২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বিপ্লবোত্তর জাতীয় ঐকমত্যের সঙ্কট

-

একটি জাতির রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐকমত্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেতাদুরস্ত ভাষায় বলা যায়- ‘জাতি গঠন প্রক্রিয়া’ জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় ‘জাতীয় ঐকমত্য’ হচ্ছে একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Myron weiner জাতীয় ঐকমত্যের ধারণাকে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির সাথে এক করে দেখেছেন। জাতীয়তাবোধ, কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ শাসক-শাসিতের নৈকট্য ইত্যাদি প্রাতিষ্ঠানিক সফলতার ফসল হচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য। International Encyclopedia of social sciences-এ জাতীয় ঐকমত্য ব্যাখ্যাত হয়েছে এভাবে : সাধারণভাবে সমাজের রাজনৈতিক সচেতন অংশ যখন জাতীয় জীবনের সম্পদ, অধিকার, মর্যাদা ও কর্তৃত্বের বণ্টন নিয়ে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ও সচেতনভাবে কোনো রকম হুমকি, বাধা বা বল প্রয়োগ ছাড়াই একমত হন তাকেই জাতীয় ঐকমত্য বলা যায়। De Toqueville তার প্রদত্ত সংজ্ঞায় একই ধরনের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, যখন বহুসংখ্যক মানুষ, ব্যাপকসংখ্যক বিষয়ে আমলে নেয় বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়গুলোতে তারা একমতে উপনীত হয়। এভাবেই অর্জিত হয় জাতীয় ঐক্য ও সংহতি।

এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমঝোতাকে জাতীয় ঐকমত্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য বা জাতীয় ঐক্য ও সংহতি কখনোই জনবিচ্ছিন্ন কৃত্রিম অংশের মতামত নয়, তা যতই জোরালো অথবা তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন। প্রকৃত ঐকমত্য হচ্ছে বৃহত্তম সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার সাধারণ প্রকাশ। জাতীয় ঐকমত্যকে কোনো কোনো লেখক General agreement in thought and feeling বলেও বর্ণনা করেছেন। Glond and kohl জাতীয় ঐকমত্যকে order and disorder-এর সাথে তুলনা করেছেন। J. S. Mill জাতীয় ঐকমত্যের সপক্ষে বলেন : something permanent, not to be called in question. পাশ্চাত্যের উন্নত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় J. S. Mill-এর এই ধারণার বাস্তব প্রতিফল লক্ষ করা যায়। যেমন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে মৌলিক জাতীয় আদর্শ, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও বিষয়ে রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে ঐকমত্য লক্ষ করা যায়। এসব দেশে রাজা যায় রাজা আসে, নীতির পরিবর্তন ঘটে না। শত শত বছর ধরে অনুসৃত হওয়ার কারণে মৌলিক বিষয়াবলি প্রাতিষ্ঠানিকতা (Institutionalized) করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সম্পর্কে ভিন্নতর পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উল্লিখিত বৈশিষ্টাবলির বিপরীত চিত্র লক্ষ করা যায়। অথচ নিপাতনে সিদ্ধ ঘটনার মতো জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর বলিষ্ঠ ভূমিকা লক্ষ করা যায়। অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এর জন্য ‘নেতাদের ঐক্য’-এর চেয়ে ‘জনতার ঐক্য’কে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭১, ১৯৯০ ও ২০২৪ সালের গণবিপ্লবে এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। দুর্ভাগ্যের বিষয়- প্রতিটি ঘটনা অবশেষে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার ইতিহাস প্রকট হয়ে ওঠে। সাধারণ সময় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসাধারণ দ্বন্দ্ব, বিতর্ক, বিদ্বেষ এমনকি শত্রুতার আচরণ লক্ষ করা যায়। এসব নেতিবাচক কার্যক্রম জনসাধারণকে বিভক্ত করে। বিচলিত করে। মিত্রতার পরিবর্তে শত্রুতার সৃষ্টি করে। ১৯৯০ সালের পর যেভাবে বাংলাদেশে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা (Bi-party system) বিকশিত হচ্ছিল, তাতে আশান্বিত হয়েছিল গণতান্ত্রিক বিশ্ব। কিন্তু আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী ভূমিকায় তা নস্যাৎ হয়ে যায়। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সম্মতির পরিবর্তে শক্তি প্রয়োগ করে জনগণের ভোটাধিকারকে পদদলিত করে। এই অন্যায় ও অপকর্মের ফলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্থায়ী রাজনৈতিক সঙ্কট এবং অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশেষত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিতন্ত্রে পরিণত হয়। প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্র জেঁকে বসে। কোনো কোনো রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক একে হাসিনোক্র্যাসি বলে অভিহিত করেন। বলা বাহুল্য, এতে রাজনৈতিক ঐকমত্যের পরিবর্তে ‘এক নেতা এক দেশ’ দৃষ্টিভঙ্গির প্রবণতা ও প্রতিষ্ঠা লক্ষ করা যায়। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কার্যত নাগরিক অধিকার বিলুপ্ত থাকে। ব্যক্তিস্বাধীনতা বিপন্ন হয়। সমাবেশের স্বাধীনতা পরিত্যক্ত হয়। ভিন্নমত পোষণের স্বাধীনতা রহিত হয়। এমনকি হাসিনোক্র্যাসির বদৌলতে দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অবসান ঘটে। প্রশংসা ও প্রশস্তি রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশীদার হয়ে দাঁড়ায়। নাগরিকদের মৌলিক স্বাধীনতা এভাবে অবসান হওয়ায় রাজপথে আন্দোলন ক্রমেই প্রবল হয়ে ওঠে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সঙ্ঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে গৃহীত বোগাস নির্বাচনে বিরোধীদলীয় আনুষ্ঠানিকতারও অবসান ঘটে। পাতানো নির্বাচনগুলোতে পাতানো বিরোধী দল তথাকথিত বিরোধী দলের অভিনয় করে। যে সিভিল সোসাইটিকে এ ধরনের স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় আশার আলো বলে কল্পনা করা হয় তারও বিনাশ ঘটে। এ জন্য একদল বিবেকহীন বুদ্ধিজীবী নির্লজ্জভাবে স্বৈরাচারকে একাডেমিক তথা বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন দেয়। এ সময়ে রাজনৈতিক গবেষণাও বিপথগ্রস্ত হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক ঐকমত্য সম্পর্কে আলোচনার ও গবেষণার বন্ধ্যাত্ব পরিলক্ষিত হয়।

বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র নতুন করে এক ইতিহাস গড়েছে। সুদীর্ঘ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অবশেষে ছাত্র-জনতার বিপ্লব সফল হয়েছে। বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিতন্ত্রের প্রতীক শেখ হাসিনা, প্রতিবেশী দেশে পলায়ন করেছে। পলায়নের আগে নিজের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য তিনি গণহত্যায় মেতে ওঠেন। সমসাময়িক পৃথিবীর ইতিহাসে এ ঘটনা বিরল যে, জনগণের রক্তনদী অতিক্রম করেও তিনি ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছেন। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শহীদের সংখ্যা এক হাজার ৪২৩ জন। আহত ২২ হাজার। আন্দোলন বিপ্লব অবশেষে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। নোবেলজয়ী একমাত্র বাংলাদেশী, আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্র-জনতার অনুরোধে অস্থায়ী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের মানুষ মুক্তির আনন্দে একে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে অভিহিত করে। বিপ্লব অবশেষে দেখা যায়, রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত, অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত, সামাজিকভাবে বিতর্কিত ও সাংস্কৃতিকভাবে বিকৃত একটি রাষ্ট্রকাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের মানুষ। তাদের এই গৌরবময় বিজয়ের সামনে দুটো বিপদ উপস্থাপিত ছিল- প্রথমটি স্বৈরশাসকের প্রেতাত্মার প্রতিবিপ্লব, দ্বিতীয়টি আদিপত্যবাদের আক্রোশ। তিনি সেখানে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ লাভের কারণে নিরন্তর কাটার ঘায়ের মতো বাংলাদেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ রয়েছে। আর অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতক ও বহিস্ত শত্রুর সমন্বয়ে জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি যে অব্যাহত হুমকির সৃষ্টি হয়েছে তা অবজ্ঞার নয়। রাষ্ট্রপতির বিতর্কিত মন্তব্য এই সঙ্কটকে আরো প্রকট করে তুলেছে।

গণবিপ্লবের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক যে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে তা এই জাতির ইতিহাসে বিরল। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের প্রতি ডান-বাম নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দলের নিঃশর্ত সমর্থন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে স্থাপন করে। শপথ ও সংবিধান নিয়ে বিব্রতকর অবস্থান সত্ত্বেও পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা বা Doctrine of necessity ভেবে সবাই তা মেনে নেন। সংস্কার ও নির্বাচনের দ্বৈত দায়িত্ব নিয়ে যে অস্থায়ী সরকার কাজ শুরু করেছে, মাত্র আড়াই মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর তার মূল্যায়ন সম্পর্কে কথা বলা অবাস্তব। তবে ওই বাক্যটি অনেকেই মনে করেন ‘Morning shows the day, as child shows the man’. নাগরিক সাধারণ বোঝে যে, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে আলাদিনের চেরাগ নেই। তবুও কিছু কার্যব্যবস্থা, ক্ষমতায়ন, আইনশৃঙ্খলা ও বিব্রতকর মন্তব্য বিশেষত দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা জনমনে কিছু উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে। এটি অনস্বীকার্য যে, অস্থায়ী সরকারের সফলতা, সার্থকতা ও সুনাম-সুখ্যাতি শতভাগ জনগণের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল। তাত্ত্বিকভাবে আমরা প্রথমেই উল্লেখ করেছি, প্রকারান্তরে এগুলো জাতীয় ঐক্য ও সংহতির উপর নির্ভরশীল। জাতীয় ঐকমত্য কোনো অলীক বিষয় নয়। রাষ্ট্রে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যই মূলত জাতীয় ঐকমত্য। তাদের এক ও অভিন্ন ভাষায় কথা বলা কার্যক্রম পরিচালনা ও দাবি উত্থাপন জাতীয় ঐকমত্যের নিয়ামক। এ ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বিএনপির নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে জাতীয় সরকার গঠনের ঘোষণা। কাক্সিক্ষত জাতীয় ঐক্য ও সংহতি নির্মাণে এই সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

ঠিক এ মুহূর্তে জাতীয় ঐকমত্যের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে- এ কথা বলা হয়তো সমীচীন হবে না। কিন্তু জাতীয় ঐকমত্যের প্রতি যে হুমকি সৃষ্টি হয়েছে তা বিনা-দ্বিধায় বলা যায়। বিষয়টিকে আমরা দু’-ভাবে দেখতে চাই। প্রথমত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও সহযোগিতা। দ্বিতীয়ত নির্বাচন-পরবর্তী জাতীয় ঐকমত্যের সঙ্কট। এটি এই কারণে যে, বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র একটি বিশেষ সময় অতিক্রম করছে। বিগত সাড়ে ১৫ বছর ধরে স্বৈরশাসনের বিপক্ষে সব বিরোধী দল ও গোষ্ঠী ছিল একাট্টা। এখন প্রবল পরাক্রমশীল আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে দৃশ্যত ময়দান একেবারেই শূন্য। এটি স্বাভাবিক যে, শত্রুর মোকাবেলায় যুদ্ধ অবস্থায় পক্ষগুলো অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও বিভাজন ভুলে যায়। যুদ্ধজয়ের পর সেই চেতনা ও প্রয়োজনীয়তা লোপ পায়। এখন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিপরীতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি জনগণের সমর্থনপুষ্ট নিরঙ্কুশ শক্তি। যেকোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে তাদের বিজয় অনেকটাই নিশ্চিত। অপর দিকে, অন্যান্য বিরোধী দল নিজ নিজ কর্মসূচি ও আদর্শ, লক্ষ্য ব্যাখ্যা করে জনসমর্থন পাওয়ার জন্য সচেষ্ট। বিএনপি এখন একটি একক অবস্থানে অবস্থিত। তার বিপরীতে অন্য শক্তিগুলো দৃশ্যত বিএনপির সমান মনে হচ্ছে না। গণতন্ত্রে শাসকদলের বিপরীতে সক্ষম বিরোধী দল অনিবার্য, যারা বিরোধী দল হিসেবে সরকারের সমালোচনা করবে ও জন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরবে। এতে অন্যায় কিছু নেই। এই আন্দোলনের মাধ্যমে জামায়াত শূন্যস্থান অনেকটাই পূরণ করেছে, বিরোধী দল হিসেবে দৃশ্যপটে তাদের দেখা যাচ্ছে। চরমোনাইয়ের ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন এবং বিরোধী বাম জোটগুলোও সঙ্গতভাবেই এর পাশাপাশি বিরোধী দল হওয়ার জন্য সচেষ্ট। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নিজ নিজ নির্বাচনী ঘোষণা দ্বারা জনগণকে তুষ্ট করবে এটিই স্বাভাবিক। এটিই গণতন্ত্রের বিধান। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা এই সময়ে একটি বিশেষ পরিবেশ-পরিস্থিতি অতিক্রম করছি। সে কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষিত দুটো কর্মসূচি- সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি ও সম্ভাব্য সব বিরোধী দলের ঐকমত্য অনিবার্য হয়ে উঠেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়কাল ও নির্বাচন-পরবর্তী একটি টার্ম বা শাসনকালকে নাগরিক সাধারণ অবস্থান্তরকাল বা পরিবর্তনকাল (Transitional period) বলে গণ্য করে। সে কারণে বিপ্লবোত্তর সময়কালে প্রধান দু’টি দল বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে কোনো ধরনের বিভেদ দৃশ্যমান হলে সাধারণ মানুষ বিচলিত হয়। আগেই বলেছি, সম্ভাব্য বিরোধী দল হিসেবে যেকোনো দল বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কোনো বাধা নেই। কিন্তু জাতির এই সঙ্কটময় সময়ে বিভেদের সুযোগে শত্রুর অনুপ্রবেশের বিষয়ে নাগরিক সাধারণ আশঙ্কিত। আলাপ-আলোচনায়, সংবাদপত্রে, চ্যানেলে তথা গণমাধ্যমে এই মুহূর্তে যে বিরোধীয় বিষয়গুলো জনগণকে বিভাজিত করছে তা এ রকম :
১. অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়কাল।
২. সংবিধান সংস্কার অথবা পুনর্লিখন।
৩. গতানুগতিক নির্বাচন অথবা সমানুপাতিক নির্বাচন।
৪. রাষ্ট্রীয় সংস্কারের পরিধি ও বিষয়াবলি।
৫. জাতীয় আদর্শ নির্ধারণ ও মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য অর্জন।

বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি বিশেষত অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ওইসব বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের একমত হওয়া কঠিন বিষয় নয়। আমরা লক্ষ করছি, ইতোমধ্যে কিছু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অলিখিত জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন সংবিধান সংস্কার, দু’বারের বেশি পরপর এক ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী না থাকা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ভারসাম্যপূর্ণ ক্ষমতায়ন। এখন এসব বিষয় সংবিধান এবং আইনগত প্রক্রিয়ায় প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আরেকটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর তা হচ্ছে- জীবনাচারে ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের অনুসরণ। আমাদের লিখিত অথবা অলিখিত কার্যক্রম এবং এই নিবন্ধে উল্লিখিত সব কার্যক্রমের সফলতা একটি শব্দে নিহিত, তা হচ্ছে- জাতীয় ঐক্য ও সংহতি। অবশেষে James Freeman Clarke-এর একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শেষ করি : ‘A politician thinks of the next election; a statesman thinks of the next generation’। আমাদের রাজনীতিবিদরা কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হবেন- এই প্রত্যাশা গোটা জাতির।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement