২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

রিসেট বাটন পুশড, এভরিথিং গন!

লেখক মুজতাহিদ ফারুকী - ছবি : নয়া দিগন্ত

“যাহ্! একি হলো হাল! ...রিসেট বাটনে পুশ করা মাত্র ১৯৫৪, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯, ’৭১, ’৯০, ’৯৬, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ সালের যত আন্দোলন এ দেশে সংগঠিত হয়েছিল, সব মুছে গেল! মুছে গেছে, ড. ইউনূসের পিতা-মাতা, নানা-নানী, দাদা-দাদীসহ পূর্বপুরুষদের পরিচয় ও কৃতিত্ব! এমনকি, ২০০৭ তে পাওয়া ড. ইউনূসের নোবেল সোনাটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! একমাত্র ’২৪ এর মহাবিপ্লব খাড়ায় আছে! শুকরিয়া! মারহাবা! ... ভয়েস অব আমেরিকায় সাংবাদিক আনিস আহমেদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেছেন, অতীত নয়- বাংলাদেশের ইতিহাস ২০২৪ থেকে শুরু হবে!”

এ উদ্ধৃতি সামাজিক মাধ্যমে একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিবভক্তের পোস্ট। বলা দরকার, ড. ইউনূসের ওই সাক্ষাৎকারের প্রতিক্রিয়ায় কথিত মুজিবভক্ত ও চেতনার অনুসারীরা যত প্রতিক্রিয়া ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন, তার মধ্যে উদ্ধৃত পোস্টটি সবচেয়ে শালীন ও ভদ্রোচিত। কিন্তু এখানেও সুশীল মুজিবভক্ত তাদের মুজিবীয় অসত্য ভাষণের প্রবণতা থেকে বেরুতে পারেননি। ড. ইউনূস একবারের জন্যও বাংলাদেশের ইতিহাস ২০২৪ থেকে শুরু হবে এমন কোনো কথা উচ্চারণ করেননি। তিনি যেটি বলেছেন তা মোটামুটি এরকম : ‘ছাত্ররা বলেছে, তারা রিসেট বাটন পুশ করেছে। এভরিথিং ইজ গন। অতীত নিশ্চিতভাবে চলে গেছে। এখন নতুন ভঙ্গিতে আমরা দেশকে গড়ে তুলব। দেশের মানুষও তা চায়।’

হ্যাঁ, অতীত নিশ্চিতভাবেই চলে গেছে। অতীত মানেই যা গত হয়ে গেছে, বিগত। কিন্তু আমাদের সুশীল পোস্টদাতা অতীত বলতে বুঝে নিলেন, ১৯৫৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে যত আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে সেগুলোকে নাকচ করা হয়েছে। বায়ান্নর কথা অবশ্য তার মনে পড়েনি। কারণ, ভাষা আন্দোলনে তার হিরোর কোনো ভূমিকা ছিল না।

শৈশবে আমরা অঙ্কের খেলা খেলতাম। একজনকে বলা হতো মনে মনে যেকোনো সংখ্যক কলা খেতে এবং কয়টা কলা খাচ্ছে সেই সংখ্যাটি মনে রাখতে। তারপর তাকে ওই সংখ্যার সাথে আরেকটি সংখ্যা যোগ করতে বলা হতো। যোগফলের সাথে আরো কিছু যোগ-বিয়োগ ইত্যাদি করানোর পর প্রশ্নকর্তা বলে দিত প্রথম পক্ষ মনে মনে কয়টি কলা খেয়েছিল। অর্থাৎ ধরে নেয়া সংখ্যাটি কত ছিল। এই মনে মনে ধরে নেয়ার ব্যাপারটিকে বলা হতো মন-কলা খাওয়া। আমাদের স্থানীয় ভাষায় মুনকলা। মনকে আঞ্চলিক উচ্চারণে আমরা বলতাম ‘মুন’। কিছু ভুলে গেলে বলতাম, মুনে নাই, অথবা মুনে হারাইছি। তো আমাদের বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিবভক্ত ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকার শুনে মুনকলা খাওয়ার মতোই কিছু কল্পনার আশ্রয় নিলেন। বললেন, ‘মুছে গেছে ড. ইউনূসের পিতা-মাতা, নানা-নানী, দাদা-দাদীসহ পূর্বপুরুষদের পরিচয় ও কৃতিত্ব!’ আহা! অতীত মুছে যাওয়ায় সে কী কষ্ট তার! বুক ফেটে যায়! কিন্তু জনাব সুশীলের মনে একবারও উঁকি দিলো না, জাতির জীবনের সর্বশেষ ১৬টি বছরের মসিলিপ্ত অধ্যায়। কী সেই ইতিহাস? ছাত্ররা রিসেট বাটন পুশ করে সেই কালো অধ্যায়টিই তো মুছে দিয়েছে। শেখ হাসিনার হিজাব, তাহাজ্জুতের ভুয়া প্রচারণার আড়ালে এক নৃশংস প্রতিহিংসার রাজত্বের অবসান ঘটিয়েছে। সেটি মুছে দিয়েছে এমনভাবে, যেন তা কখনো ছিল না।

গত ১৬ বছরের ইতিহাস হলো উন্নয়নের ধুয়া তুলে অবিরাম মিথ্যাচার, বেপরোয়া হত্যা, খুন, গুম, ব্যাংক লুট, রিজার্ভ লুট, দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির। ছিল সব নিয়মনীতি, শালীনতা, বিচার-আচার, সংবিধান, আইন-কানুন আউটফলে ছুড়ে দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করার স্বাধীনতার ইতিহাস। ছিল দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে প্রতিবেশীর স্বার্থ তার প্রাপ্যের চেয়েও বেশি দিয়ে দেয়ার। তিনি তো মহামহিম, তাকে যে ক্ষমতায় থাকতেই হবে। বাংলাদেশে তার কোনো বিকল্প নেই। সত্যিই তাই, জনগণের টাকা খরচ করে বিশ্বের ২৭টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেনা ডক্টরেট ডিগ্রি আর কার আছে এই অজ্ঞ মূর্খ বর্বরের দেশে?

অন্ধ সুশীলদের জন্য এই লেখা। বলতে চাই, ড. ইউনূস কথিত রিসেট বাটন কি ছাত্ররাই প্রথম পুশ করেছে? কারা অস্বীকার করেছে ইতিহাসের সত্য? বাংলাদেশ বা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীর ইতিহাস কি ১৯৪৭ থেকেই শুরু? কই গত ৫৪ বছরে সেরকম কোনো আলাপ তো আপনাদের মুখে শুনতে পেলাম না! এদেশের মানুষ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেনি? ১৭৫৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৯০ বছরে বাঙালি মুসলমানের আর কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস নেই? নাকি সেগুলোও আপনাদের বাংলার সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি সম্পন্ন করেন? গত ৫৪ বছর ধরে মুজিববন্দনার অভ‚তপূর্ব জোয়ার দেখে তো মনে হচ্ছিল- এদেশে ভাসানী, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী- কারোরই জন্ম হয়নি। কোনো পাঠ্যবইয়ে কোনো নেতার গল্প নেই, একমাত্র মহান মুজিব ছাড়া। যেন বাঙালি মুসলমানের আর কোনো হিরো নেই। এই দেশ ও জাতির অগ্রগতিতে আর কারো কোনো অবদান বা ভ‚মিকা নেই। অথচ গত ৫৪ বছরের ইতিহাসে এক দিক থেকে মুজিবের চেয়েও বড় ভ‚মিকা জিয়াউর রহমানের। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ না করলে বিশ্ব জানতেই পারত না, বাঙালিরা স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছে।

আরো পেছনে যদি যাই, হাজী শরিয়তউল্লাহ ও দুদু মিয়ার ফরায়েজি আন্দোলন, তিতুমীর, ওহাবি আন্দোলন, আহলে-হাদিস আন্দোলন- এগুলো তো এই ভ‚খণ্ডের হাজারো মানুষের সম্পৃক্ততায় বেগবান হয়েছিল ভারতজুড়ে। সেসব আন্দোলনের কাহিনী আমাদের স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে নেই কেন, ইতিহাসে নেই কেন? ড. ইউনূসের দাদা-দাদী, নানা-নানীরা তো ওইসব আন্দোলনে জড়িত ছিলেন অথবা আলোড়িত হয়েছিলেন। সেসব আন্দোলনের ওপর বইঘরে রাখলে হাসিনার পুলিশ এসে ছেলেদের জঙ্গি বলে ধরে নিয়ে যেত অথবা গুলি করে মেরে বলত- এনকাউন্টারে মরেছে।

তাহলে ইতিহাস মুছে ফেলেছে কারা! কারা জাতিকে অতীত ভুলিয়ে দেয়ার প্রয়াস পেয়েছে? শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ আরো বড় যে অপরাধ করেছে সেটি হলো- শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে হিন্দু প্রতিবেশীর সুপারিশকৃত বিকৃত ও বিজাতীয় ইতিহাস সংযোজন। এ অপরাধের কোনো ক্ষমা হয় না।

স্বাধীনতার ঘোষক এবং মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার শহীদ জিয়ার নাম মুছে ফেলারও কী জঘন্য ও হীন ষড়যন্ত্রই না করেছে হাসিনা! তার পরিবারের বিরুদ্ধে নৃশংস নিপীড়নই শুধু চালানো হয়নি; জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে, যিনি নিজে এদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দস্যুর মতো বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে বানোয়াট মামলায় বছরের পর বছর কারাবন্দী রাখা হয়েছে।

সুতরাং ছাত্ররা যে রিসেট বাটন পুশ করেছে সেটি যথার্থ। দেশ নতুন করে গড়তে হলে পেছনের দিকে তাকানোর দরকার আছে শুধু একটি কারণে। অতীতের গৌরবময় উদাহরণ থেকে প্রেরণা আহরণের জন্য। কিন্তু আমাদের তরুণরা পেছনে তাকালে গৌরবের কিছু দেখতে পাচ্ছে না। দেখছে দুর্নীতির দায়ে মন্ত্রিত্ব হারানো এবং দেশ শাসনে চরমভাবে ব্যর্থ এক মিথ্যাবাদী, একগুঁয়ে, মানবিক বোধবুদ্ধিহীন ব্যক্তি নির্বিবাদে জাতির জনক হয়ে বসে আছে। তরুণরা কেন সেই ইতিহাসের দিকে চোখ রাখবে? তার চেয়ে তো রিসেট বাটন চেপে রাখাই ভালো। সামনে এগোনোর পথ খুলবে।

জুলাই বিপ্লবের ছাত্র সমন্বয়কদের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতারা ছিল। এ তথ্য প্রকাশের পর অনেকে সচকিত, বিস্মিত। অনেকে হতাশ। যেন বিশ্বের নবম অত্যাশ্চর্য এই মাত্র আবিষ্কার হলো। যেন ছাত্ররা অত্যাচারী ফ্যাসিস্ট শাসককে তাড়িয়ে মহা অন্যায় করে ফেলেছে। এর ফলে স্বাধীনতাবিরোধী, সা¤প্রদায়িক শক্তি রাজনীতির মূল ধারায় চলে আসছে বা এসেছে। আহা, কী সর্বনাশ! ভয়েস অব আমেরিকার আনিস আহমেদের কণ্ঠেও সেই উৎকণ্ঠা। তিনি ড. ইউনূসকে সেই মোক্ষম প্রশ্নটি করলেন একটি অস্ত্র অব্যর্থ অস্ত্র নিক্ষেপ করার মতোই। কিন্তু ড. ইউনূস যে উত্তর দিলেন তার জবাব নেই। বললেন, আমাদের সংবিধান সবাইকে কথা বলার অধিকার দিয়েছে, সবাইকে রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে, আমি রাগের বশে তাকে আমার দুশমন ভেবে তাকে বেঁধে ফেলতে, অধিকার কেড়ে নিতে পারি না। রাষ্ট্র এটা করতে পারে না। সে অপরাধী হলে বিচার হবে।

কিন্তু গত অবৈধভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সরকার গত ১৬ বছর ধরে ঠিক সেই কাজটিই করেছে। জামায়াত শিবিরকে স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গি তকমা তো শুরু থেকে দেয়া হতোই। কিন্তু একাত্তরে শুধু জামায়াত শিবিরই কি স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল? আর কোনো দল বা গোষ্ঠী কি বিরোধিতা করেনি? যদি করে থাকে তাহলে সেই সব স্বাধীনতাবিরোধীদের নামও কেন গত ৫৪ বছরে সামনে আনা হলো না? কেন স্বাধীনতাবিরোধী সেসব দল ও নেতাকর্মীদের বিচার এবং শাস্তি বিধানের পরিবর্তে কারো কারো মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হলো? কেন শুধু একটি দলের বিরুদ্ধে ঘৃণার বারুদ ছড়িয়ে দেয়া হলো, রাজপথে পিটিয়ে, পায়ে মাড়িয়ে হত্যা করা হলো সে দলের কর্মীদের?

এসব প্রশ্নের জবাবও শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে দিতে হবে গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement