২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

প্রেক্ষিত-ছাত্র গণবিপ্লব প্রত্যাশা ও দায়িত্ব

- প্রতীকী ছবি

৫ আগস্টের ছাত্র-গণবিপ্লব এ দেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল আইনের শাসনের; সুবিচারের; প্রাণভরে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়ার, মানুষের মর্যাদা নিয়ে গৌরবের আলোয় ভাস্বর এক জীবনের। কৃষক স্বপ্ন দেখেছিল দালাল ফড়িয়াদের হাত থেকে বাঁচার; শ্রমিক স্বপ্ন দেখেছিল ন্যায্য মজুরির। ছাত্র-যুবকরা স্বপ্ন দেখেছিল দাক্ষিণ্যহীন, প্রভাবমুক্ত মেধার অধিষ্ঠান।

ব্যবসায়ীরা স্বপ্ন দেখেছিলেন চাঁদাবাজি ও বাধাবন্ধনহীন ব্যবসায় পরিচালনার। অত্যাচারীরা বিতাড়িত হবে, বিচার হবে তাদের অত্যাচার, লুণ্ঠন, অর্থপাচার, গুম আর খুনের। গত ১৭ বছর সবচেয়ে বহুল উচ্চারিত শব্দ গুম। এর ভয় থেকে বাঁচার, রিমান্ড নামক রক্তহিম এক দুঃস্বপ্ন থেকে বাঁচতে- ৫ আগস্ট ছিল জাতির একটি স্বপ্নের সফলতা। যে সফলতা রাজনীতির পাঠ বদলে দিয়েছে। শেখ হাসিনা চলে গেলে কে দেশ চালাবে? তোমাদের নেতা কই? এ ধরনের মদমত্ততার জবাব ৫ আগস্ট। ঠিক এমনি প্রশ্ন ছিল ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসেও। শেখ মুজিব ক্ষমতা ছেড়ে দিলে দেশ চালাবে কে? প্রখ্যাত সংবাদ ভাষ্যকার বিবিসির তৎকালীন ঢাকার প্রতিনিধি মার্ক টালি এই প্রশ্নের অবতারণা করেছিলেন ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের প্রথম দিকে। সেদিনও পরিস্থিতি নেতা সৃষ্টি করেছিল। আজও প্রকৃতি তার নিজ প্রয়োজনে নেতৃত্ব তৈরি করে নিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের।

জাতির আকাঙ্ক্ষার সাংবিধানিক সরকারের প্রয়োজন এখন সর্বাগ্রে হলেও সাংবিধানিক নিয়মের বাইরে এই সরকারকে দায়িত্ব নিতে হয়েছে জাতির সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে। এ ক্ষেত্রে সব মতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিঃশর্ত পরামর্শ এবং সহযোগিতার প্রয়োজন সর্বাগ্রে। জুলাই বিপ্লবের চেতনা ধারণ করে বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতা ছাড়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এককভাবে জাতির স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। রাজনীতির সাথে প্রায় সংশ্রবহীন উপদেষ্টামণ্ডলীর পক্ষে সবদিক সামলিয়ে গত ১৭ বছরের পুঞ্জীভ‚ত ক্ষোভ, আবর্জনা, সার্বিক বিশৃঙ্খলা ও প্রত্যাশা সামাল দেয়া যে অসম্ভব বর্তমান অবস্থা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। গত ১৬-১৭ বছরের রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্খলনে জাতি বীতশ্রদ্ধ চিরাচরিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, তাও নেতাদেরকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে হবে। বিপ্লব শুধু ক্ষমতার হাত বদল নয়, এর কার্যকর পরীক্ষায় আমাদের নেতারা এখনো উত্তীর্ণ হতে পারেননি। ব্যাপারটি শঙ্কার। জনগণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে বিকল্প পথে আবারো ফ্যাসিবাদের উত্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়। এ দিকে আমাদের প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক নেতাদের সজাগ এবং কার্যকর ভ‚মিকা অপরিহার্য।

গত দেড় দশকে এমন কোনো সাংবিধানিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নেই, যা ধ্বংস করা হয়নি। সরকার, সংসদ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, বিচার, অর্থনীতি, শিক্ষা, এমন কোনো বিভাগ নেই- যাকে অস্তিত্বহীন করা হয়নি। সব সাংবিধানিক, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে ‘এক নেতা এক দেশ’ সৃষ্টির সামগ্রিক আয়োজন শেষ করে এনেছিল পতিত সরকার। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য মৌলিক অবকাঠামো, মৌলিক নীতিমালাসংবলিত একটি গ্রহণযোগ্য কাঠামো তৈরি এখন সর্বাগ্রে গণ্য। মৌলিক অধিকার, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্তরণের একটি কার্যকর অবকাঠামো তৈরি সরকার এবং রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রাধিকার তালিকায় থাকা দরকার, যা নির্দিষ্ট সময়কাঠামোর মধ্যে সীমিত থাকবে।

অর্থনৈতিক অবকাঠামো এবং আইনশৃঙ্খলা বর্তমান সরকারের প্রাধিকার তালিকায় থাকা দরকার। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর যেসব সদস্য বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে অনুপস্থিত রয়েছেন তাদের শূন্যস্থান পূরণের ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। ইতোমধ্যে কয়েক ব্যাটালিয়ন পুলিশ ও আনসার স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ দিয়ে দায়িত্ব দেয়া গেলে সঙ্কটের অনেকটাই সুরাহা হয়ে যেত। বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের ক্ষেত্রেও এটি করা যায়। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যাদের বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া এবং নেয়ার জন্য বাধ্য করা হয়েছিল তাদের পূর্ণ জ্যেষ্ঠতা দিয়ে পুনরায় নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে এটি করা যায়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিপ্লববিরোধী কোনো অপতৎপরতা যেন না হতে পারে এ ব্যাপারে ছাত্র ও জনগণের যৌথভাবে প্রতিরোধী ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন। ছাত্র সমন্বয়কদের এ ক্ষেত্রে রয়েছে বিশাল ভূমিকা। যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তারা ইতিহাস তৈরি করছেন তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তাদের জোরালো সতর্কতামূলক দৃষ্টি থাকা জরুরি। তাদের নাম ভাঙিয়ে যেন কেউ কোথাও অবৈধ সুবিধা না নিতে পারে এ ব্যাপারে তাদের কঠোর ভূমিকা থাকা দরকার। বিপ্লবী চেতনার নাম ভাঙিয়ে অবৈধ সুবিধা বিপ্লবকে নস্যাৎ করার অপর নাম; এটি তাদের বুঝতে হবে। এ ধরনের অপচেষ্টা এখনই দৃশ্যমান। এ ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার সতর্ক তীক্ষ্ম নজরদারির বিকল্প নেই। বিচার বিভাগের মর্যাদা এবং বিচারের নিশ্চয়তা বিধানের ক্ষেত্রে ত্বরিত সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষমাণ ছাত্র-জনতা। সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ের নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে ছাত্রদের ভ‚মিকার কোনো বিকল্প নেই।

যে স্বপ্ন এবং প্রত্যাশা সামনে রেখে হাজার জীবনের মূল্যে দেশের ছাত্র-গণজাগরণ তার শুধু প্রথম পর্যায় শেষ হয়েছে। এই অর্জনকে সংহত করা, এর আলোকে রাষ্ট্র নির্মাণ এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের গুরুদায়িত্ব এখন। কষ্টার্জিত বিজয়ের সুফলকে আম-জনতার কাছে পৌঁছে দেয়ার ভিত্তি নির্মাণের সময় এখন। এখন যেকোনো ধরনের কলহ, অনৈক্য-অপশক্তিকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। এখন প্রয়োজন জাতির ইস্পাতকঠিন সুদৃঢ় বন্ধন।

প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতা এবং ছাত্র-জনতার চিন্তা এবং চেতনার ঐক্যের ভিত্তিতে কর্মসূচি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে তার বাস্তবায়ন। হরিলুটের বাতাসার কাড়াকাড়ির প্রতিযোগিতা কিংবা ‘ওলট পালট করে দে মা লুটে পুটে খাই’-এর সময় এখন নয়। এ ধরনের চর দখলের অসুস্থ প্রতিযোগিতা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের সফলতাকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। বিজয়ের হালুয়া-রুটির কাড়াকাড়ি ভাগাভাগির সময় এখন নয়। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী মেজর জলিলের অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা ‘সাবধান বাণীর কথা’ স্মর্তব্য।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
ই-মেল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement