সাংস্কৃতিক চেতনাবোধ, প্রসঙ্গ ছাত্র গণবিপ্লব
- অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
- ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১৯:২২
নির্দিষ্ট জাতি বা জনগোষ্ঠীর জীবনদর্শন, জীবনবোধ ও বিশ্বাসের রূপই তার সাংস্কৃতিক প্রকাশ। জীবনবোধ বা জীবন দর্শনের প্রকারভেদে সাংস্কৃতিক রূপেরও তারতম্য ঘটে। তার সাহিত্যে, দর্শনে, দৈনন্দিন জীবনের পরিমণ্ডলে ব্যবহৃত শব্দমালা বা উচ্চারণেও ঘটে তার প্রকাশ। মুসলিম জীবনবোধে ইন্তেকাল শব্দটি যেমন স্বাতন্ত্র্য বহন করে তেমনি মারা গেছেন বা পরলোক গমন করেছেন শব্দগুলো সমার্থ্যবোধক হলেও বিশ্বাসবোধের, জীবন দর্শনের পার্থক্য কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই প্রতিভাত হয়। তেমনি নামাজ বা ইবাদত এবং উপাসনা শব্দগুচ্ছ সমার্থ্যবোধক হলেও জীবন দর্শনের ভিন্নতা প্রকাশ করে। সিয়াম বা রোজা এবং উপবাস একই ধরনের অর্থ প্রকাশ করলেও ভিন্ন সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিচায়কও।
যে জাতি জীবনবোধে জবাবদিহিতায় যত বেশি বিশ্বাসী, সেই জাতি বা জনগোষ্ঠী তত বেশি মানবিক মূল্যবোধে আলোকিত, তত বেশি কল্যাণমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দাবিদার। ১৭৫৭ সালের পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার নির্মম পরিণতি সূচনা ঘটায় এই উপমহাদেশের মুসলিম সাহিত্য ও সংস্কৃতির অধোগতি ঘটে। সমাজের সর্বস্তরে ব্যবহৃত ফার্সি ভাষা মুহূর্তে রাজ ভাষা হওয়ার মর্যাদা হারিয়ে ফেলায় মুসলিম সম্প্রদায় তাদের সমাজজীবনের গৌরবময় সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক স্বতন্ত্র ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগ তাদের সেই সুযোগ এনে দিলেও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অনৈক্য ও ভাষার সঙ্ঘাতের কবলে পড়ে তা হারিয়ে ফেলে।
১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বাংলাদেশের অভ্যুদয় বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীকে আবারো নিজ বিশ্বাসবোধের আলোকে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টির সুযোগ এনে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন বিপরীত জীবন দর্শনের অধিকারীদের দখলে থাকায় এই প্রয়াস কঠিন হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ৬৬ বছর পূর্বে রচিত রবীন্দ্র সঙ্গীত বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মনোনীত করার মাধ্যমে যার সূচনা। যে সঙ্গীতে এ দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণের জীবন আদর্শ, জীবন বোধ ও যাপিত জীবনের কোনো প্রতিফলন নেই। রয়েছে বিপরীত জীবনাদর্শের প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের কল্পনাও যেখানে নেই।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অনেক আগে থেকেই এ দেশের সাংস্কৃতিক আদর্শ ও জীবনাচারকে, জীবন দর্শনকে বিচ্যুত করার যে প্রয়াস ৪৭ এর দেশ বিভাগের পর পরই শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয় তাকে আরো বেগবান করে তোলে। সাহিত্যে অনুপ্রবেশ ঘটে জীবন দর্শনবিরোধী শব্দমালা, বিতাড়িত হতে থাকেন মুসলিম রেনেসাঁর পথিকৃত সাহিত্যিকেরা। এভাবেই বাংলা সাহিত্য থেকে ক্রমেই হারিয়ে যেতে থাকেন কবি কায়কোবাদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মীর মশাররফ হোসেন, শাহেদ আলী, ফররুখ আহমেদ, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, গোলাম মোস্তফার মতো জীবনবোধে বিশ্বাসীরা। এমনকি নজরুলকেও করা হয় কোণঠাসা।
এ দেশের সঙ্গীতেও একই ধারা। সিনেমা নাটক সর্বত্রই এই অবস্থা। ইসলামী জীবনাদর্শে বিশ্বাসীরা চিত্রিত হন জঙ্গি এবং সন্ত্রাসী হিসেবে। কৌশলী একদল বুদ্ধিজীবীদের প্রাধান্য সমগ্র সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতকে ঐতিহ্য বিচ্যুত করার আয়োজনকে পূর্ণতা দান করে। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বাংলা অভিধান দেখলেই এর প্রমাণ মিলে। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, বাংলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দায়মুক্ত হতে পারে না। গত ২৫ বছরে এ কাজগুলো হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
বাংলা একাডেমির ইতিহাস, বাংলা ভাষা আন্দোলন, ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলার ইতিহাসের বিকৃতিকরণের কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। মুসলিম জীবনধারায় মুর্দাকে গোসলের পর জানাজা শেষে দাফন করার রেওয়াজ থাকলেও তা ‘আগুনের পরশমণি জ্বালাও প্রাণে’ রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে প্রদীপ প্রজ্বলন করে মৃত ব্যক্তিকে সম্মানিত করার রেওয়াজও চালু করা হয়েছে। এ কাজের পুরো ভাগে রয়েছে একটি বিশেষ সংস্কৃতি গোষ্ঠী। যারা গত ১৮ বছরে সরকারি আনুক‚ল্য পেয়েছেন, এ দেশের পরকালীন বিশ্বাসবোধে সঞ্জীবিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর থেকে আহরিত করের টাকায়।
৫ আগস্টের ছাত্র বিপ্লবের পরেও তাদের কর্মকাণ্ড অপ্রতিহত গতিতে চলতে পারাটা এই বিপ্লব বিশ্বাসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা কি না তা ভেবে দেখার অবকাশ অবশ্যই রয়েছে। এখনো এ দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে জীবন বিশ্বাসের বিপরীত নাটক এবং সিনেমা অবাধে চলছে। চলছে বিদেশী পণ্যের বিজ্ঞাপন। এ দেশের ঘরে ঘরে আজ বিদেশী টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর প্রদর্শনী; যা আমাদের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর জীবন দর্শনের বিপরীত, যা দেশপ্রেম জাগায় না, জাগায় না সৌভ্রাতৃত্ব। পরিবর্তে ষড়যন্ত্র, কূটনীতি, ভাঁড়ামো শেখায়। দেশীয় টিভি চ্যানেল ভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানমালা দিয়ে সাজানো। এই অনুষ্ঠানমালা তরুণ প্রজন্মকে পরিবার বিমুখ করে তুলছে। শালীনতাবিরোধী ও অপরাধমুখী করে তুলছে।
কোনো জাতির পরিচিত রূপের প্রকাশ তার সাহিত্য ও সংস্কৃতি। আমাদের দেশে আমাদের জীবনাচার এবং জীবনবোধ আজ বিপন্ন। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সংস্কারও আজ জরুরি। নতুবা এই ছাত্রবিপ্লব পথ হারিয়ে ফেলবে। এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের দায় সবচেয়ে বেশি। বাংলা একাডেমি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রতিনিধি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে সংস্কারের কাজ শুরু করা যেতে পারে। অবশ্য সদস্য নির্বাচনে এ দেশের একক জাতিসত্তা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবনবোধের প্রতি বিশ্বাসীদের প্রাধান্য থাকা দরকার। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না জাতির সংস্কৃতিক চেতনাবোধ জাতির প্রাণ।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
ই-মেল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা