২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ভোক্তা অধিকার আইন, সুরক্ষা কোথায়!

- প্রতীকী ছবি

সাধারণ অর্থে ভোক্তা বলতে আমরা বুঝি এমন কোনো ব্যক্তি যিনি নিজ প্রয়োজন ও ব্যবহারের উদ্দেশ্যে পণ্য ক্রয় করেন। ভোক্তার পণ্য ক্রয়ে কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থাকে না। ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ যেকোনো দেশের সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ব্যবসায়ীরা সবসময়ই লাভ বা মুনাফার উদ্দেশ্যে ব্যবসায় করেন। যেকোনো ব্যবসায়ী যুক্তিসঙ্গত মুনাফা বা লাভের বিনিময়ে ক্রেতার স্বার্থের হানি না ঘটিয়ে যদি ব্যবসায় করেন সে ক্ষেত্রে একজন ক্রেতার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

আমাদের দেশে ব্যবসায়ীসহ একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা বিরাজমান। এ অস্থিরতার কারণে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী আছেন যারা সততা এবং নীতিনৈতিকার বালাই না রেখে নানা অসাধু পন্থায় প্রতিনিয়ত ভোক্তাদের ঠকিয়ে যাচ্ছেন। এসব অসাধু কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ভেজাল পণ্য বিক্রয়, মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর এমন দ্রব্য মিশিয়ে পণ্য বিক্রয়, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রয়, নকল পণ্য বিক্রয়, ওজন বা মাপে কম দেয়া প্রভৃতি।

আমাদের দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য ভোক্তাদের পক্ষ থেকে দীর্ঘ দিন ধরে দাবি জানানো হলেও শেষ পর্যন্ত ২০০৯ সালে আইনটি প্রণীত হয়। আইন প্রণয়ন-পরবর্তী প্রায় ১৫ বছর অতিবাহিত হতে চললেও এ আইন বিষয়ে ভোক্তাদের স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় ভোক্তারা এ আইনের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তা ছাড়া এ আইনে ভোক্তাদের জন্য ক্ষতিকর এমন কাজের সাথে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে; কিন্তু ভোক্তাকে সরাসরি মামলা দায়েরের অধিকার দেয়া হয়নি। মামলা দায়েরের বিষয়ে বলা হয়েছে, একজন ভোক্তা শুধু ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক অথবা মহাপরিচালকের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা তার কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন।
অভিযোগ দায়েরের পর সেটি তাদের কাছে যথার্থ বিবেচিত হলে সংশ্লিষ্ট প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে তার মামলা দায়ের করবেন। এমনই বিধান করা হয়েছে। এ আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ দণ্ডনীয় এবং একজন ম্যাজিস্ট্রেট বিচার শেষে আইনে উল্লিখিত অপরাধের জন্য অপরাধীকে দণ্ড দিতে পারেন। আইনে দণ্ডের পাশাপাশি জরিমানারও বিধান রয়েছে এবং জরিমানার টাকা ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী বা ক্ষতিগ্রস্তকে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে তা শুধু অধিদফতরের বাইরের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। এ আইনে ফৌজদারি প্রতিকারের পাশাপাশি দেওয়ানি প্রতিকারের কথা বলা হয়েছে এবং দেওয়ানি প্রতিকার প্রার্থনার ক্ষেত্রে যুগ্ম জেলা জজ আদালতকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। দেওয়ানি মামলায় প্রতিকার প্রদানের সময় আদালত ত্রুটিপূর্ণ পণ্য প্রতিস্থাপন অথবা ফেরত গ্রহণপূর্বক বাদিকে মূল্য প্রদান অথবা প্রমাণিত ক্ষতির পাঁচ গুণ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশনা দিতে পারেন।

ভোক্তা অধিকার আইন বিষয়ে ভুক্তভোগীদের অভিমত, আইনটির প্রয়োগ নেই। যাদের ওপর প্রয়োগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা ভোগ করে থাকে। এতে আইন বাস্তবায়নকারী ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর কোনো দোষ বা ত্রæটি বা আইন লঙ্ঘনজনিত কাণ্ড অপরাধ হিসেবে দেখেন না। আমাদের বিভিন্ন মিষ্টির দোকানসহ পাইকারি ও খুচরা খাদ্যসামগ্রী বিক্রয়ের দোকানে দেখা যায়, ওজন দেয়ার সময় মোটা কাগজে প্রস্তুত মিষ্টির বাক্সসহ অথবা মোটা কাগজে প্রস্তুত ঠোঙ্গাসহ ওজন দেয়া হয়। বাক্স বা ঠোঙ্গার ওজনের কারণে ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এর প্রতিবাদ করতে গেলে ভোক্তাকে অপমানিত হতে হয়।

একদা জনৈক বিশিষ্ট ব্যক্তি মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি ক্রয়ে প্রতারিত হওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, তিনি জেলা শহরের একটি বিভাগের কর্ণধারের বাসায় গেলে তাকে অন্য খাদ্যসামগ্রীর পাশাপাশি বিভিন্ন মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। পরিবেশিত মিষ্টিগুলো দেখতে খুব সুন্দর ও সুস্বাদু ছিল। মিষ্টি খেয়ে তিনি চরম তৃপ্ত হন। জেলার কর্ণধারকে জিজ্ঞাসা করে তিনি জানালেন, তার অফিসের সামনের প্রধান ফটকের পাশে অবস্থিত দোকানের মিষ্টি। বাসায় ফেরার পথে বিশিষ্ট ব্যক্তিটি ওই দোকান থেকে মিষ্টি কিনে তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাকে মিষ্টির গুণাগুণ বর্ণনাপূর্বক তাদের সাথে খেতে থাকলে উপলব্ধি করেন, কর্ণধারের বাসায় পরিবেশিত মিষ্টির স্বাদ ও মান এবং তার কেনা মিষ্টির স্বাদ ও মান এক নয়। পরে খবর নিয়ে জানা গেল, জেলার বিভাগীয় কর্ণধারকে তুষ্ট রাখার জন্য তারা তাকে বিশেষভাবে মিষ্টি বানিয়ে দেয়। আরো জানা গেল, কর্ণধার নাখোশ হলে দোকানের ইজারা বাতিল হয়ে যাবে। পরে কর্ণধারকে এ বিষয়ে অবহিত করা হলেও তিনি বিষয়টি নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। কারণ মিষ্টির দোকানের মালিক তার স্বার্থ রক্ষা করে।

ভোক্তা অধিকার আইনে ‘অভিযোগকারী’ বলতে যেকোনো ভোক্তা, একই স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট এক বা একাধিক ভোক্তা, কোনো আইনের অধীন নিবন্ধিত কোনো ভোক্তা সংস্থা, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ বা এর পক্ষে অভিযোগ দায়েরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা, সরকার বা এ উদ্দেশ্যে সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীকে বোঝায়। আইনটি পাঠ করলে প্রতীয়মান হয়, এখানে ভোক্তাদের অধিকার কী কী তার স্পষ্ট কোনো বর্ণনা নেই; তবে অধিকার লঙ্ঘন হলে ভোক্তা বা কর্তৃপক্ষের করণীয় বিষয়গুলোর উল্লেখ আছে। আইনে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটি ও অধিদফতর প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যদিও অধিকারভিত্তিক ও সে অধিকার রক্ষামূলক মনোভাব আইনে অনেকটা অনুপস্থিত।

এ বিষয়ে ভারতে বহু আগেই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ভারতে আইন অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষ ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। এটি উপ-আইনত ব্যবস্থা ছঁধংর-ঔঁফরপরধষ ঝঃবঢ়। সেখানে জাতীয়, রাজ্য ও জেলাপর্যায়ে তিন স্তরবিশিষ্ট আইনি পদক্ষেপ নেয়ার বিধান আছে। আমাদের আইনে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নামে বাণিজ্যমন্ত্রীকে চেয়ারম্যান করে ২৭ সদস্যের যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পরিষদ গঠন করা হয়েছে, সে পরিষদের সদস্যরা তাদের কর্মব্যস্ততার কারণে আদৌ পরিষদের সভায় উপস্থিত হতে পারেন কি না এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আইনে প্রতি দু’মাসে পরিষদের চেয়ারম্যান বা চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে কমপক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে এবং ন্যূনতম ১০ জন সদস্যের উপস্থিতিতে পরিষদের সভার কোরাম হবে মর্মে উল্লেখ রয়েছে; কিন্তু নিয়মিত পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হবে এটি পরিষদ সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করতে পারেননি।

আইনে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে আট সদস্যের যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটির উল্লেখ রয়েছে তা কতটা কার্যকর এ নিয়েও প্রশ্ন আছে।

আইনে বলা হয়েছে, এ আইনের অধীন সব অপরাধ জামিনযোগ্য, আমলযোগ্য ও আপসযোগ্য। কিন্তু কোনো ব্যক্তি কারণ উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে এ আইনের অধীন ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্য সম্পর্কে মহাপরিচালক কিংবা অধিদফতরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ না করলে ওই অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না। স্পষ্টত আইনটিতে উল্লিখিত অপরাধ ফৌজদারি অপরাধ। ফৌজদারি অপরাধ বিষয়ে আইনের চিরাচরিত বিধান- অপরাধীর মৃত্যু ব্যতীত এ ধরনের অপরাধ সময় দ্বারা বারিত নয়। আইনটিতে অপরাধ সংগঠনের ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ দায়ের না করলে তা বারিত হবে মর্মে উল্লিখিত বিধানটি আমাদের প্রচলিত ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মৌলনীতি- যেকোনো ফৌজদারি অপরাধ সময় দ্বারা বারিত নয়-এর পরিপন্থী।

আমাদের দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়নের আগে থেকে Consumer Association of Bangladesh (CAB) নামের একটি সংগঠন ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় ভ‚মিকা পালন করে আসছিল। আইনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে এ সংগঠনের ইতিবাচক ভ‚মিকা থাকলেও আইন প্রণয়নের পর দেখা যায়, সংগঠনটির কার্যকলাপ আইনের কার্যকরতা পর্যবেক্ষণের চেয়ে সভা-সেমিনার আয়োজন এবং বক্তব্য ও বিৃবতি প্রদানের মধ্যে অধিক সীমাবদ্ধ।

আমাদের দেশে মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে সাধারণ মানুষ পারতপক্ষে ফৌজদারি বা দেওয়ানি অপরাধের প্রতিকার পেতে আদালতের দ্বারস্থ হয় না। যদিও যেকোনো ধরনের ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সরাসরি থানা বা আদালতে মামলা দায়েরে কোনো বাধা নেই।

আলোচ্য আইনটিতে ফৌজদারি মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ভোক্তা কর্তৃক থানায় বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সরাসরি মামলা দায়ের করার বিধান না থাকায় তাতে একজন ভোক্তার মামলা দায়েরে আগ্রহে যে ভাটা পড়বে সেটি অনেকটা নিশ্চিত। সুতরাং ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে যে আইনটি প্রণীত হয়েছে সে আইন প্রণয়নের পর এক যুগেরও অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও যখন দেখা যায়, ব্যবসায়ী কর্তৃক ভোক্তাদের ঠকানোর প্রবণতা পূর্বাপর একই আছে; তাতে এ আইন যে থেকেও না থাকার নামান্তর- তা বলা কি অত্যুক্তি হবে!

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement