিস্টরা দীর্ঘদিন গোপনে ব্রিটিশবিরোধী নানা কার্যকলাপ সম্পাদন করলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলার মতো দৃশ্যমান কিছু করতে পারেনি। ওদিকে ভারতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের সংগ্রামে ততদিনে ব্যাপক গণভিত্তি অর্জন করে ফেলেছিল। তখন কমিউনিস্ট নেতারা উপলব্ধি করেন যে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃত্বেই রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে এবং এ দল দুটোর নেতৃত্বে রয়েছে সমাজের বিত্তশালী বুর্জোয়া শ্রেণী। এদের বিপরীতে গুপ্ত ও বেআইনি সংগঠন হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে ব্যাপকভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। তারা আরো উপলব্ধি করে যে, স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃত্বেই বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় আসবে। এমতাবস্থায়, তারা কৌশল নির্ধারণ করে যে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সঙ্গে সহযোগিতা করে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজ এগিয়ে নিতে হবে, অন্যদিকে, জনগণের মধ্যে কাজ করে কমিউনিস্ট সংগঠনগুলোর কলেবর বাড়াতে হবে। ১৯২৫ সালে কমিউনিস্টরা গোপনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে। এ সময় দলটির প্রকাশ্য নাম দেয়া হয় ‘কৃষক ও শ্রমিক দল’। ১৯২৬ সালে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল’। সভাপতি হন ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। ১৯২৮ সালে মুজফফর আহমদ দলের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। দলটির নেতৃত্বে সারা ভারতে শ্রমিক আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ততদিনে যথেষ্ট শক্তি অর্জন করায় কমিউনিস্টরা ওই দলে শামিল হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। বহু কমিউনিস্ট কংগ্রেসে যোগ দেন এবং বিভিন্ন পদ লাভ করেন। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু হলে কমিউনিস্টরা তাকে ‘সা¤্রাজ্যবাদীদের যুদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করে। এ সময় কংগ্রেস জার্মানির বিরুদ্ধে ব্রিটেনকে সমর্থন করে যা কমিউনিস্টরা পছন্দ করেনি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। যুদ্ধের পর কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধ চরমে ওঠে। অনেক কমিউনিস্টকে কংগ্রেস থেকে বের করে দেয়া হয়। কংগ্রেস থেকে বের হয়ে কমিউনিস্টরা মুসলিম লীগের ওপর ভর করে। ১৯৪৬ সালে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ভারত বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে এবং মুসলমানদের জন্য আলাদা আবাসভূমি পাকিস্তান গঠিত হতে যাচ্ছে।
কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিশেষ কিছু করতে পারেনি। তবে তাদের উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল কৃষক সমিতির মাধ্যমে তেভাগা আন্দোলন গড়ে তোলা। ১৯৪৬-৪৭ সালে বাংলার বিভিন্ন জেলার প্রায় ৬০ লাখ কৃষক এ আন্দোলনে যোগ দেয়। দিনাজপুরে হাজী দানেশের নেতৃত্বে আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, টংক প্রথা অবসানের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মনি সিংহ। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে এই দু’নেতা যথেষ্ট পরচিতি লাভ করেন।

পাকিস্তানে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন
দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট সংগঠনগুলো মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। কারণ এতদিন দলটির নেতৃত্বে ছিল প্রধানত হিন্দুরা। অনেকেই হিন্দু ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান পালন করতেন। ১৯৪৭ সালের পর অধিকাংশ কমিউনিস্ট নেতা ভারতে থেকে যান। পূর্ব বাংলা থেকে কেউ কেউ পশ্চিম বাংলায় চলে যান। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে দলের সদস্য সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।

প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব ছিল না বললেই চলে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সরাসরি নির্দেশনায় এখানকার কর্মীরা কাজ করত। এতে করে তাদের সমস্যা বেড়েই চলছিল। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে প্রথমত: তারা একে মুসলিম লীগের মতোই একটি বুর্জোয়া দল এবং মুসলিম লীগের বি-টিম বলে গণ্য করে। তবে কিছুদিনের মধ্যে তারা গণতন্ত্র ও বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে কর্মসূচি দিতে থাকলে কমিউনিস্ট পার্টি তাদেরকে নতুন করে মূল্যায়ন করে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠিত হলে কমিউনিস্ট ছাত্ররা সেই সংগঠনের সাথে কাজ করতে শুরু করে। পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টি সিদ্ধান্ত নেয় যে, আওয়ামী মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক নাম হলেও যেহেতু তাদের দাবি-দাওয়ার মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িক বিষয় নেই, সেহেতু ওই দলে যোগ দিয়েই তাদের কাজ করতে হবে। এ কৌশলের অংশ হিসেবে মোহাম্মদ তোয়াহাসহ অনেকেই ১৯৫১ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তারা অংশ নেন। ওই বছরেই কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ও কর্মী ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং যুক্ত ফ্রন্ট গঠনে তৎপরতা চালায়। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ তাদের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিলে হিন্দু সম্প্রদায়ের কমিউনিস্টদের আওয়ামী লীগে যোগদানের সুযোগ তৈরি হয়। ‘এ সময় কমিউনিস্ট পার্টিও তার প্রকাশ্য সংগঠন পূর্ব পাকিস্তানের গণতন্ত্রী দল ভেঙে দেয়। ফলে দলের অনেক নেতাকর্মী প্রকাশ্যে বা গোপনে আওয়ামী লীগে যোগ দেয় এবং কমিউনিস্ট পার্টির অনেক সদস্যও আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি শুরু করে।’ (জগলুল)

১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পরে কমিউনিস্টদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। অপর দিকে, সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিনের উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে ক্রুশ্চেভের শান্তিপূর্ণ পন্থায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা নিয়ে বিভক্তি দেখা দেয়। এর প্রভাব পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির উপরও পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভাঙন সম্পর্কে জগলুল আলম যে তথ্য ও ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা প্রণিধানযোগ্য :

‘১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পরপরই পাকিস্তান সরকার দেশে কমিউনিস্ট তৎপরতা বন্ধ করার লক্ষ্যে একটি সমন্বিত নীতি অবলম্বন করেন। এতদুদ্দেশ্যে দেশে কমিউনিস্টদের প্রভাব কমাবার লক্ষ্যে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের নবনির্বাচত সদস্যদের মধ্য থেকে ১৫৭ জন এই চুক্তির বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। মওলানা ভাসানীও আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে এই চুক্তির বিরোধিতা করে বিবৃতি দেন এবং ঘোষণা করেন যে আওয়ামী লীগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির অনুসারী।

১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী বিরোধ চরমে ওঠে। মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে সব সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ জোটের বাইরে এনে আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো অনুযায়ী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ, পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভেঙে দিয়ে স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে সাবেক প্রদেশসমূহ পুনর্গঠন এবং ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি ও মুদ্রাব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রেখে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেয়ার জন্য সোহরাওয়ার্দীর প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী তার নীতিতে অবিচল থাকেন।

এর আগে থেকেই প্রকাশ্য সংগঠন আওয়ামী লীগের সঙ্গে কর্মরত মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দলের অভ্যন্তরে নিজেদের শক্তি সংহত করে আসছিলেন। মওলানা ভাসানী নিজে কখনো কমিউনিস্টদের তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা কিংবা চর্চা করেননি ঠিকই, কিন্তু তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কয়েকটি স্থানে জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং অসংখ্য কমিউনিস্ট তার নেতৃত্বে এসব কৃষক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। এভাবে মার্কসবাদী তত্ত্বের সঙ্গে পরিচিত না থাকলেও সমকালীন আন্দোলনমুখর পরিস্থিতি এবং শ্রেণীসংগ্রাম ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের বিষয়ে তার সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি আপনা থেকেই তাকে একটি আদর্শ বামপন্থী নেতৃত্বে পরিণত করে তুলেছিল। তার সুদৃষ্টির ফলে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ৩৭ জন সদস্যের মধ্যে ৯ জন বামপন্থী কমিউনিস্ট স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই কমিউনিস্টদের প্রভাবেই ১৯৫৫ সালের কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি প্রত্যাহার করা হয়েছিল। ১৯৫৬ সালে নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা এক গোপন সম্মেলনে মিলিত হয়ে পার্টির রণকৌশল ঠিক করে এবং আওয়ামী লীগের সাথেই কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সম্মেলনে মনি সিংহকে সভাপতি করে নতুন কমিটি গঠিত হয়।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনার জন্য ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে কাগমারীতে অনুষ্ঠিত বিখ্যাত সম্মেলনে উভয় নেতা পরস্পরের মুখোমুখি হন। ভোটাভুটিতে সোহরাওয়ার্দীর কাছে মওলানা ভাসানী পরাজিত হন। ভাসানী তার সমর্থক ৯ জন কমিউনিস্ট সদস্যসহ পদত্যাগ করেন। পদত্যাগের পর মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালে সেপ্টেম্বরে ঢাকায় এক ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের’ সম্মেলন আহ্বান করেন। সম্মেলনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে কমিউনিস্টদের নতুন দল গঠিত হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির অনেকেই এতে যোগ দেন। মওলানা ভাসানীকে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সভাপতি নির্বাচন করা হয়। ...

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সেনানায়ক আইয়ুব খানের নেতৃত্বে সামরিক শাসন জারি করা হলে অন্যান্য দলের মতো ন্যাপের কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বামপন্থীসহ সব বিরোধী দল মিলে মিস ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দেয়। এরপর আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন হলে ন্যাপও অন্যান্য বিরোধী দলের সাথে অংশগ্রহণ করে। ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী শিবিরে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে ন্যাপও দু’ভাগে বিভক্ত হয়। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি পাকিস্তানে সফরকালে ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন গোপন ও প্রকাশ্য বামপন্থী দল তার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। তবে ৬ দফার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ অগ্রভাগে থাকলেও কমিউনিস্টরা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যদিও তা দৃশ্যমান ছিল না।

১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচনের সময় সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজ বিপ্লব সম্পাদনের প্রবক্তা মস্কোপন্থী বাম দলগুলো নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন চীনপন্থী ন্যাপ নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে মতবিরোধে ভুগছিল। তোয়াহা ও আবদুল হকের মতো কমিউনিস্টরা নির্বাচনের বিরোধী ছিলেন। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাস হলে অনেকে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানায়। কিছু দিনের ব্যবধানে মওলানা ভাসানী ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’ স্লোগান দিয়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। ভাসানী ন্যাপসহ চীনপন্থী যেসব দল নির্বাচন বর্জন করেছিল তাদের মতে, ‘নির্বাচন হচ্ছে বুর্জোয়াবাদ প্রতিষ্ঠার একটি পথ’। তারা এর বিপরীতে ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’ গঠনের পক্ষে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা এক পার্টি দলিলে উল্লেখ করে যে, ‘জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের ফলে গড়ে উঠবে এক নতুন পূর্ব বাংলা, জনগণের পূর্ব বাংলা, এক সম্পূর্ণ স্বাধীন, সুখী ও সমৃদ্ধশালী পূর্ব বাংলা। এতে আরো বলা হয়, ‘এই রাষ্ট্র কায়েমের জন্য জনগণকে নিতে হবে অস্ত্র। শোষকদের প্রতিবিপ্লবী ভাড়াটিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণকে গড়ে তুলতে হবে বিপ্লবী সেনাবাহিনী। শোষকদের বিরুদ্ধে হবে যুদ্ধ, বিপ্লবী জনযুদ্ধ।’ (জগলুল)

লেখক : গবেষক ও সাবেক সচিব
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement