২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পোশাক শিল্পে ভালো-মন্দের দোলাচল

- ছবি : সংগৃহীত

নানা গোলমালে তৈরি পোশাক শিল্পে একটি বিপর্যয় যাচ্ছে। কিন্তু আশা ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্র্যান্ড নেম কাজে লাগিয়ে খাতটিতে একটি জাম্পিং আসবে। তিনি কথাও দিয়েছেন এ খাতসংশ্লিষ্টদের। সেই আলোকে বিদেশী ক্রেতাদের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতা ও পরিবেশের নমুনাও দেখা যেতে থাকে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় চলতি বছরের জুন-জুলাইতে তৈরি পোশাক রফতানিতে ভাটার টান পড়লেও আগস্টে সেখানে জোয়ারের প্রাবল্য বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করা যায়। আগস্টে এক মাসে পোশাক রফতানি হয়েছে অন্তত সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার। কিন্তু দিন কয়েক যেতে না যেতে সেপ্টেম্বরে ঘটে বিপত্তি। এই অস্থিরতা কমে এলেও পুরোপুরি উপশম হয়েছে, এমন বলা যাবে না।

আজ এখানে, কাল সেখানে গণ্ডগোল পাকতে দেখা যাচ্ছে। ঢাকা-লাগোয়া সাভার-আশুলিয়া-গাজীপুরে যেন এ খেলার এক খোলা ময়দান। রফতানিমুখী শিল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতের সাধারণ কারখানাও হামলা-লুটপাট থেকে বাদ যাচ্ছে না। চার দিকে যখন সংস্কার সংস্কার আওয়াজ, তখন নানান ছুঁতায় রাস্তায় নেমে শ্রমিক বিক্ষোভ। পরিস্থিতি কারা উত্তপ্ত করছে, তা মালিক-বিনিয়োগকারীরা ভালো বলতে পারবেন। সরকারেরও না বোঝার কথা নয়। কিন্তু অ্যাকশনটা ঢিলেঢালা। এই ফাঁকে বাংলাদেশ থেকে বিলিয়ন ডলার মূল্যের বিদেশী অর্ডার প্রতিবেশী ভারত ছাড়াও প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় চলে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আসন্ন স্প্রিং মৌসুমের পোশাক উৎপাদন নিয়ে বড় ধরনের জটিলতা আঁচ করছেন তৈরি পোশাক কারখানা মালিকরা।

খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের বড় দিন উপলক্ষে প্রতি বছর স্প্রিং মৌসুমে ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার পেয়ে থাকে বাংলাদেশ। শার্ট, প্যান্ট, কোট ও জ্যাকেটের মতো সব ফ্যাশনেবল আইটেম তৈরি হয় এ মৌসুমে। নভেম্বরের মধ্যে উৎপাদন শেষ করে পৌঁছাতে হয় বিদেশী বায়ারদের কাছে। সেখানে এখন ছেদ পড়ার আশঙ্কা।

এ শঙ্কার পাশাপাশি আশাবাদও আছে। অর্ডারগুলো ফেরত আসা নির্ভর করছে বর্তমান সরকারের ভাবমর্যাদা ও অবস্থানের ওপর। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূসের ইমেজ কাজে লাগানোর ওপর। তার সুপরিচিত বিশ্বজোড়া। ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর গোটা বিশ্ব বাংলাদেশের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনে বিশ্বের প্রভাবশালী নেতারা তার কাছে বাংলাদেশের জন্য সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সংস্কার, রাষ্ট্র মেরামত, গতিহীন অর্থনীতি চাঙা করাসহ সব ধরনের সহায়তার প্রস্তাব দেন। এমন একটি সুবাতাসের মধ্যে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুরসহ আশপাশে গার্মেন্টে বিশৃঙ্খলা ও আগুন পোড়া গন্ধ।

ভালোর মধ্যে এ মন্দের বাতাবরণ মোটেই যেনতেনভাবে দেখা যায় না। বাংলাদেশের অর্থনীতির সাথে গার্মেন্ট খাত অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সত্তরের দশকের শেষদিকে অন্যতম রফতানিমুখী এ শিল্প খাত সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। ক্রমাগত বাড়তে থাকে এ শিল্পের যাত্রা। বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের মধ্যে কেবল ওভেন শার্টের প্রথম অর্ডারটি রফতানি হয় ১৯৭৮ সালে। এরপর বিদেশী ক্রেতাদের আগ্রহ বেড়ে যায় বাংলাদেশের প্রতি। আমাদের দেশে এ শিল্প দ্রুত উন্নতির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১৯৮১-৮২ সালে মোট রফতানি আয়ে এ খাতের অবদান ছিল মাত্র ১.১ শতাংশ। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য মোট রফতানিতে বাংলাদেশ ৫০ শতাংশ অবদান রেখে রফতানি আয়ে শীর্ষস্থানে ছিল। আশির দশকের শেষার্ধে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের আয়কে ছাড়িয়ে পোশাক শিল্প রফতানি আয়ে প্রথম স্থানে চলে আসে, যা ছিল তখনকার সময়ে আমাদের সফল অর্জন, পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালে এ শিল্প খাতে সরাসরি কর্মসংস্থান হয় ১.৪ মিলিয়নেরও বেশি লোকের, যার মধ্যে ৮০ শতাংশ নারী। তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের সাথে সাথে বস্ত্র, সুতা, আনুষঙ্গিক উপকরণ, প্যাকেটজাতকরণের উপকরণ ইত্যাদি শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট পরিবহন, ব্যাংকিং, শিপিং এবং ইন্স্যুরেন্সসহ অন্যান্য সেবার চাহিদাও ক্রমে বাড়তে থাকে। এর সবটা অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে। বছর কয়েক আগেও কোভিড-১৯ চলাকালেও এ শিল্প খাত বাংলাদেশের সর্বত্র চালু ছিল। সে সময় ভয়াবহ বিপদ মোকাবেলা করে বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে ক্রেতাদের চাহিদা মিটিয়ে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছিল, যা নিঃসন্দেহে বিশ্বের সর্বত্র দৃষ্টান্তস্বরূপ।

ম্যাপড ইন বাংলাদেশ-এমআইবির সর্বশেষ তথ্যানুসারে, দেশে বর্তমানে রফতানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা চার হাজার ১১৪টি। এর মধ্যে পোশাক শিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য দুই হাজার ৮৩১। আর এ দুই সংগঠনের সদস্য নয় এমন কারখানার সংখ্যা এক হাজার ২৮৩। পোশাক কারখানায় ৪০ লাখ শ্রমিকসহ ৬০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। গ্রামের ৩০ লাখ নারী স্বাবলম্বী হয়ে আর্থিকভাবে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন পোশাক শিল্পে কাজ করে।

গণতন্ত্র হত্যাকারী হাসিনা রেজিমে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পোশাক আমদানিকারক যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা বাতিল করলেও এখন ফিরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসপির পাশাপাশি আরো কিছু সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রফতানিমুখী এ শিল্পে কিছু মালিক রয়েছেন যারা হাসিনার তাঁবেদার হিসেবে চিহ্নিত এবং তারা গার্মেন্ট শিল্প থেকে আয়ের বড় অংশ দিয়ে কানাডার বেগমপাড়ায় বাড়ি, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, লন্ডন, দুবাই, সিঙ্গাপুরে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। তাদের পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এদের কেউ কেউ ভারতীয় অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে নিজের কারখানার শ্রমিকদের বেতন বন্ধ করে তাদের রাস্তায় আন্দোলনে নামার কৌশল নিয়েছেন।

বর্তমানে তৈরি পোশাক রফতানিতে বিশ্বে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান সুবিধাজনক স্থানে; যদিও শীর্ষ স্থানে রয়েছে চীন। ডব্লিউটিওর বর্তমান বৈশ্বিক হিসেবে, মোট পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের দখলে ৬.৪ শতাংশ হিস্যা। ক্রেতারা চাহিদা অনুযায়ী সব কাপড় এবং সহায়ক উপকরণ সরবরাহ করে থাকেন। তাদের নির্দেশিত উৎস থেকে বাংলাদেশী উপ-চুক্তিকারকদের পোশাক তৈরির জন্য কাপড় আমদানি করতে বলেন, কাপড় এবং সংশ্লিষ্ট উপকরণ পাওয়ার পর উপ-চুক্তিকারকরা বিদেশী ক্রেতাদের দেয়া নকশা অনুযায়ী কাপড় কেটে ও সেলাই করে মোড়কে বেঁধে রফতানি করা হয়। কোটাসংস্কার আন্দোলন দমাতে ফ্যাসিস্ট হাসিনা হেন কোনো অপকর্ম নেই যা করেননি। সেই জেরে ক্ষতি হয়েছে এই রফতানিমুখী খাতটির। ঢাকায় দেশী-বিদেশী বায়িংহাউসগুলোর শীর্ষ ব্যক্তিরা সমস্বরে বলেছেন, দমবন্ধ করা সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা।

আকস্মিক বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ের মতো মাঝেমধ্যেই মানুষের ফুঁসে ওঠার দেশ, বাংলাদেশ। রাজনৈতিক দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের দেশ, গণ-অভ্যুত্থানের দেশ। এই ভূখণ্ডে ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর অভ্যুত্থান এবং নব্বইয়ের অভ্যুত্থান ঘটেছে। সবচেয়ে যুগান্তকারী ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। সমাজ এগিয়ে যায় কিন্তু লাখ-কোটি মানুষের অংশগ্রহণে গড়া আন্দোলনের ফলে সেই প্রভাব সমাজ থেকে হারিয়ে যায় না। বারবার সঙ্কটে পড়লে দেশের মানুষ এসব আন্দোলন থেকে প্রেরণা নেয়, শক্তি পায়।

২০২৪-এর জুলাই আন্দোলন এত তীব্র হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগের অত্যাচার, অহমিকা ও অপমান করার বিরুদ্ধে ক্ষোভ যেমন কাজ করেছে, অতীত আন্দোলনের শিক্ষাও তেমনি ভূমিকা পালন করেছে। অতীতের গণ-অভ্যুত্থানে আইয়ুব খান ১০ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি, এরশাদ ৯ বছরের মধ্যে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ১০ বছরের বেশি থাকতে পারেনি। গণ-আন্দোলনের চাপে তাদের পদত্যাগ ও দেশত্যাগ করতে হয়েছে।

দেড় হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু, চার শতাধিক মানুষের চোখ হারানো, হাজার হাজার আহত হওয়ার ঘটনা স্বাধীনতার আগে ও পরে কোনো আন্দোলনে দেখেননি বাংলাদেশের মানুষ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সহিংস কায়দায় দমন করতে গিয়ে এতো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। জুলাই বিপ্লবে হাসিনার শাসনের অবসান হয়েছে।

বিদেশী বায়ারদের এ বিশ্বাস আছে, বাংলাদেশ যেকোনো ধরনের সঙ্কট মোকাবেলা করতে জানে ভালোভাবে। ড. ইউনূসকে ঘিরে ওই বিশ্বাস আরো মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে সেখানে চলছে একটি আলোআঁধারি খেলা। এর লাগাম টানতে হবে। এ অরাজক পরিস্থির জন্য প্রতিবেশী দেশের দিকে অভিযোগের তীর। তারা এসব ঘটনা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অপপ্রচারের ঝাণ্ডায় বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠানসহ সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ইমেজ সঙ্কট জোরদার করতে চায় বলে অ ভিযোগটি বেশ জোরালো।

আলামত বুঝে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি মেনে নিয়ে মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই করে দেয়া হয়েছে। তারপরও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীরা ফাঁকফোঁকরে শ্রমিকদের চটাচ্ছে।

কারখানাগুলোতে গত দুই দশক ধরে মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে শ্রমিকদের দূরত্ব ছিল। দাবি-দাওয়া উত্থাপনে শ্রমিকদের মধ্যে একটি ভয়ের সংস্কৃতি কাজ করত। এখন সরকার পরিবর্তনের পর শ্রমিকরা কথা বলতে শুরু করেছেন, ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আগে সব বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হবে। সব বন্ধ কারখানা সচল করতে হবে। পাশাপাশি কর্মকর্তাদের সাথে শ্রমিকদের সম্পর্কোন্নয়ন করে কারখানার ভেতরের পরিবেশ ভালো করতে হবে; যাতে বাইরের সুযোগসন্ধানীরা কোনো সুযোগ নিতে না পারে। না হলে, বর্তমান পরিস্থিতিতে গার্মেন্ট শিল্পে এভাবে অস্থিরতা বিরাজ করলে ব্যবসায় যেমন দিন দিন কমবে তেমনি পুরো খাতটি অস্থির হয়ে উঠবে। সেই সাথে যে পরিমাণ ইমেজ ক্ষতি হবে তা পুনরুদ্ধারে বেগ পেতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement