০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ পৌষ ১৪৩০, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৫
`

নতুন বাংলাদেশের রূপরেখা

- প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর স্বাভাবিকভাবে প্রয়োজন ছিল সংবিধানের ওপর গণভোট নেয়া, কিন্তু তা হয়নি। পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি পরিপূর্ণ সংহতি প্রকাশ করে এর অধীনে নির্বাচিত সদস্যরা স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের অনুমোদন দিলেন; যা ছিল তাদের এখতিয়ারের বাইরে। সংবিধানের গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারেও গণভোটের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার তোয়াক্কা না করে শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফার বাইরে গিয়ে যে সংবিধান কার্যকর করা হয়েছিল তা ছিল এ দেশের ৯০ শতাংশ জনগণের চিন্তাচেতনা ও জীবনাচারের সাথে সাংঘর্ষিক। সাংঘর্ষিক ছিল এ দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাতিসত্তার সাথেও। পরিণামে পাহাড়ি জনপদে গড়ে ওঠে নতুন জাতিসত্তার আন্দোলন। যার তিক্ততা আজো আমাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বস্তুত কোনো দেশের সংবিধান সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবনাচারের সাথে যেমন সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে থাকে; তেমনি সে দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জাতিসত্তার নিরাপত্তা এবং স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। এ ব্যাপারে শুরু থেকে বাংলাদেশের সংবিধান দেশের সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু কারোর চিন্তাচেতনা ধারণ করতে তা বলা যাবে না। পরিণামে বারবার সংবিধান সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজনের নামে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। এভাবে শুরু থেকে সাংবিধানিকভাবে বিভাজিত হয়েছে আমাদের জাতিসত্তা। অথচ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে অখণ্ড ভারত ভেঙে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের সৃষ্টি। একই ভাষাভাষী হওয়া সত্তে¡ও ভারতের কোনো অংশ পাকিস্তান বা বাংলাদেশের সাথে যোগ দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেনি। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর জীবনবোধ, বিশ্বাস এবং জীবনাচার। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধও সঙ্ঘটিত হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা বলে।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ও ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব বাংলাদেশের সংবিধানের চালিকাশক্তি হওয়া উচিত। ১৮৫৭, ১৯০৫, ১৯৪৭-এর তাৎপর্য বিবৃত করা আবশ্যিক, সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখনের সময়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক এবং নির্মোহ ইতিহাস ভবিষ্যৎ পথচলায় অবশ্যই প্রতিফলিত হতে হবে সংবিধানের প্রতিটি ধারায়! পাকিস্তানের সাথে দেনা-পাওনার হিসাব মেটাতে হলে সঠিক ইতিহাস এবং প্রমাণ ছাড়া এগোনো যাবে না।

এ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ছিনতাই হয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পুনরুদ্ধার প্রয়োজন। পরিবারতন্ত্র এবং ‘দেশের মালিক পরিবার’ এর চূড়ান্ত যবনিকা টানা প্রয়োজন। ব্যক্তি বিশেষের ওপর দেবত্ব আরোপের অবসান নিঃসন্দেহে নতুন আলোর পথের অভিযাত্রার সূচনা করবে।

সংবিধান পুনর্লিখনে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সংসদ, বিচার বিভাগ এবং প্রশাসন বিভাগের ক্ষমতার ভারসাম্য বিধানের ব্যবস্থা জাতিকে গণতান্ত্রিক অভিধায় আলোকিত করবে নিঃসন্দেহে। সব আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে অনুমোদিত হওয়া ছাড়া কার্যকর না করার বিধান অবশ্যই থাকতে হবে।
দলীয় এবং সরকারপ্রধান আবশ্যিকভাবে আলাদা থাকার বিধান থাকা একনায়কতন্ত্রের অভিলাষকে প্রতিহত করবে নিঃসন্দেহে। টানা দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হওয়াকে সাংবিধানিকভাবে প্রতিহত করতে হবে।

স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, কমিশনের ক্ষমতা, তার প্রয়োগ সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা প্রয়োজন; যেন নির্বাচনের সময় কমিশন প্রভাবিত না হতে পারে।

স্বাধীন বিচার বিভাগ গণতান্ত্রিক চেতনার মৌলিক অবকাঠামো। এটা সরকার এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখার বিধান সংবিধানে সংযোজিত হওয়া জরুরি। উপাসনালয়, শিক্ষাঙ্গন, ব্যবসাক্ষেত্র রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার সাংবিধানিক ব্যবস্থা ছাড়া গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধ বিকাশের অন্তরায়। প্রয়োজন সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষি প্রকৌশলী, সামরিক, আধা সামরিক, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে রাজনীতির বাইরে রাখার বিধান। কেউ রাজনীতি করতে চাইলে সরাসরি রাজনীতিতে যোগদানের মাধ্যমে করার বিধান সংবিধানে থাকা জরুরি।

দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ জাতিকে ভবিষ্যতে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হবে। সংসদে প্রত্যেক সদস্য নির্বাচিত হবেন। কোনো সদস্য সর্বোচ্চ টানা দুইবারের বেশি থাকতে পারবেন না। এতে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হবে। দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারীরা প্রজাতন্ত্রের কোনো চাকরিতে বা সংসদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা হারাবেন। একজন সংসদ সদস্য বা স্থানীয় সরকারে নির্বাচন প্রার্থীর শিক্ষাগত, পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক যোগ্যতার মাপকাঠি অত্যন্ত জরুরি। যারা দেশের জন্য আইন তৈরি করবেন তাদের সার্বিক যোগ্যতা, সততা, ন্যায়পরাণয়তা এবং নিরপেক্ষতার প্রামাণ্য ব্যবস্থা থাকাটা বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সংবিধানে সন্নিবেশিত হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন।

সাম্প্রতিক ছাত্র-গণ-আন্দোলনের সফলতা জাতিকে বেশ কিছু সম্ভাবনা এবং চেতনার বিশ্বাসকে সামনে টেনে এনেছে। এর প্রথমটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বয়ানের অসারতা। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র নামক অদ্ভুতুড়ে চেতনার খিচুড়ি, যা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, ৬ দফা ও বর্তমান বাস্তবতার সাথে খাপ খায় না। ভারত উপমহাদেশে হাজার বছরের মুসলিম শাসনে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস নেই। অথচ ১৯৪৭ পরবর্তী ভারতে হাজারেরও বেশি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে। একই আদলে বাংলাদেশ এর সহযাত্রী এবং সহযোগী হতে পারে না। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত। এর নিশ্চয়তা থাকতে হবে সংবিধানে।

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতা হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সংখ্যাগুরু অধিবাসীর যাপিত জীবনের নির্যাস, সামাজিকতা, নৈতিকতাবোধ, ভ্রাতৃত্ব, সমানাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, দায়বদ্ধতা এসবের প্রতিফলন থাকবে সংবিধানে এটাই জনগণের প্রত্যাশা।

একটি স্বাধীন জাতির গৌরবময় ইতিহাসের ধারিবাহিকতা এবং প্রেরণা সংবিধানে প্রতিফলিত হবে এটাই স্বাভাবিক। সংবিধান রচনার পর গণভোটে তা পরীক্ষিত হতে হবে। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা থাকলেও তা সন্তর্পণে ও কৌশলে সংবিধানে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এটা স্পষ্টত স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। একই সাথে দেশকে ব্যক্তি বা পরিবারের দাসানুদাসে পরিণত করার কৌশলী প্রয়াসও স্বাধীনতার চেতনার সাথে ও গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

’৭১-এর স্বাধীনতার পরপর গজিয়ে ওঠা সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ৯০ শতাংশ জনগণের আশা, আকাক্সক্ষা, চিন্তাচেতনা এবং ঐতিহ্যের বিসর্জন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। প্রত্যাশিত ছিল না মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ইসলামী আদর্শ ও চেতনার অনুসারীদের ধর্মান্ধ, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অভিধায় অভিযুক্ত করা; সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার অপকৌশল। ভোটাধিকারের নামে ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়ার মহোৎসব, দায়বদ্ধতার নামে ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের অভিযাত্রা; নির্বাচন, সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চরিত্র হননের অবারিত এবং অপ্রতিরোধ্য গতির প্রতিযোগিতা চিরতরে বন্ধ করার ব্যবস্থা সংবিধানে অবশ্যই থাকতে হবে।

বর্তমান ছাত্রজনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের সফলতা সুযোগ এনেছে সংবিধানকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবনাচার, আদর্শিক প্রেরণা ও সাংস্কৃতিক চেতনার আবহে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে ঢেলে সাজানোর; দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্যকে ধারণ করে নতুন চেতনার আলোকে সংবিধান সংশোধন করা। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চর্চা এবং চেতনার লালনে সংবিধান নতুন করে সংশোধন করা জাতির প্রত্যাশা। কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা পরিবারকে আজীবন রাষ্ট্রীয় খরচে নিরাপত্তা বিধান অপসৃত হোক সাংবিধানিকভাবে চিরতরে। একক জাতিসত্তার পরিচয়ে যাত্রা শুরু হোক নতুনভাবে।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
সিরাজ সিকদার-আবু সাইদ হত্যা একই সূত্রে গাঁথা : রাশেদ প্রধান আন্দোলনে আহত রাতুলকে আর্থিক সহায়তা দিলো বিজিবি গাবতলীতে দিনমজুরকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ বিএসএমএমইউ পরিচালকের পদত্যাগে আলটিমেটাম রাবিতে পোষ্য কোটা বাতিল কবরস্থানে চাঁদাবাজির অভিযোগে বিএনপি নেতা বহিষ্কার ২০২৫ সেশনের জন্য ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমিটি গঠন দিনাজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কচির পদ স্থগিত দুই জেলায় বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত, একটিতে স্থগিত সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়া হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা রোববারের মধ্যে বাংলাদেশ-ভারতে আটক জেলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শেষ হবে

সকল