২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দেশের চলমান সঙ্কট ও উত্তরণ

- প্রতীকী ছবি

বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে এখন এক অদ্ভুত জটিল সময় যাচ্ছে। যেসব শক্তি বৈপরীত্ব ভুলে সাধারণ লক্ষ্যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটিয়েছিল তাদের মধ্যে অবিশ্বাস ও দূরত্ব বাড়ছে। একই সাথে এক দিকে পতিত রাজনৈতিক শক্তি সংগঠিত হচ্ছে। অন্য দিকে স্বৈরাচারী দুঃশাসনে ব্যাংকের তহবিল পাচার ও লুটপাটের কারণে সরকার চালানোর মতো তহবিল নিঃশেষ হওয়ার মতো দেড় দশকের নানা সঙ্কট সরকারের সামনে। পাশাপাশি নিত্যপণ্যের উৎস কোনো কোনো দেশের সর্বাত্মক বৈরিতাও মোকাবেলা করতে হচ্ছে সরকারকে।

এ অবস্থায় কর্তৃত্ববাদের প্রতিপক্ষ শিবিরের বিভাজন সরকারের ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে, যদিও এখন পর্যন্ত এ সঙ্কট মোকাবেলার মতো অনেক টুলস সরকারের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির রয়েছে। কি এ বিষয় নিয়ে সব পক্ষের উপলব্ধির ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে বলে মনে হয়। যদিও প্রকাশ্যে পক্ষগুলোর শীর্ষপর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা শুধু তাদের ব্যর্থতা নয়, একই সাথে তা আরো কঠিন কর্তৃত্ববাদ ও আধিপত্যবাদের নিগড়ে রাষ্ট্রকে বন্দী করতে পারে।

রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রতি নজর
শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারের নাটকীয় পতন দেশে, এই অঞ্চলে ও ভ‚রাজনৈতিকভাবে এক অসাধারণ মেরুকরণ ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। জুলাই আগস্টের ছাত্র আন্দোলন দেশকে ব্যাপক বিক্ষোভের দিকে নিয়ে যায়। নজিরবিহীন রক্তক্ষয়ী এই আন্দোলন দমনে আরো রক্তক্ষয়ে সামরিক বাহিনী অস্বীকার করায় শেখ হাসিনাকে পালিয়ে যেতে হয়।

অন্তর্বর্তী সরকার গত তিন মাসে অনেক জটিল সমস্যার সমাধানে সক্ষম হলেও নিত্যনতুন সঙ্কট হাজির হচ্ছে। আর দেশের ভেতরের গভীর ক্ষমতা বলয়ের পাশাপাশি বাইরের পর্যবেক্ষকরাও বাংলাদেশের আগামীর গতিপথ বুঝতে গভীর মনোযোগের সাথে ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করছেন।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। বিপ্লবোত্তর রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে একটি নতুন ও ব্যাপকভাবে স্বীকৃত রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরির মতো নৈরাশ্য অথবা আশাবাদী উভয় দৃশ্যপটের দিকে নিয়ে যেতে পারে। হাসিনার শাসনামলকে রাজনীতিবিদরা ‘গণতন্ত্রের মোড়কে কর্তৃত্ববাদী’ হিসেবে উল্লেখ করেন। সে ব্যবস্থার আকস্মিক বিদায়ে সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি উলটপালট অবস্থা দেখা দেয়। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রে তার কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে হিমশিম খাচ্ছে। এখনো পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে পুরোপুরি সক্রিয় করা যায়নি। বেসামরিক প্রশাসনের শীর্ষে যারা আছেন তারা সবাই সরকারের এজেন্ডাকে সমর্থন করেন বলে মনে হয় না, যার ফলে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা দেয়। এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থা, পুলিশ, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ ও সংবিধানসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর সংস্কারের চেষ্টা করছে।

দেশের জন্য ইতিবাচক দিক হলো, এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন-পরবর্তী অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ স্থিতিশীলতার দিক থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে। কোষাগার ফাঁপা এবং রাষ্ট্রের অঙ্গগুলোতে গুরুতর সংস্কারের প্রয়োজন হলেও রাষ্ট্রীয় কাঠামো বহাল রয়েছে। বৃহৎ আকারের আঞ্চলিক বা নৃতাত্তি¡ক বিভাজন না থাকায় রাষ্ট্রের বড় ধরনের ব্যর্থতা এবং প্রান্তিক রাজনৈতিক মেরুকরণের মতো বিষয় সামনে আসেনি। যদিও পার্বত্য অঞ্চলে অস্থিরতার কিছু উপাদান তীব্র হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়ে গেছে। সাবেক স্বৈরাচারের ইন্ধনে চাঙ্গা হওয়া শ্রম অসন্তোষও পুরোপুরি শেষ করা যাচ্ছে না।

তবে দেশ বিদেশের পর্যবেক্ষকদের মূল্যায়ন অনুসারে, বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা সফলভাবে গড়ে তোলার শক্ত উপাদান রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে গুরুতর বিপদের শঙ্কাও। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ হল রাষ্ট্রের মৌলিক কার্যকারিতা, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলার ভাঙন রোধ করা। নিরাপত্তাহীনতা এমন এক বিষয়, যা অনেক সময় গণসহিংসতার উন্মুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। একই সাথে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে হিন্দুবিরোধী এবং ব্লাসফেমি-বিরোধী মনোভাব একসাথে উসকে দেয়ার চেষ্টাও সক্রিয়। এসব কাজে পতিত রাজনৈতিক শক্তির হাত আছে বলেই দেখা যাচ্ছে। কথিত হিন্দু নির্যাতনের প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে পতিত রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষণীয়। পাশাপাশি সোস্যাল মিডিয়ায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে মহানবীর সা: অবমাননা করে তার প্রতিবাদ জানাতে আইএস মার্কা কালো কলেমাখচিত পতাকা নিয়ে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। একই সাথে পশ্চিমের জন্য সংবেদনশীল কিছু ধর্মীয় ইস্যুও অপ্রাসঙ্গিকভাবে সামনে আনা হচ্ছে।

বড় প্রশ্ন সংস্কার ও নির্বাচন
এই সময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক সংস্কার কেমন হবে, কিভাবে এবং কোনো ধারায় তা বাস্তবায়িত হবে। আর কখন কোন পদ্ধতিতে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ঐতিহাসিকভাবে, আগস্ট বিপ্লবের মতো পরিবর্তন নানা উপায়ে ভেঙে পড়তে পারে। আন্তঃদলীয় অচলাবস্থা ও অভিজাতদের ক্ষমতার লড়াই অন্তর্বর্তী শাসনব্যবস্থাকে অচলাবস্থার দিকে চালিত করলে অভ্যুত্থানের আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠতে পারে। বৈশ্বিকভাবে তা গ্রহণযোগ্য না হওয়ার আশঙ্কা এটিকে সাধারণভাবে ঠেকিয়ে রাখে। তবে অচলাবস্থা ও কৌশলগত স্বার্থ সে বিরোধিতাকেও নমনীয় করে ফেলতে পারে। দ্বিতীয় শঙ্কার উৎস হয়ে দাঁড়াতে পারে সরকারের সমর্থন ভিত্তিতে ভাঙন। যে আশঙ্কা সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছেন হোসেন জিল্লুর রহমান।

অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থনের ভিত্তি হলো ৫ আগস্টের বিপ্লব ও এর পক্ষের শক্তি। বৃহত্তর ছাত্রসমাজ ছাড়াও অনেক পক্ষ এ বিপ্লবে ভূমিকা পালন করে। যার মধ্যে ছিল বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত, সিপিবিসহ বাম দলগুলোর একাংশ এবং কর্তৃত্ববাদ বিরোধী সুশীলসমাজের একটি অংশ।

দেশী-বিদেশী যে শক্তি কর্তৃত্ববাদ টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখেছে তারা এখন বিপ্লবের পক্ষের শক্তির মধ্যে বিদ্যমান আদর্শ ও এজেন্ডার বিভাজনকে সামনে নিয়ে আসতে চাইছে বলে মনে হয়। সব রাজনৈতিক পক্ষের এজেন্ডা আগে থেকেই এক নয়। বিএনপির বিশ্বাস যত দ্রæত ভোট হবে সে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন তাদের জন্য তত তাড়াতাড়ি সম্ভব হবে। এ জন্য দলটি অতি জরুরি কিছু সংস্কার শেষ করে দ্রæত নির্বাচন দেয়ার দাবি জানায়। জামায়াত আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে বা তার শরিক হবে এমনটি ভাবে বলে মনে হয় না। জামায়াতের অবস্থান মৌলিক ক্ষেত্রগুলোতে সংস্কার শেষ করে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। হেফাজত অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হলেও এর অন্তর্ভুক্ত শক্তির মধ্যে কওমি ঘরানার অনেক রাজনৈতিক দল রয়েছে। যেকোনো রাজনৈতিক শক্তির প্রতি এর সমর্থন নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। একই ধরনের প্রভাব রয়েছে সিপিবিসহ বাম ধারার অনেক দলের। তবে হেফাজতের শক্তি যেখানে জনগণনির্ভর সেখানে বাম-ধারার শক্তির ভিত্তি রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ও প্রশাসনে তাদের প্রভাবের মধ্যে।

অবিশ্বাসের উৎস কোথায়?
বিপ্লবের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে অবিশ্বাসের ক্ষেত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি বা বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা- ধরনের দৃশ্যমান বক্তব্যের অন্তরালে মৌলিক কিছু বিষয় নিজস্ব পরিমণ্ডলে দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিপ্লবে মূল ভূমিকা পালন করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা মনে করছে, দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনে রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ জন্য সংবিধানসহ রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সংবিধান নতুন করে লিখতে হবে, বিচারব্যবস্থাকে সুবিচারের জন্য কার্যকর করতে হবে, জনপ্রশাসন ও পুলিশ ব্যবস্থায় সংস্কার করতে হবে, দুর্নীতি দমনব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে হবে ইত্যাদি। সরকার এর জন্য ছয়টি কমিশন করে তিন মাসের মধ্যে এর প্রতিবেদন দিতে সময় বেঁধে দিয়েছে।

বিএনপির মধ্যে সন্দেহ হলো, যেসব ক্ষেত্রে কমিশন গঠন ও সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে সেটি বাস্তবায়ন করতে গেলে লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। এর মধ্যে আন্দোলনকারী ছাত্রদের কেউ কেউ নতুন রাজনৈতিক শক্তি তৈরির কথা বলেছে। এতে বিএনপির বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি তৈরিতে সরকারের ভূমিকা থাকবে কি না সে সন্দেহ অনেক বিএনপি নেতার রয়েছে। এজন্য দলটির পক্ষ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানানো হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন। এর আগে সেনাপ্রধান রয়টার্সের সাথে এক সাক্ষাৎকারে ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেন। পরবর্তীতে সম্পূরক ব্যাখ্যায় এটি অন্তর্বর্তী সরকারের টাইম লাইন কি না তাতে সংশয় দেখা দেয়। এ সংশয়ের অবসান ঘটা সম্ভব হতো যদি এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস কোনো ঘোষণা দিতেন। তিনি সংস্কার শেষ করে এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে তার সরকারের বিদায়ের কথা বলেছেন। এই আশ্বাসে বিএনপি আস্থা রাখতে পারছে বলে মনে হয় না। দলটির অন্যতম নেতা সালাউদ্দিন আহমদ সংস্কার শেষ করে ৭ মাসের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার কথা বলেছেন।

আগস্ট বিপ্লবের প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে আস্থার সঙ্কটও দেখা যায়, যা মাঝে মধ্যে রেটরিক পর্যন্ত গড়ায়। দু’টি ভিন্ন ধরনের মতাদর্শের এই দুই দলের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের ঐক্যের ভিত্তি ছিল সাধারণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ঐকমত্য বা সাধারণ স্বার্থ। সেই স্বার্থের বন্ধন এখনো থাকলেও তাদের মধ্যে সামনের পথ চলা ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানালেও জামায়াত প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে কালবিলম্ব না করে নির্বাচন চেয়েছে। আর নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে জামায়াত অন্য অনেক দলের মতো আনুপাতিক নির্বাচন চাইলেও বিএনপি বর্তমান পদ্ধতি বহাল রাখার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রী হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির মন্তব্যে সৃষ্ট বিতর্কে বিএনপি সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের তীব্র বিরোধিতা করেছে। জামায়াত এ বিষয়ে জোরালো কোনো অবস্থান নেয়নি। এতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের অবস্থান আর বিএনপির অবস্থান মুখোমুখি আর জামায়াতের কথাবার্তা মধ্যপন্থী বলে মনে হয়।

বিপ্লবপন্থীদের সঙ্ঘাতে কী হবে?
বিপ্লবপন্থীদের বিরোধে সরকার ভেঙে পড়লে দু’টি ঘটনা ঘটতে পারে। এর একটি হলো অন্তর্বর্তী সরকার ভেঙে গিয়ে সামরিক নিয়ন্ত্রিত সরকার ক্ষমতায় আসতে পারে। সেটি ঘটলে ইউনূস সরকারের সময় যে সংস্কার বা সময়ের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য বিলম্বিত হবে। আর কর্তৃত্ববাদীরা আবার ঘুরে দাঁড়ানোর পরিবেশ পেতে পারে। চাপে পড়তে পারে বিপ্লবের পক্ষের শক্তি।

কোনো কারণে বাইরের প্রভাবশালী শক্তির সমর্থনপুষ্ট হয়ে পতিত সরকার যদি ক্ষমতা গ্রহণের প্রচেষ্টায় সাফল্য পায় তাহলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও গতিপথেই অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। বাইরের সামরিক হস্তক্ষেপে গৃহযুদ্ধের অবস্থাও তৈরি হতে পারে। আমেরিকান থিংক ট্যাংক কার্নেগি ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ বিষয়ক এক প্রতিবেদনে ক’দিন আগে এমন আশঙ্কার ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে। এ সময় এমন এক স্বৈরাচার ক্ষমতা দখল করতে পারে যাকে প্রতিবিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এই বিপদের মুখে, সেনাবাহিনীর সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অংশীদারিত্বের বর্তমান রাজনৈতিক শক্তির কনফিগারেশনের স্বচ্ছ লক্ষ্য ও সময়সীমার স্পষ্ট ঘোষণা দরকার।

মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব ছিল হাসিনার সরকারের প্রতি গণঅসন্তোষের মূল উৎস। যদিও হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের ত্যাগ ও সাফল্য অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রাথমিক বৈধতা দিয়েছে, তবে যত বেশি সময় সরকার ক্ষমতায় থাকবে, তত বেশি অর্থনৈতিক সুবিধা ও রাজনৈতিক অগ্রগতি দেখাতে হবে।

কার্নেগি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদক পল স্ট্যানিল্যান্ডের মতে, ‘যদি রাজনৈতিক স্থবিরতার অনুভ‚তি দিয়ে এগিয়ে চলার প্রমাণ প্রতিস্থাপিত হয়, তাহলে সরকারকে নির্বাচনের উপযুক্ত সময় ও কাঠামো নিয়ে নাগরিকদের কাছ থেকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হবে। রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো গণতান্ত্রিকভাবে কতটা বৈধ এবং কিভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা বণ্টন করা উচিত সে সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে পারে। যেমন আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের প্রতিদ্ব›দ্বী বিএনপি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চেয়ে নির্বাচনের জন্য একটি ভিন্ন সময়রেখা প্রকাশ করেছে। এটি নির্বাচনের সঠিক সময় নিয়ে পরিস্থিতিকে সঙ্ঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে। একইভাবে, ভবিষ্যতের নির্বাচনে হাসিনার আওয়ামী লীগের অবস্থান এবং অধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের কিভাবে শাস্তি দেয়া যায় তা বিতর্ক ও মতবিরোধের বিষয় হয়ে উঠতে পারে। একটি নতুন এবং কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের উপায়গুলো কিভাবে আটকে যেতে পারে সেদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে মনোযোগী হতে হবে।’

জটিল বৈদেশিক নীতি
জটিল বৈদেশিক নীতি ঢাকার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। হাসিনার সরকারের পতনের কারণে ভারত হতাশ হয়েছিল এবং ভারতে অনেকেই হিন্দুবিরোধী সহিংসতা এবং বাংলাদেশী রাষ্ট্র ও সমাজের ‘বৃহত্তর ইসলামীকরণের সম্ভাবনা’ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। অন্য দিকে অনেক বাংলাদেশী ভারতকে হাসিনা শাসন ও তার অপব্যবহারের নিঃশর্ত সমর্থক হিসেবে দেখেন। আর মানবাধিকার ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা সম্পর্কে ভারতীয় বক্তৃতা শোনার মুডেও নেই তারা।


পল স্ট্যানিল্যান্ডের পর্যবেক্ষণ মতে, ‘ভারত দেরিতে পররাষ্ট্রনীতির ভুল পদক্ষেপ থেকে নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে, তবে হাসিনার সাথে এর গভীর সম্পর্ক (পাশাপাশি তার বর্তমান, এমনকি অস্থায়ী হলেও, ভারতে বসবাস) দ্রুত ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে নতুন পথ তৈরি করা কঠিন করে তোলে। বিপরীতে, বাংলাদেশ ভারতকে বিচ্ছিন্ন করার সামর্থ্য রাখে না; এর নিছক আকার ও নৈকট্য এটিকে এমন সুবিধা প্রদান করে যে চীন ও পশ্চিমের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকার ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি স্থিতিশীল নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার আশা করছে, যা হাসিনার শাসনামলে হয়নি।

ভূরাজনৈতিক খেলা
মিয়ানমারে ক্রমবর্ধমান গৃহযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে অস্বাভাবিক মাত্রার সঙ্ঘাত মোকাবেলাও বাংলাদেশকে করতে হবে। শরণার্থী প্রবাহ এবং রাখাইনের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণকারী আরাকান আর্মি উভয়ই ঢাকার জন্য রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। ইরাবতীর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুসারে, রাখাইনের ঘাঁটিতে ৪০০ কিলোমিটারের অধিক পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে এসেছে মিয়ানমার জান্তা। আরাকান আর্মি দমনের জন্য এটি আনা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। এই ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার মধ্যে বাংলাদেশের অধিকাংশ সেনানিবাস পড়বে। সর্বশেষ এই ঘটনার সাথে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্পর্ক থাকতে পারে।

বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক বিষয়গুলোও খেলার মধ্যে রয়েছে। কার্নেগির প্রতিবেদন মতে, হাসিনা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ২০২৪ সালের নির্বাচন এবং এর পরবর্তী সময়ে কৌশলগত মূল্যায়নে মতানৈক্য প্রকাশ পায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হাসিনার শাসনের পতনকে প্রমাণ হিসেবে দেখে যে তার শাসনের অন্তর্নিহিত অস্থিরতা এবং দমন-পীড়নের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতাকে নেতিবাচকভাবে চিহ্নিত করা সঠিক ছিল। ভারতে কেউ কেউ অবশ্য তার পতনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিদেশী হাত’ দেখেন।

আমেরিকার দৃষ্টিকোণ থেকে, ড. ইউনূস ও অন্তর্বর্তী সরকারকে গণতন্ত্র পুনর্গঠনে সহায়তা করা এবং চীনকে উপসাগরে রাখা একটি প্রধান অগ্রাধিকার। ভারতে অনেকেই এই পদ্ধতিটিকে ইসলামবাদী প্রভাবের জন্য একটি বিপজ্জনকভাবে সুযোগ প্রদান বা এই অঞ্চলে ভারতীয় প্রভাব সীমিত করার একটি ধূর্ত কৌশল হিসেবে দেখেন।

বাংলাদেশে চীনের প্রভাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই উদ্বিগ্ন। হাসিনা বেইজিংয়ের সাথে দৃঢ় সম্পর্কের সাথে নয়াদিল্লির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ভারসাম্যপূর্ণ করেছিলেন। কিন্তু চীন নতুন শাসন পরিবর্তনের সাথে নমনীয়ভাবে খাপখাইয়ে নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশে সুশাসন ও কার্যকরী গণতন্ত্রের অগ্রগতি, আদর্শভাবে তুলনামূলক ধর্মনিরপেক্ষ ও পশ্চিমাপন্থী রাজনৈতিক শক্তির শাসনের অধীনে রাখা চীনা প্রভাব রোধ করার সর্বোত্তম উপায় হিসেবে দেখা হয়। তবুও ওয়াশিংটনের জন্য এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে ঢাকা আমেরিকার চীন নিয়ন্ত্রণ কৌশলের অংশ হতে কমই আগ্রহ দেখিয়েছে। কারণ অন্তর্বর্তী সরকার তাদের স্বল্প পরিসর সময়ে বাংলাদেশ সঙ্ঘাতের কেন্দ্রভূমি হোক সেটি সম্ভবত চাইছে না।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement