২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

দোলন এখন ধলপুরে

- প্রতীকী ছবি

দিনের বেলায় যেসব শিশু-কিশোর জুমার ঘরের একাংশ দখল করে নামাজ আদায় করেছিল রাতের বেলায় তাদের অনেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট বারের ল’ ইয়ার্স মেডিটেশন সোসাইটির আমন্ত্রণে শ’ দেড়েক আইনজীবী ছিন্নমূল পাহাড়ি শিশুদের কৃতিত্বসহ পাহাড় ও ঝরনা দেখতে গিয়েছিলাম। স্থান খাগড়াছড়ির লামা। যে শিশুরা একসময় পথে পথে ঘুরে বেড়াত, যাদের মা নেই বাবা নেই, কিংবা থাকলেও ভার্চুয়াল ভাইরাসের আঘাতে বিচ্ছিন্ন তাদের পরিবার; অসহায় বঞ্চিত সেসব শিশুকে নিয়ে মেডিটেশন সোসাইটি কাজ করে। কিছু দিন আগেও যারা জানত না কিভাবে জুতা পরতে হয়, দাঁত ব্রাশ করতে হয়, টয়লেট ব্যবহার করতে হয়, জুমচাষ বা মজুর খেটে তাদের জীবন কেটে যেত।

দিনে ঝরনা দেখার পালা। ঝরনার উৎপত্তি কোথায় সঠিকভাবে কেউ বলতে পারে না। যে খাদ বেয়ে পানি নামছে সে খাদে পানির গভীরতা এক-দেড় ফুট। উজান পানি ঠেলে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। পায়ের তলায় মোটা বালু ও ধারাল পাথরের কণা। তাই একপ্রকার রাবারের সেন্ডেল পায়ে পরে হাঁটতে হয়। কিছুক্ষণ হেঁটে সবার পেছনে পড়ে যাই। পাশে একটি বাড়িতে উঠি। বাড়ির উঠানে একটি চৌকি। বাঁশ আর রশি দিয়ে বানানো চৌকিতে কয়টা শিশু শুয়ে বসে আরাম করছিল। আরাম করতে মন চাচ্ছে আমারও। কাছেই শিশুকোলে এক মধ্যবয়সী মহিলা। মহিলার অনুমতি নিয়ে আসনে বসে পড়ি। বাঙালি পরিবার। সমতল ভূমি থেকে সরকার এনে এখানে ঠাঁই দিয়েছে। আমাদের গাঁয়ের সোনামিয়া চাচা, জয়নব আলী ও কালাই দাদাও চলে এসেছিল এই পাহাড়ে। সমতল ভূমি থেকে আগতদের বলা হয়, ‘সেটেলার’। সেটেলারের পরিভাষা শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থী। ‘আশ্রয়প্রার্থী’ শব্দটি শুনতে খারাপ লাগে। এ বিষয়ে মেজর জেনারেল (অব:) আ ল ম ফজলুল হকের লেখা থেকে জানা যায়, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা ৫০০ বছর ধরে বসবাস করছেন। ১৬০০ সালে দূর এবং নিকটের অনেক অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনের সূচনা করে। মুঘল আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম দিল্লি থেকে শাসিত হয়। ইংরেজ শাসনের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্রিটিশ শাসনে আসে। ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অধীনে আসে। ওই এলাকা ১৯৬০ সালে স্বতন্ত্র জেলায় মর্যাদা পায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পরে পূর্বপাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অঙ্গীভ‚ত হয়। পাহাড়িরা বাঙালিদের সেটেলার আখ্যাসহ এ এলাকা সম্পূর্ণরূপে নিজের দাবি করে। শুধু তা-ই নয়, নিজের এলাকা নিজেরা শাসন-নিয়ন্ত্রণ করতে ১৯৭৫ সালে শান্তিবাহিনী গঠন করে। শান্তিবাহিনী ১৯৭৭ সালের দিকে সামরিক দিক থেকে সংগঠিত হওয়াসহ সদস্য বাড়াতে থাকে। এমনও অভিযোগ রয়েছে, শান্তিবাহিনী ভারতের ত্রিপুরায় ঘাঁটি স্থাপন করে সেখান থেকে অভিযান পরিচালনা করে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি সাজোয়া বহরের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ হামলার পর সেনাবাহিনী ওই অঞ্চলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামকে ২৪তম ডিভিশনের জিওসির অধীনে এনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। ১৯৭৯ সালে সরকার ওই অঞ্চলে বাঙালি বসতি স্থাপনে এক কর্মসূচি নেয়। ওই কর্মসূচি ছিল পার্বত্য জনগণের মালিকানাবিহীন ভূমিকে খাসভূমি ঘোষণা করে বাঙালি বসতি স্থাপন করা।

১৯৭৯ সালে বাড়ি ও জমির মালিক হওয়ার স্বপ্নে আমাদের গাঁয়ের তিন পরিবার চলে গিয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। সোনামিয়া চাচা আমাদের পড়শি। চাচার বড় মেয়ের নাম দোলন। চাচীর ছিল টানাটানা চোখ, মায়াভরা মুখ, দীঘল চুল, লম্বা গড়ন ও একহারা চেহারা। দোলন ছিল ঠিক চাচীর কার্বনকপি। আমার মায়ের মতো চাচীও ছিলেন গরিব ঘরের মেয়ে। চাচী অবসর পেলে চলে আসতেন আমার মায়ের কাছে। নানা কাজে মাকে সাহায্য করতেন। এক কথায় মায়ের সাথে চাচীর গলায় গলায় ভাব। পার্বত্য চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় দু’জন গলাগলি করে সেকি কান্না। আমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট দোলন। মা ও চাচীর কান্নার সময় পাশে দাঁড়ানো ছিল দোলন। দোলনকে লক্ষ করে মা চাচীকে বলেছিলেন, ‘মেয়েটাকে-ই এ দেশে বিয়ে দিয়ে রেখে যা, এমন মেয়ে নিয়ে কেউ দূর দেশে পাড়ি দেয়?’ উত্তরে, ‘কী যে বলেন বুবু, ‘জন্ম-মৃত্যু বিয়ে’ কারো ইচ্ছেয় হয় কখনো? আল্লাহ কী মানুষের সব ইচ্ছা পূরণ করেন? (বলে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন)’

এরপর সোনামিয়া চাচা বার দুয়েক আসা-যাওয়া করলেও অন্য কেউ আসেননি। চাচার কাছে শুনতাম, পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির পেছনে কয়েকটি কারণের মধ্যে একটি শান্তিবাহিনী। যখন-তখন এসে হানা দেয়। তাই শান্তিবাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে আমরা সমিতি করে সারারাত মহল্লা পাহারা দেই।’

খাগড়াছড়ি থেকে আসার পর ভুলে গিয়েছিলাম দোলনদের কথা। ৫ আগস্টের পর থেকে নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পার্বত্য এলাকা। জানতে পারি, টানা ৭২ ঘণ্টা অবরোধে হেলিকপ্টারে সাজেক ছাড়েন পর্যটক। ইউপিডিএফের ডাকা ৭২ ঘণ্টা অবরোধে সাজেকে আটকা পড়েছেন দেড় হাজার পর্যটক। এ সংবাদ শোনার পর অজ্ঞাত কারণে মনে পড়ে দোলনের কথা। জীবনসায়াহ্নে এসে দোলনকে মনে পড়াটা ঠিক কাদম্বরীকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সে যে কারণে মনে করেছিলেন সে কারণেও হতে পারে। মৃত্যুর ছয় বছর আগে ১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ চন্দননগর। কবির পাশে বানীচন্দ। এখানেই তো ২৩ বছর বয়সে তার নতুন বৌঠান কাদম্বরীর সাথে কাটিয়েছিলেন দীর্ঘ ছুটি। বৃদ্ধ বয়সে যেন কাদম্বরীর খোঁজেই সর্বশেষ বারের মতো চন্দননগর ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ। বললেন বানীচন্দকে, ‘মনে পড়ে আমার নতুন বৌঠানকে।... নতুন বৌঠান চলে গেল কী বেদনা বাজল বুকে। কোথায় তুমি নতুন বৌঠান? একবার এসে আমায় দেখা দাও। কত দিন এমন হয়েছে ... সারারাত এভাবেই কেটেছে।’

রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরীর আত্মাকে খুঁজেছিলেন ভারতবর্ষজুড়ে। আর আমি খুঁজছি জীবন্ত একজন মানুষকে পার্বত্য এলাকাজুড়ে। তখন ছিল সনাতন পদ্ধতি আর এখন তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের যুগ। সুখের সন্ধানে মাতৃভ‚মি ত্যাগ করে আপনজন ছেড়ে বেলি ফুলের মতো যে দোলন দৃষ্টির আঁড়াল হয়ে গেল সে দোলন দুনিয়াতে আছে কি নেই তাও জানি না।

অবশেষে ফোন নম্বর পাই দোলনের ছোটভাই বাবুলের। বাবুলের কাছ থেকে ফোন নম্বর পাই দোলনেরও। বাবুলের কাছে ফোন করে জানতে পারি, ১৯৭৯ সালে তারা উঠেছিল রাঙ্গামাটি জেলার ডালিয়া পাড়া ইউনিয়নে। সরকার থেকে দুই একর ভ‚মিও পেয়েছিল। ২৫ শতাংশ বাড়ি অবশিষ্ট ডোবা জমি। বাবুলের সাত ছেলে তিন মেয়ে। এখন অনেকে ঢাকায় থাকে। মাটির ঘরে সৌরবিদ্যুৎ। সরকার থেকে রেশন পায়। আমাদের গাঁয়ের অপর দুই পরিবারও জমির দখল পেয়েছিল কাগজ পায়নি। পাহাড়িদের ভয়ে জমির দখল ছেড়ে বাঙালিরা এক এলাকায়। চাচা মারা গেছেন বছর বিশেক হয়, চাচী মারা গেছেন বছর তিনেক আগে। অপর দুই পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইলে জানতে পারি, জয়নবালী এখানে এসে আরো একটি বিয়ে করেছিলেন। জয়নবালীর মাটির ঘরে আগুন লেগেছিল। মশারিসহ পুড়ে গিয়েছিল জয়নবালীর শরীর।

হাসপাতালে মারা যান। প্রথম বউ-সন্তানসহ গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। এখন ঢাকায়। ফোনে কথা হয়েছিল দোলনের সাথেও। আমূল বদলে গেছে কণ্ঠস্বর। বিয়ে হয়েছিল। তিন ছেলে ও এক মেয়ে জন্মের পর ক্যান্সারে স্বামীর মৃত্যু হয়। চার সন্তান নাবালক। সন্তানদের মা-বাবার কাছে রেখে ঢাকা আসে দোলন। গার্মেন্টে কাজ করে। চার ছেলেমেয়ের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত গার্মেন্টে কাজ করেছিল। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে সংসারী হয়েছে। এক ছেলে বাদে সবাই ঢাকায়। বড় ছেলের সাথে দোলন এখন ধলপুরে।

সম্পূর্ণ নিখোঁজ কালাই দাদার পরিবার। তারা ডালিয়া পাড়া থাকেন না। কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কেউ বলতেও পারেন না। গাঁয়ের সরকার বাড়ির পশ্চিম দিকে তাদের একটি ঘর ছিল। পূর্ব-পশ্চিম লম্বালম্বি মুলির বেড়া টিনের দোচালা ঘর। ঘরটি ছিল সরকার চাচার বাড়ির এককোণে। সরকার চাচা তাকে চাচা ডাকতেন, আমি ডাকতাম দাদা। একহারা লম্বা কালো চেহারা। সরকার বাড়িতে আমার বয়সী অনেক মেয়ে ছিল। উঠানে খেলা করত। শৈশবে গেলে আমাকে ডেকে কাছে নিয়ে যেতেন দাদা। জোর করে বুকে চেপে ধরে উঠানের দিকে আঙুল তুলে, ‘বল তুই কোনটা বিয়ে করবি?

নিশ্চয়ই বেঁচে নেই দাদা। ৫০ বছর পরও আমার কাছে একই রকম রয়ে গেছেন কালাই দাদা। গ্রাম থেকেও মুছে গেছে কালাই দাদার নামনিশানা। পাহাড়িদের উন্নতি আর বাঙালিদের অবনতি দেখে মনে হলো, বাঙালিরা যেন শহর ছেড়ে কহরে আর পাহাড়িরা যেন কহর ছেড়ে শহরে আশ্রয় পেয়েছে। পায়ের নিচে একখণ্ড মাটির আশায় সুখের সন্ধানে পাহাড়ে গিয়ে কত বাঙালি হারিয়ে গেছে কে জানে? আমাদের মন থেকেও হারিয়ে গেছে তিন পরিবার। তিন পরিবারের কথা মনে করতে মনে পড়ে শেখ সাদীর উক্তি- ‘মানুষ এমনভাবে জীবনযাপন করে যেন কখনো মরবে না, আবার এমনভাবে মরে যেন কখনো বেঁচে ছিল না।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
বক্তৃতায় খালেদা জিয়াকে স্বাগত ও ধন্যবাদ জানালেন ড. ইউনূস আদানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতারি পরোয়ানা আ’লীগের সাবেক এমপি শাহজাহান ওমর কারাগারে কাঁঠালিয়ায় শাহজাহান ওমরের গ্রেফতারে বিএনপির আনন্দ মিছিল ইউক্রেন রাশিয়া ইউকে স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে সেনাকুঞ্জে হাস্যোজ্জ্বল খালেদা জিয়া ও ড. ইউনূসের কুশল বিনিময় পারমাণবিক বোমা বিষয়ে ইরানের অসহযোগিতার অভিযোগ পশ্চিমা বিশ্বের, আইএইএ’র ভিন্নমত ‘সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে ছাত্রদল’ ধামরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ শ্রমিক নিহতের প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ আন্দোলনে সাধারণের পক্ষে দাঁড়িয়ে আস্থার প্রতীক হয়েছে সেনাবাহিনী : ড. ইউনূস ব্রিটেনের সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী প্রেসকট মারা গেছেন

সকল