০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ পৌষ ১৪৩০, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৫
`

রাজনীতিতে অপ্রয়োজনীয় অস্থিরতা

-

আওয়ামী লীগসহ ১১টি দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে করা রিট থেকে কেন সরে এলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা? কারো পরামর্শ ছাড়াই কি করেছিলেন রিটটি? তা হলে আবেদন প্রত্যাহার করলেন কার পরামর্শে? তাদের কি তবে, ময়মুরব্বি বদলে গেছে? অথবা এক মুরব্বি মহল থেকেই আগে-পরে দুই বুদ্ধি এসেছে?

যদিও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ প্রতিহিংসার অংশ, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র, একটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন শ্রেণিপেশার জনগণ দ্বারা গঠিত হয়। তাই দল নিষিদ্ধের বিষয়টি গভীর ভাবনার।

কেবল ১১টি দলের রাজনীতি নিষিদ্ধই চাননি তারা। আওয়ামী লীগ আমলের বিতর্কিত বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বৈধতা না দেয়ার কথাও ছিল রিট আবেদনে। এতে বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, সে বিষয়ে রুল চাওয়া হয়। এসব নির্বাচনের গেজেট কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না, সে বিষয়েও রুল চাওয়া হয় সেই রিটটিও না চালানোর কথা জানিয়েছেন তাদের আইনজীবী। প্রথম রিটে আওয়ামী লীগসহ ১১টি দলকে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর অনুমতি না দিতে অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা চাওয়া হয়। রিট আবেদনে নির্বিচার মানুষ হত্যা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা, বেআইনি প্রক্রিয়ায় অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের অভিযোগ আনা হয় দলগুলোর বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি দলগুলো হলো- জাতীয় পার্টি (এরশাদ), জাতীয় পার্টি (মঞ্জু), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বিকল্পধারা বাংলাদেশ, তরিকত ফেডারেশন, কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (সিপিবি), লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি), গণতন্ত্রী দল, মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী (বড়ুয়া) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল।

অবাক ব্যাপার হচ্ছে- আওয়ামী লীগের ধারে কাছেও না থাকা কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবিকে টার্গেট করা হয়েছে। আরেক দিকে আওয়ামী লীগের একান্ত অনুগত রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টির নাম নেই। কিন্তু বাংলাদেশে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী (বড়ুয়া) নামে কোনো রাজনৈতিক দল না থাকলেও এই নামটি রয়েছে আবেদনে। সম্ভবত দিলীপ বড়ুয়ার সাম্যবাদী দলকে (এমএল) বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে ড্রাফটিংয়ে সংশ্লিষ্টরা ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের নাম ঠিকভাবে না জানার একটি নমুনা স্পষ্ট। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিকদের ঠিকভাবে না চেনার আলামত বিদ্যমান। নইলে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-এলডিপির নাম আসে না।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের পর ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে সারজিস আলম লেখেন, ‘দুটি রিট করেছি। আওয়ামী লীগের বিগত তিনটি নির্বাচনকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং অবৈধভাবে প্রাপ্ত সুবিধাগুলো কেন ফিরিয়ে দেবে না সে বিষয়ে প্রথম রিট। এই মামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত কেন তাদেরকে পলিটিক্যাল সব অ্যাক্টিভিটি থেকে বিরত রাখা হবে না সে বিষয়ে দ্বিতীয় রিট।’ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ কিংবা নিবন্ধন নিষিদ্ধের কোনো কথা রিটে নেই বলেও পোস্টে জানান সারজিস আলম। এর আগে, এক পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, কোনো রিটই দায়ের করা হয়নি। প্রক্রিয়া করা হয়েছে মাত্র। পরে রিটকারীদের আইনজীবী, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিমও সাংবাদিকদের রিট দায়েরের তথ্য নিশ্চিত করেন। জানান, রিটে সরাসরি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চাওয়া হয়নি। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে গত ২৩ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে সরকারকে আলটিমেটাম দেয়া হয়েছিল ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে। ওই আলটিমেটামের পরই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে সরকার। এর আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আগস্টে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার। ক্ষমতা গ্রহণের পর ওই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার।

মোট কথা, এমন ওলটপালট কাণ্ড রাজনৈতিক সচেতনদের একটি ঘোরের মধ্য ফেলেছে। জাগাচ্ছে শঙ্কাও। আর প্রশ্ন তো ঘুরছেই। স্পষ্ট জবাব না পেলেও দেশ যে এখনো গৃহবিবাদমুক্ত হয়নি, তা ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। তা ছিল মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীনের পূর্বাপরেও। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের আগে-পরেও। সেই ছাপ এবারো। অবশ্য একই ঘটনার একাধিক ব্যাখ্যা এখানে বেশ চলে। বিজয়ী আর পরাজিতদের ব্যাখ্যা ভিন্ন হয়। আর ইতিহাসটা বিজয়ীরাই লেখে। ঘটনা যা-ই ঘটুক, ক্ষমতার পালাবদল হলে ইতিহাসের বয়ান পাল্টে যায়। এক সময় আগের সত্যটা মিথ্যা হয়ে যায়। মিথ্যাটা হয়ে যায় সত্য।

এই বাস্তবতার মধ্যেও রাজনীতিকে আদালতে টেনে নেয়ার সংস্কৃতি বন্ধের একটি প্রত্যাশা মানুষের। তা যেন হয়েও হচ্ছে না। এবারের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশে একটি বড় ধরনের ওলট-পালট হয়েছে। অনেক বছরের অব্যবস্থাপনা ও লুণ্ঠনের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তলানিতে। মূল্যস্ফীতির আঘাতে মানুষ জেরবার। এ সময় নানান গোষ্ঠী নানান বায়না বা আবদার নিয়ে মাঠ গরম করছে। এর মধ্যে বিতাড়িত-পরাজিত দলকে নিষিদ্ধ করার দাবিও একটি। এক পর্যায়ে দাবিনামাটি ওই বিতাড়িত দলের সহযোগী-সুবিধাভোগী দলের দিকেও যায়। আদালত মাড়িয়ে তা আবার রাজপথে ফিরে আসে। হামলা হয় জাতীয় পার্টির কাকরাইল কার্যালয়ে। একদিকে ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ মাধ্যমে ২০২৪-পূর্ববর্তী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনীতির সাথে ছেদ ঘটিয়ে নতুন করে শুরু করার আকাঙ্ক্ষা ও অঙ্গীকার; আরেক দিকে, পুরোনো কাঠামোকে রূপ দেয়ার চেষ্টা।

ক্ষমতাচ্যুতরা সহজেই হাল ছেড়ে দেবেন মনে করা যায় না। তাদের সহযোগীরা নানান কথা বলে মাঠে টিকে থাকতে চাইবে। ক্ষমতাচ্যুতদের অনুগত একটি গোষ্ঠী আছে। যা আরো ঝড়-ঝঞ্ঝার আশঙ্কাকে অবধারিত করে তুলছে। তার ওপর নতুন নতুন ইস্যুর তোড়ে ডাইভারশনের পথে জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা। ইস্যুগুলো তালবেতালে মাঠে এনে তৈরি করা হচ্ছে ঘোর অস্থিরতা। মানুষ যে মুহূর্তে শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়; বিশেষ করে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ চায়, সে মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোকে চাপ দিয়ে মুচলেকা আদায়ের চেষ্টা প্রকট। একে গণ-অভ্যুত্থানের গতি পাল্টে দেয়ার চক্রান্ত হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা প্রত্যাহার দাবি, আওয়ামী লীগসহ ১১টি দলের রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধে রিট, পরে রিট না চালানোর ঘোষণাকে ভালোভাবে দেখছেন না তারা। এই ভজঘটের সময়টিতে ঢাকায় কর্মব্যস্ত জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুুর্ক। নির্বাচন, মানবাধিকার এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে ঢাকায় তার বেশ কয়েকটি বিশেষ এজেন্ডা। ঢাকা সফরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ছয় থেকে সাতজন উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, সেনাবাহিনী প্রধান, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের প্রতিনিধি এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে মানবাধিকার ইস্যুর মধ্যে জাতিসঙ্ঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের তদন্ত রয়েছে। নিরাপত্তা এবং নির্বাচনপ্রক্রিয়া সংস্কারে জাতিসঙ্ঘের কাছে সহযোগিতা চায় অন্তর্বর্তী সরকার। এমন সময়ে রাজনীতির মাঠে নানা তুলকালাম কাণ্ড। রাজনীতির এ ডামাডোলে দুই হাজার মানুষ নাই হয়ে যাওয়ার বিষয়টি অনেকটা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।

এমন সন্ধিক্ষণে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে স্নায়ু চাপের সংযোগ দেখছেন রাজনীতি-কূটনীতি পাঠপঠনে চৌকসরা। চীন বিতর্কিত সীমান্ত নিয়ে বিরোধের ‘মীমাংসা’ করতে ভারতের সাথে চুক্তি নিশ্চিত করেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়ায় ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দেয়ার সময় বেইজিং চুক্তির জন্য ‘ইতিবাচক অনুমোদনের’ ইঙ্গিত দেয়। এর মধ্য দিয়ে ভারত ও চীন সীমান্ত চুক্তি শত্রুতা কমার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দেশ দু’টির এই চুক্তি বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় এরই মধ্যে সেই প্রভাবের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। চার বছর আগে ভারতের লাদাখে সংঘটিত সংঘর্ষে ভারতের অফিসারসহ বেশ কয়েকজন সেনাসদস্য নিহত হয়। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে থাকলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যস্থতায় চীনের সাথে ভারতের সমঝোতা হয়। এবারে রাশিয়ার মাটিতে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনের সময় ভারত ও চীন সীমান্ত চুক্তি সম্পাদিত হলো।

পুরোনো স্নায়ুযুদ্ধের সময় ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারত মিলে পাকিস্তান ভেঙে ফেলে। বর্তমান স্নায়ুযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে যখন রুশ-ভারত এবং চীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে ছাত্র-জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত করেছে ঠিক তখনই বাংলাদেশকে সহায়তাকারী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এই ত্রয়ী। এর জেরে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আরো বেশি বেড়ে যাচ্ছে এবং এই ত্রিশক্তিকে মোকাবেলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের ওপর সার্বক্ষণিক নিরবচ্ছিন্ন নজর রাখতে হচ্ছে। গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতার পেছনেও এর সংযোগ কিছুটা স্পষ্ট। তা বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে নতুন ব্যবস্থাপনারও ইঙ্গিত। সেটি পুরোনোকে নতুন ধারায় হবে, না নতুনকে পুরোনোর সাথে মিলিয়ে ভিন্ন কোনো ক্যামিস্ট্রিতে হবে- সেই জিজ্ঞাসা ও গুঞ্জন এখন সবখানে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
সিরাজ সিকদার-আবু সাইদ হত্যা একই সূত্রে গাঁথা : রাশেদ প্রধান আন্দোলনে আহত রাতুলকে আর্থিক সহায়তা দিলো বিজিবি গাবতলীতে দিনমজুরকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ বিএসএমএমইউ পরিচালকের পদত্যাগে আলটিমেটাম রাবিতে পোষ্য কোটা বাতিল কবরস্থানে চাঁদাবাজির অভিযোগে বিএনপি নেতা বহিষ্কার ২০২৫ সেশনের জন্য ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমিটি গঠন দিনাজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কচির পদ স্থগিত দুই জেলায় বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত, একটিতে স্থগিত সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়া হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা রোববারের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারতে আটক জেলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শেষ হবে

সকল