সংবিধান : জনগণের ক্ষমতা না সোনার পাথর বাটি
- মুসা আল হাফিজ
- ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০:৪০
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল নির্বাচিত গণপরিষদ কর্তৃক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল ’৭১ কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় (মুজিবনগর) নবগঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথগ্রহণ করেন। ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামের রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও অনুমোদনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক ও আইনানুগভাবে পরিচালিত হয় নবগঠিত সরকার। এই ঘোষণাপত্রকে বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তীকালীন সংবিধান হিসাবে গ্রহণ করা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে অস্থায়ী সংবিধান জারি করা হয় ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র মোতাবেক রাষ্ট্রপতির হাতে ছিল শাসনক্ষমতা। এবার তা প্রধানমন্ত্রীর হাতে চলে এলো। এখন থেকে প্রেসিডেন্টকে সব কাজ করতে হবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের আলোকে। শেখ মুজিবুর রহমান সিদ্ধান্ত স্থির করেছিলেন তিনি আর রাষ্ট্রপতি থাকবেন না, প্রধানমন্ত্রী হবেন। ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হলেন।Constituent Assembly of Bangladesh Order 1972 (P.O 22 of 1972) শিরোনামে সাংবিধানিক অ্যাসেম্বলি অধ্যাদেশ জারি হয় ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ। কিন্তু ঘোষণা করা হয় এ অধ্যাদেশ কার্যকর হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে। এই অধ্যাদেশ বলে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের আগের আইনগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রের সাথে সামঞ্জস্যতার শর্তে বহাল রাখা হয়। সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় দ্রুতই। ১১ এপ্রিল ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি ঘোষণা করা হয়, যার আহ্বায়ক ছিলেন ডক্টর কামাল হোসেন। সংবিধান বিষয়ে প্রস্তাব আহ্বান করা হয় দেশের বিশিষ্টজন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কাছে। এটা ১৭ এপ্রিলের ঘটনা। ৮ মে’র মধ্যে ৯৮টি প্রস্তাব হাজির হয়। সংবিধানের খসড়া তৈরি হয় ১০ জুনের মধ্যে। ভারত ও ইংল্যান্ডে সফর করে কামাল হোসেন সংবিধান সম্পর্কে আরো স্পষ্টতা ও নির্ভুলতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘খসড়া সংবিধান’ বিল আকারে উত্থাপিত হয়।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়। ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদের সদস্যরা এই সংবিধানে স্বাক্ষর করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান কার্যকর হয়।
১১টি অধ্যায়ে, ১৫৩টি অনুচ্ছেদে এবং চারটি তফসিলে বিভক্ত এ সংবিধান প্রণীত হয় যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, তুরস্ক, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সংবিধান সামনে রেখে। জাতিসঙ্ঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাসহ মানবাধিকার-সংক্রান্ত অন্য দলিলসমূহের আলোকে সাজানো হয় সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ শীর্ষক অধ্যায়। যাতে একাধিক উপচ্ছেদসহ ছিল ২১টি অনুচ্ছেদ। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে ছিল ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ শীর্ষক অধ্যায়। এতে ঘোষণা করা হয় চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সেগুলোর ব্যাখ্যাও হাজির করা হয়। আর যেসব বিষয়ে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়, তার মধ্যে আছে- অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মালিকানার নীতি, কৃষক শ্রমিকের মুক্তি, মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা, সুযোগের সমতা, নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, জাতীয় সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন-বিষয়ক বিধিমালা। যার সারকথা হলো, একটি প্রগতি ও শান্তিকামী আধুনিক রাষ্ট্রের প্রত্যয়।
সংবিধান নাগরিকদের মৌলিক অধিকারকে খোলাসা করে। ১৯৭২ সালের সংবিধান নিয়ে রাজনৈতিক মহলে পরস্পরবিরোধী মত ছিল এবং এখনো আছে। অনেকের দাবি, এটি ছিল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। আবার ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এই বার্তাও প্রচার করে যে, পরবর্তীকালে বাংলাদেশ যে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ঝুঁকেছে; তার বীজ মূল সংবিধানেই নিহিত ছিল। বস্তুত সংবিধান রচনাকালে যেসব অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়েছিল, পরবর্তীতে তা বাস্তবায়ন হয়েছে খুব কমই।
সংবিধানের বাস্তবায়ন সর্বনিম্ন মাত্রায় হয়েছে, এটা বলা যেতে পারে। কিন্তু কেন? এর কারণ আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেমন নিহিত, তেমনি নিহিত আছে স্বয়ং সংবিধানে। সংবিধানটি পাঠ করলেই তা লক্ষ করা যাবে। সেখানে নাগরিকদের দেয়া হয়েছে চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা । প্রত্যেক নাগরিকের মতামত ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার পাশাপাশি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছে। দিয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার, সমিতি বা সঙ্ঘ গঠন করার অধিকার।
সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককে পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা দিয়েছে। স্পষ্ট ঘোষণা করেছেÑ কোনো পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার জন্য আইনের দ্বারা কোনো যোগ্যতা নির্ধারিত হইয়া থাকিলে অনুরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যে কোনো আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি-গ্রহণের এবং যে কোনো আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার অধিকার থাকিবে। সকলকে দিয়েছে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার। যদি কোনো কারণে মৌলিক অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। সংবিধান পরিষ্কারভাবে দিয়েছে জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার।
কিন্তু এসব অধিকার-ভাষ্যের সাথে যদি সংবিধানের অপরাপর আইন কোনো জটিলতা তৈরি করে, তাহলে ব্যাপারটি কেমন দাঁড়াবে? যদি অপরাপর নানা ভাষ্য অধিকার প্রয়োগের গোটা ব্যাপারকে গোলক ধাঁধার জগতে নিয়ে যায়, তাহলে নাগরিকের বঞ্চনা এড়াব কিভাবে?
রাষ্ট্র জনগণের ক্ষমতার নির্মাণ। আর সংবিধান জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি। ফলে সংবিধান ঘোষণা করেছে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। এটা তো খুব করে উচ্চারণ করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলো কারণে-অকারণে এই ঘোষণা রাষ্ট্র করেছে অজস্রবার। কিন্তু সংবিধানে বর্ণিত এই কথার পরের কথাটি হলো- এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ, কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।
এর মানে দাঁড়াল জনগণের ক্ষমতা আছে, কিন্তু তা প্রয়োগ করবে কর্তৃত্বসম্পন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তাদের হাত দিয়েই তা বাস্তবায়ন হবে। এই বাস্তবায়নের ক্ষমতা শেষ অবধি ক্ষমতা ভোগের ক্ষমতায় পরিণত হয়েছে। ফলে বাস্তবায়ন হয়েছে কম, ক্ষমতা ও প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বেশি। গোটা ব্যাপারটা ঘটেছে একটা মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে, তা হলো সব ক্ষমতার মালিক জনগণ!
বস্তুত জনগণের ক্ষমতাকে ভাগ করে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন বিভাগের কর্তৃত্বের হাতে। যারা জনগণের সেবা ও সহায়তার পরিবর্তে নিজেদেরকে গণবিচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠান ও উচ্চবর্ণের অভিজাত হিসেবে ভেবেছে, কাজ করেছে। সবার উপরে স্থাপন করা হয়েছে এক ব্যক্তিবাদ!
নির্বাহী বিভাগের হাতে কর্তৃত্বের যে বিশাল জমিদারি দেওয়া হয়েছে, তা জনগণকে শেষ অবধি প্রজা বানায়, আর কিছু নয়। প্রধানমন্ত্রীর হাতে সব ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে বলতে গেলে। রাষ্ট্রপতি যেসব ক্ষমতা ভোগ করবেন, তার সিংহ ভাগও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ (পড়ুন এখতিয়ার) সাপেক্ষ। যা নিশ্চিত করা হয়েছে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮ (৩) এ। যেখানে বলা হয়েছে, ‘কেবল প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী’ কাজ করিবেন। এর ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে রাষ্ট্রের প্রায় সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলো। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির দণ্ড মওকুফ, প্রতিরক্ষা বিভাগের সর্বাধিনায়ক নিয়োগ, বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ, নির্বাচন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক নিয়োগ, কর্মকমিশন প্রতিষ্ঠা ও নিয়োগের মতো যে ক্ষমতাগুলো প্রেসিডেন্টের, তা মূলত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের বাধ্যবাধকতায় কেন্দ্রীভূত হলো। প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি, কিন্তু তাও অস্পষ্টতার মধ্যে অন্তর্নিহিত। সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থাভাজন বলে যিনি চিহ্নিত হবেন... এমনতরো ভাষ্যের মারপ্যাঁচে শেষ অবধি নির্ধারিত নেতাই সব কিছু হচ্ছেন। তিনি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন, নিয়োগের অবসান ঘটাবেন। মন্ত্রিসভার আকার-আয়তন তার এখতিয়ারাধীন। আবার অনুচ্ছেদ ৭০ এর মাধ্যমে গোটা সংসদকে দল তথা দলীয় প্রধানের অনুগত থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। কোনো সংসদ সদস্য নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তার সদস্যপদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
এর মানে পরিষ্কার। প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারের পক্ষে দলীয় আইন প্রণেতাদের থাকতেই হবে। এটা বাধ্যবাধকতা। এর মধ্য দিয়ে ৭২ এর সংবিধান জনগণের ক্ষমতাকে স্বীকার করেও তার প্রকৃত অধিকারী বানালো কাকে? প্রধানমন্ত্রীকে নয়তো? এর ফলে আমরা দেখেছি অধিকতরো ক্ষমতা নেশার রোগ, প্যানোরয়া। যা এত ক্ষমতা লাভের পরেও আরো ক্ষমতা চেয়েছিল। শেষ অবধি বাকশাল নিশ্চিত করেছিল।
ফলে ’৭২-এর সংবিধানের মধ্যেই রয়েছে জনগণের ক্ষমতাহরণ ও তাদের ওপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার উপাদান। সেই ধারা থেকে বাংলাদেশকে বেরিয়ে আসতে হবে।
লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা