দুই পরাশক্তির চিপ যুদ্ধ
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ২১:১১
বিশ্বের একক সুপার পাওয়ার হিসেবে আমেরিকা এখন ক্ষয়িষ্ণু। অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা এমন মন্তব্য করেছেন। সবশেষ এমন মন্তব্য করেন জাপানের সদ্য ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা। তার মতের সাথে একমত বহু গবেষক পণ্ডিত নিরাপত্তা বিশ্লেষকও। খোদ আমেরিকার কিছু থিংক ট্যাংকের বিশ্লেষকরাও একই কথা বলেন। কারণ, আমেরিকার একক মোড়লিপনায় চলমান বিশ্ব ব্যবস্থা সুষ্ঠু ও সাবলীলভাবে চলছে না অথবা আমেরিকা চালাতে পারছে না। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের গত ৭৫ বছরে পৃথিবী আরো বেশি অনিরাপদ আরো বেশি অনিশ্চিত, আরো বেশি বৈষম্যময় হয়েছে। অনেক সঙ্কটে আমেরিকা তার প্রভাব কার্যকর করতে ব্যর্থ হচ্ছে এমনটিও দেখা যাচ্ছে।
বিশ্ব শান্তির লক্ষ্যে আমেরিকা বিশ্বজুড়ে উদার গণতন্ত্র, সর্বজনীন মানবাধিকার ও পুঁজিতান্ত্রিক মুক্তবাজারের মতো যেসব মূল নীতির ফেরিওয়ালা সেসব পণ্য বা পরিষেবা সর্বত্র সমভাবে সরবরাহ করতে পারছে না দেশটি। জাতি ধর্ম, বর্ণ, ভূগোল ও অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদে সমতার নীতি অভিন্ন থাকছে না। দেশটির বিরুদ্ধে দ্বিচারিতা ও কপটতার অভিযোগ পুরনো। সেই সূত্র ধরে খোদ আমেরিকাতেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সম্ভাব্য বিপর্যয়ের শঙ্কার কথা উচ্চারিত হতে শোনা যাচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, এই বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতে পারে আগামী ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হলে। এই লোকটি একজন জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিক। দুর্নীতির দায়ে সাজা পাওয়া এবং অনৈতিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত ট্রাম্প এক অপরাধপ্রবণ স্বৈরাচারী মানসিকতার মানুষ। লোকটি চরম মুসলিম বিদ্বেষীও। আগেরবার ক্ষমতায় থাকতে সাতটি মুসলিম দেশের জন্য আমেরিকার দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ইসরাইলকে ঘিরে সম্প্রসারণবাদী মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্টও একই কাজ করছেন; বরং তার চেয়েও বেশি। ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার কাজে সব রকম সহায়তা ও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আগের প্রেসিডেন্টরাও ইসরাইলকে সাহায্য করেছেন অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি পরিমাণে। এর কারণ আমেরিকার সমাজই ইহুদি রাষ্ট্রটির পক্ষে, ইহুদি প্রভাবিত তাদের সরকার থেকে সব কিছু। সে যাই হোক, দেশটির আসন্ন নির্বাচনে এখন পর্যন্ত জনমতের যে ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে তাতে ট্রাম্পের ফিরে আসার সম্ভাবনা কম নয়; বরং পরিস্থিতি তার অনুক‚লেই যাচ্ছে দিনকে দিন।
আমেরিকা একক কর্তৃত্ব হারালে কে পারে শূন্যস্থান পূরণ করতে? প্রশ্নটা সা¤প্রতিক সময়ে বেশ আলোচিত। রাশিয়া, চীন, জাপান, ভারত অনেক নামই টেবিলে আছে। বহু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকের ধারণা, চীন হবে পরবর্তী সুপার পাওয়ার। অর্থনৈতিক, সামরিক ও বৈশ্বিক প্রভাব সব দিক থেকে আমেরিকাকে টক্কর দেয়ার শক্তি এই মুহূর্তে কেবল চীনেরই আছে। আমরা এই দৌড়ে ভারতকে রাখছি না। প্রথমত সুপার পাওয়ার হওয়ার মতো আর্থিক সক্ষমতা তার নেই। যে দেশের অর্ধেক মানুষ এখনো রাতে না খেয়ে ঘুমাতে যায়, আদারে বাদারে প্রাকৃতিক কর্ম সারে সেই দেশ চন্দ্র জয় করলেই জাতে ওঠে না। দেশটির জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্যের রেকর্ড করুণ। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ বৈষম্য চলতে থাকলে ভারত টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। ভারতের এ বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববাসী তেমন সচেতন ছিল না। কানাডার নেতা ট্রুডো যখন তার দেশের একজন নাগরিককে তার দেশেই হত্যার জন্য ভারতকে দায়ী করলেন তখনই বিশ্ব নড়ে বসল। ক’দিন পর খোদ আমেরিকাও একই অভিযোগ আনে। সেটি ছিল মার্কিন নাগরিককে সেই দেশে হত্যার চেষ্টা করে ভারতীয় গুপ্ত ঘাতকরা। শুধু অভিযোগ নয়, আমেরিকা তথ্য প্রমাণও প্রকাশ করে। প্রতিবেশীর সাথে আচরণেও ভারত পাসমার্ক পাবে না।
পুতিনের রাশিয়াকে আমেরিকার শূন্যস্থানে কেউ দেখতে প্রস্তুত না। সামরিক শক্তি যাই থাকুক দেশটির অবক্ষয়িত বৈশ্বিক প্রভাব শিগগির পুনরুদ্ধার করার সম্ভাবনা সুদূর। ইউক্রেন আক্রমণ করে পুতিন আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের যে তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছেন, তার সাথে যুদ্ধের বিপুল ব্যয়ের ধকল সামলে নিতেই তার হিমশিম দশা। যুদ্ধেও সুবিধা করতে পারছেন না। পুরো ন্যাটোর বিরুদ্ধে তাকে লড়তে হচ্ছে।
জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার ফ্যাসিবাদী দায় ঘুচিয়ে কেবল সার্বভৌমত্ব ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। চেষ্টা করছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সমমর্যাদার আসনটুকু ফেরত পেতে। ভূরাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের হাত ধরে ওইটুকু অর্জন করতে পারলেই তার জন্য আপাতত যথেষ্ট। সুপার পাওয়ার হওয়া হনুজ দূর অস্ত।
এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ বিশ্লেষক পর্যবেক্ষক চীনকে ফ্রন্টরানার মনে করেন। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি। সামরিক শক্তিতে রাশিয়ার পর তৃতীয় অবস্থানে। বৈশ্বিক প্রভাবও দিন দিন বাড়ছে। শুধু তাই নয়, ব্যবসায়-বাণিজ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতেও আমেরিকার সমকক্ষ হওয়ার দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে।
কিন্তু বাস্তবে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাওয়া তখনই সম্ভব, যখন সর্বশেষ প্রযুক্তিগত জ্ঞানে আমেরিকাকে টপকাতে পারবে। সেটি কি সম্ভব? আমাদের বিশ্বাস, সম্ভাবনা তো আছেই। তবে আমেরিকার সর্বাত্মক প্রতিরোধের মুখে চীনকে আপাতত রানারআপ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। একটু সবিস্তারে বলি।
এই মুহূর্তে চীন-আমেরিকার দ্বন্দ্ব কেবল বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সীমিত নয়। দুই দেশের বাণিজ্যিক মহাযুদ্ধ আরো গুরুতর। এই বাণিজ্য যুদ্ধ হচ্ছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগত বিদ্যা নিয়ে। চীন এ ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়েছে। কিন্তু সবশেষ যে প্রযুক্তিটি আগামী বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছে সেটি সম্পর্কে অনেকে হয়তো তেমন সচেতন নন।
আগামী বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত সম্পদ হয়ে উঠেছে মাইক্রোচিপ বা সেমি কন্ডাক্টর। মোবাইল কোম্পানির যে সিমকার্ড দিয়ে আমরা কথা বলা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ করি সেই সিমকার্ড একটি মাইক্রোচিপ। কম্পিউটার চলে এই চিপ দিয়ে। এটুকু বললে অবশ্য কিছুই বলা হয় না। আসলে সুপার কম্পিউটার থেকে শুরু করে বাজারে যত রকমের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি পাওয়া যায় তার সব কিছুই চলে চিপ দিয়ে। আমাদের ঘরের যন্ত্রপাতি, রেডিও, টিভি, মোবাইল, ক্যামেরা, ল্যাপটপ, ফ্রিজ, ওভেন, ওয়াশিং মেশিন- সব কিছুতেই এটি আছে; হৃৎপিণ্ডের মতো নয়, একেবারে আত্মার মতো।
বলে রাখি, চলতি ২০২৪ সালেই সেমিকন্ডাক্টর বা চিপের বৈশ্বিক বাজার ৬০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আগামী ছয় বছরের মধ্যে, ২০৩০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। এই মুহূর্তে সামরিক সরঞ্জাম নির্মাণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক (এআই) প্রযুক্তি অর্জন তথা আরো উন্নত চিপ তৈরির তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্বজুড়ে। এই প্রতিযোগিতায় কেউ পিছিয়ে থাকতে নারাজ।
কিন্তু বিদ্যা ও বাজারের বেশির ভাগ আমেরিকার কব্জায়। তারা কোনোভাবেই চাইছে না উন্নতমানের সেমিকন্ডাক্টর তৈরির প্রযুক্তি চীনের হাতে যাক। এ জন্য চীনা কোম্পানির কাছে সেমিকন্ডাক্টর বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আমেরিকা। তবে চীন বসে নেই। বেইজিং চিপ উৎপাদনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে এবং সুপার কম্পিউটার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে। হুয়াওয়ের মতো চীনা কোম্পানি যে আইফোনের প্রায় সমকক্ষ স্মার্ট ফোন বানাতে পেরেছে তাতে চীনের অগ্রগতি স্পষ্ট। ২০১৪ সালে চীন যখন এই খাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে তখনই আমেরিকার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে। তখন থেকেই আমেরিকা চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর খড়গহস্ত হতে শুরু করে। হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ তার অংশ। সিলিকন দিয়ে তৈরি হয় চিপ। এর কাঁচামাল সরবরাহ করে সারা দুনিয়ার অনেক দেশ ও অসংখ্য কোম্পানি। বলা হচ্ছে- এই সরবরাহব্যবস্থা বা ‘সাপ্লাই চেনের’ নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে, সেই হবে ভবিষ্যতের সুপার পাওয়ার।
সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি নিয়ে এই যুদ্ধ কতটা তীব্র ও মারাত্মক সেটি উপলব্ধি করা গেল ২০২২ সালে ক্রিস মিলারের বই ‘চিপ ওয়ার’ প্রকাশ পেলে। অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিশ্লেষক ক্রিস মিলার বিশ্বের এই জটিলতম প্রযুক্তি কব্জা করার প্রতিযোগিতা কিভাবে দেশগুলোকে রীতিমতো যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলছে তারই মহাকাব্যিক বিবরণ তুলে ধরেছেন।
আমেরিকা চিপ তৈরি করে তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে। তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ারে সমৃদ্ধির পেছনে এই শিল্পের বড় ভ‚মিকা আছে। সম্প্রতি আমেরিকা এই শিল্পে বড় ধরনের ভর্তুকিও দিয়েছে। প্রতিবেশী ভারতও আমেরিকার সহায়তায় চিপ তৈরির প্রকল্প নিচ্ছে কলকাতায়। চিপ তৈরির প্রকল্পকে এই শিল্পের পরিভাষায় বলা হয় ফেব্রিকেশন প্লান্ট সংক্ষেপে ফেব (ঋবন)। এই ফাঁকে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশ চিপ তৈরির বিষয়ে এখনো সচেতন নয়। কিন্তু সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। গার্মেন্ট কারখানা ধরে বসে থাকলে আগামীর বিশ্বে আবারো হাভাতে অবস্থায় পড়তে হবে আমাদের।
চিপ যুদ্ধ নিয়ে এত সব ঘটনাবলির পর কেউ যদি বলেন, আগামী বিশ্বে কোন দেশটি সুপার পাওয়ার হতে যাচ্ছে সেই প্রশ্নই অবান্তর- তাহলে কিছু বলার নেই। হয়তো সুপার পাওয়ার বা পরাশক্তি বলে কোনো একটি দেশ, জাতি বা সরকার না-ও থাকতে পারে। প্রকৃত সুপার পাওয়ার হবে হয়তো অন্য কেউ, অন্য কোনো অস্তিত্ব। কেউ কি বলতে পারেন, কে হতে পারে সেই শক্তি? আমরা আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করব। ভবিষ্যতের প্রকৃত সুপার পাওয়ার নিয়ে আগামী সপ্তাহে আবার কথা হবে।
ইমেল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা