উচ্চ আদালতের বিচারকদের কর্মকালীন ও অবসর-পরবর্তী নিয়োগ
- ইকতেদার আহমেদ
- ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২০:৫৪
উচ্চ আদালতের বিচারকরা সাংবিধানিক পদধারী। প্রধান বিচারপতিসহ উচ্চ আদালতের সব বিচারককে নিয়োগ-পরবর্তী শপথ নিতে হয়। শপথ গ্রহণ ছাড়া তারা পদে আসীন হন না এবং চাকরি থেকে অবসরের সাথে সাথে তারা শপথ থেকে অবমুক্ত হন। উচ্চ আদালতের বিচারকরা শপথের অধীন হওয়ায় তাদের পক্ষে শপথের ব্যত্যয়ে কোনো কিছু করলে সংবিধানের অবমাননা হয়। শপথ গ্রহণকালীন প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের বিচারক এবং হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতে হয় যে, তারা বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করবেন, তারা বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন এবং তারা ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করবেন।
শপথের বাধ্যবাধকতায় উচ্চ আদালতের কোনো বিচারকের দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকলে তার পক্ষে বিচারক পদে নিয়োগ পাওয়াসহ পদে আসীন থাকার সুযোগ বারিত। এ দেশের উচ্চ আদালতের একজন বিচারকের বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্যের অর্থ উভয়টি হবে শতভাগ। একজন বিচারক দ্বৈত নাগরিক হলে প্রশ্ন দেখা দেয় বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্যের হার কত। একই সাথে তিনি অন্য যে দেশের নাগরিক সে দেশটির প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্যের হার কত। সংবিধান যেহেতু অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে শতভাগ নিশ্চয়তা দাবি করে; সুতরাং এর কোনো ব্যত্যয় সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ধরনের লঙ্ঘন নিয়োগ ও কর্মে বহাল উভয় ক্ষেত্রে অলঙ্ঘনীয় বাধা হিসেবে দেখা দেয়।
উচ্চ আদালতের বিচারক পদে নিয়োগে যেসব যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে তা হলো তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে; সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় অন্যূন ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে অথবা বিচারবিভাগীয় পদে অন্যূন ১০ বছর অধিষ্ঠিত থাকতে হবে অথবা সুপ্রিম কোর্টে বিচারক পদে নিয়োগ লাভে আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা থাকতে হবে। বিচার বিভাগের নিম্নতম পদ সহকারী জজ হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে একজন প্রার্থীর মাধ্যমিক থেকে আইনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সব পরীক্ষায় ন্যূনতম দ্বিতীয় শ্রেণী থাকা অত্যাবশ্যক। নিয়োগ কার্যটি জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সমাধা করা হয়। প্রতিটি নিয়োগের সময় যে প্রতিযোগিতামূলক প্রাক-বাছাই ও তদপরবর্তী লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় তাতে সার্বিক মূল্যায়নে দেখা যায় ৬০ শতাংশের ঊর্ধ্বে নম্বরপ্রাপ্ত না হলে নিয়োগ পাওয়ার অবকাশ ক্ষীণ।
অধস্তন বিচার বিভাগের নিম্নতম পদের যোগ্যতা আইন ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত হওয়ায় সঙ্গত কারণে এর নিম্নের যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তির উচ্চ আদালতের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের সুযোগ নেই। তা ছাড়া সাংবিধানিকভাবে উচ্চ আদালতের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান করায় অধস্তন আদালতের বিচারকদের চেয়ে উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের উচ্চাদালতে বিচারক পদে নিয়োগ পাওয়া বাঞ্ছনীয়। তত্ত¡াবধান ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে পৃথিবীর সর্বত্র যে নিয়ম পরিলক্ষিত হয় তা হলো- উচ্চতর যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা নিম্নতম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের তত্ত¡াবধান ও নিয়ন্ত্রণ করবেন।
উচ্চ আদালতে বিচারক পদে নিয়োগে কোনো হার নির্ধারণ ছাড়া দুই শ্রেণীর ব্যক্তিকে যোগ্য করায় যেকোনো নিয়োগে উভয় শ্রেণী থেকে সমানুপাতিক নিয়োগ হওয়া অত্যাবশ্যক। এর ব্যত্যয় ন্যায়পরতা ও প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগের কর্মরত বিচারকদের ক্ষেত্রে সংবিধানে সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে, প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগে নিযুক্ত বিচারকরা কেবল ওই বিভাগে এবং অন্যান্য বিচারক কেবল হাইকোর্ট বিভাগে আসন গ্রহণ করবেন। সংবিধানে এরূপ সুস্পষ্ট নির্দেশনা বিবৃত্ত হওয়ায় প্রধান বিচারপতিসহ আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের কর্মে বহাল থাকাকালীন আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকাজ পরিচালনায় নিয়োজিত থাকা ব্যতীত অন্য কোনো কর্মে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ নেই।
প্রধান বিচারপতিসহ উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের সবধরনের প্রলোভনের ঊর্ধ্বে রাখতে বাহাত্তরের সংবিধানে তাদের সবার ক্ষেত্রে অবসর-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নিয়োগ সম্পূর্ণরূপে বারিত ছিল। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের অবসর-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক বিচারিক ও আধা-বিচারিক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য করা হয়। সেই সাথে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে অবসর-পরবর্তী আপিল বিভাগে ওকালতি করার যোগ্য করা হয়।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ কর্তৃক বাতিল ঘোষিত হলে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অবসর-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের বিচারিক ও আধা-বিচারিক পদে নিয়োগ এবং হাইকোর্ট বিভাগ থেকে অবসর-পরবর্তী আপিল বিভাগে ওকালতি করার যোগ্যতা ক্ষুণ্ন হয়। কিন্তু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়নের মধ্য দিয়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল কার্যকর করা হলেও পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের অবসর-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের লাভজনক বিচারিক ও আধা-বিচারিক পদে নিয়োগ লাভের সুযোগসহ হাইকোর্ট বিভাগ থেকে অবসর-পরবর্তী আপিল বিভাগে ওকালতি করার সুযোগ অক্ষুণ্ন রাখা হয়।
আইন কমিশন ও বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট আইনের দ্বারা সৃষ্ট সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। প্রথমোক্ত প্রতিষ্ঠানটির কাজ গবেষণার মাধ্যমে বিদ্যমান আইনের ত্রæটিবিচ্যুতি নির্ধারণ এবং সময় ও যুগের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যমান আইনের সংশোধন এবং ক্ষেত্রবিশেষে নতুন আইন প্রণয়ন। প্রথমোক্ত প্রতিষ্ঠানটিতে চেয়ারম্যান ও মেম্বার হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিসহ আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের নিয়োগ লাভের কোনো সুযোগ নেই। এ প্রতিষ্ঠানটিতে অতীতে প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের নিয়োগ সংবিধানের সুস্পষ্ট বিধানের অবজ্ঞা ও উপেক্ষায় সম্পন্ন করা হয়েছিল।
বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের পদটি একটি প্রশাসনিক পদ। পদটির সাথে বিচারিক বা আধা-বিচারিক কাজের কোনো সংশ্লেষ নেই। কিন্তু বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট আইন, ১৯৯৫-এ সংবিধানের সুস্পষ্ট বিধানের লঙ্ঘনে মহাপরিচালক বিষয়ে বলা হয়- সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বা বিচারক ছিলেন বা বিচারক হওয়ার যোগ্য কোনো ব্যক্তি মহাপরিচালক হবেন। সংবিধানের বিধানের সাথে অসামঞ্জস্য এমন কোনো বিধান দ্বারা আইনের মাধ্যমে যোগ্য করা হলে তা সংবিধানের অবমাননার শামিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের সাথে লক্ষ করা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি সূচনালগ্ন থেকে এটির মহাপরিচালকের প্রশাসনিক পদে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিসহ আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের নিয়োগদান করা হয়ে চলছে।
নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের পদ প্রশাসনিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে আধা-বিচারিক। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বা হাইকোর্ট বিভাগের কর্মরত কোনো বিচারকের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ লাভ সংবিধান কোনোভাবে অনুমোদন করে না। কিন্তু সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনে ইতঃপূর্বে একাধিকবার এ ধরনের নিয়োগকাজ সম্পন্ন হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ নিয়োগ অপ্রত্যাশিত এ কারণে যে, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল-পরবর্তী এ ধরনের নিয়োগ কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এ ট্রাইব্যুনালের বিচারক পদে নিয়োগ লাভে যে যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে তা হলো- সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে কর্মরত অথবা বিচারক ছিলেন অথবা বিচারক হওয়ার যোগ্য ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান অথবা মেম্বার হবেন। বিধানটি সংবিধানে বিবৃত প্রধান বিচারপতি ও হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত বিচারকদের বিচারকার্য পরিচালনা বিষয়ে আসন গ্রহণবিষয়ক বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের কোনো পদে সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বিচারকের নিয়োগ সংবিধান কোনোভাবে অনুমোদন করে না।
বাহাত্তরের সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসরের বয়স ছিল ৬২ বছর। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে অবসরের বয়স ৬২ থেকে ৬৫-তে উন্নীত করা হয় এবং তদপরবর্তী চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করা হয়। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক বাতিল ঘোষিত হলেও বয়স বৃদ্ধির সুযোগটি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত রাখা হয়।
সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিসহ অপরাপর উভয় বিভাগের বিচারকরা কাজে নিয়োজিত থাকাকালীন নিজেদের সম্পূর্ণরূপে সবধরনের লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে রেখে যেন বিচারকাজ পরিচালনায় রত থাকতে পারেন সে মহৎ উদ্দেশ্যে তাদের অবসর-পরবর্তী নিয়োগ বারিত করে বেতনের সমপরিমাণ অবসরভাতা এবং আকর্ষণীয় আনুতোষিক প্রদানের বিধান করা হয়। তা ছাড়া অবসর-পরবর্তী তারা চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যয়িত অর্থ সুপ্রিম কোর্টের জন্য নির্ধারিত খাত থেকে নির্বাহের সুযোগ পেয়ে থাকেন। সুপ্রিম কোর্টে বিচারক পদে কাজে বহাল থাকাকালীন প্রায় সবার ক্ষেত্রে রাজউকের প্লট প্রাপ্তির সুযোগ ঘটে। এতসব সুযোগ-সুবিধার পরও যদি কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত যেকোনো বিচারক সংবিধান অনুমোদন করে না এমন কিছু প্রাপ্তির আশায় রত থাকেন তা সামগ্রিকভাবে দেশ ও জাতি এবং বিশেষত বিচার বিভাগের জন্য মর্যাদাহানিকর।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা