২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

নতুন বাংলাদেশে নিজের দিকে তাকাই

- প্রতীকী ছবি

লোকে যারে বড় বলে বড় সে হয়
আমি কেমন তা আমি জানি, তবে পুরোটা জানি না। অন্যের চোখে আমি কেমন সেটিই আমার আসল পরিচয়। কেননা, নিজেকে নিজে ভালো জানা যথেষ্ট নয়। অন্যের চোখে আমাকে ভালো হতে হবে। লোকে যদি আমাকে ভালো বলে তবে তো আমি ভালো। আমি তো শুধু আমার জন্য নয়। অন্যের জন্যও আমি। অন্যরা যেমন আমার জন্য। আমরা পরস্পর পরস্পরের জন্য। আমি যদি অন্যের কাজে না আসতে পারি তাহলে আমার মধ্যে তো আমি বন্দী হয়ে গেলাম এবং অন্যের কাছ থেকে তাহলে তো আমি কোনো সাহায্যও পাবো না।

আমার আচার আচরণ, আলাপ ব্যবহার, কার্যকলাপ অন্যের কাছে কিভাবে ধরা দিচ্ছে সে সম্বন্ধে আমাকে সজাগ থাকতে হবে। কেউ দুঃখ পেতে পারে, মনে কষ্ট নিতে পারে, কারো অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে, কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ ধরনের কথা ও কাজ থেকে আমার বিরত থাকা উচিত। আবার একই সাথে আমার উচিত সবার সাথে ভালো ব্যবহার করা, অন্যের দুঃখে সমব্যথী হওয়া, বিপদাপদে সাহায্যে এগিয়ে আসা। এভাবে যদি প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য কিছু করাকে দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করি তাহলে আমি, আমরা এবং আমাদের মধ্যে আনন্দ ও সুখ শান্তি বিরাজ করবে। এই জগৎ সংসারে আমরা সবাই এক পরিবারের সদস্য। আমাদের মধ্যে এই উপলব্ধি কার্যকর থাকলে হিংসাবিদ্বেষবশত এবং ধর্ম, বর্ণ, বংশ ও অর্থনৈতিক অবস্থাভেদে সে ভিন্নতা ও বৈষম্য আর থাকে না। আমরা যদি পরস্পর থেকে নিরাপদ না হই তাহলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হবে সবাইকে।

আমি আমার নিজের দোষত্রুটিগুলো হয়তো অনেকসময় বুঝতে পারি না। এর জন্য অন্যেরা কী বলছে সেটি দেখতে হবে। পরিবারে মা-বাবা মুরব্বিজনরা আমাদেরকে হরহামেশা নানা উপদেশ দিয়ে থাকেন। তাদের সে কথাগুলো আমার শোনা উচিত নিজের ভুল শোধরানোর জন্য, নিজের দোষত্রুটি বোঝার জন্য এবং নিজেকে আরো ভালো করে গড়ে তোলার জন্য। বড়রা যে উপদেশ দেন তা তারা দিয়ে থাকেন তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে। তারা নিজেদের জীবনে ঠেকে ঠেকে যা শিখেছেন তার আলোকেই আমাদেরকে সাবধান হতে শেখান। আমরাও সে ধরনের ভুলের শিকার যাতে না হই, নিজেরাও যাতে তাদের দুঃখের কারণ না হই সে জন্য তারা বিভিন্ন উপদেশ আদেশ ও নিষেধের দ্বারা আমাদেরকেও সহায়তা করতে চান। এসবই তারা করেন আমরা যাতে সত্যিকার অর্থে আরো বড় হতে পারি। বড়রা ছোটদেরকে এভাবে বড় হতে সাহায্য করেন। আর এভাবে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ও সভ্যতা উন্নতি লাভ করে। জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, কর্মে একজন প্রকৃত বড় ব্যক্তি শুধু নিজে বড় নন, তিনি তার পরিবার, দেশ ও জাতি- সবার জন্য বড়। কেননা, তাকে অন্যরাও অনুসরণ করে। তিনি তার নিজের জীবনের মহৎ কর্মের দ্বারা সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য অনেক কল্যাণ বয়ে আনেন। তাতে উপকৃত হয় অনেকে।

আমি যদি একটি গাছ লাগাই, যে গাছ অনেককে অক্সিজেন দেবে, পাখপাখালির আশ্রয়স্থল হবে, সে গাছের ফল অনেকে খেতে পারবে, সে গাছের ছায়ায় পথিকের ক্লান্তি দূর হবে। আমার এমন একটি কাজের মাধ্যমে অনেকের অনেক উপকার হবে। আমার উচিত ‘অনেকের অনেক উপকার’ হয় এমন ধরনের কাজ করা। আবার আমি যদি এমন একটি কাজ করি যেমন যদি ধূমপান করি তাহলে কী হবে- ধূমপানে আমার নিজের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে, আমার ধূমপানের ধোঁয়া আশপাশের অনেকের ফুসফুসে ঢুকে তাদেরও ক্ষতির কারণ হবে। ধূমপানের দূষিত ধোঁয়া পরিবেশকে করবে কলুষিত। ধূমপানের দ্বারা আমার এবং আমার পরিপার্শ্বের কী ক্ষতি হচ্ছে, তা উপলব্ধি করেই আমাকে ধূমপান থেকে বিরত থাকা উচিত। আমি যদি ভালো একটি বই লিখি সে বই পড়ে পাঠক আনন্দ পাবে, শিক্ষা ও প্রেরণা পাবে; কিন্তু আমি যদি একটি কুরুচিপূর্ণ বই লিখি তা পাঠ করে পাঠকের কুরুচির দিকে ঝুঁকে পড়ার আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। সমূহ সর্বনাশের কারণ হবে সবারই। একজন ভালো লেখক, বড় মাপের চিত্রশিল্পী, নামকরা গায়ক, বরেণ্য অভিনেতা, আদর্শ শিক্ষক সবার জন্য অনুসরণীয়। নিজের সাধনায় তারা বড় হয়েছেন। সবাই তাদের দ্বারা উপকৃত হন- পথের দিশা খুঁজে পান। পক্ষান্তরে একজন মন্দ চরিত্রের মানুষ তার নিজের জন্য তো বটে অনেকের জন্য দুঃখ ও বেদনার কারণ। মানুষ কিন্তু নিজেই নিজের আনন্দ ও বেদনার কারণ হয়ে যায়। আমার দ্বারা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হোক, কষ্ট পাক, এটি আমার কাম্য নয়। আমার সাধনা হবে আমার থেকে কোনো অনিষ্ট নয়; ভালো কিছু যাতে অন্যেরা পায় এবং উপকৃত হয়। লোকে যখন আমাকে সেভাবে বড় হিসেবে দেখবে তখন আমি প্রকৃত বড় হবো।

যারা নিজেকে বিদ্বান ও বড় মনে করে এবং অন্যের ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেকেই ছোট করে। কেননা, নিজের বড়ত্ব জাহির করার বিষয় নয়, এর ফলে অহমিকা প্রকাশ পায়। অহমিকা নিজের ত্রুটি সম্বন্ধে নিজেকে অন্ধ করে দেয়। সে ক্ষেত্রে নিজেকে দেখা বা শোধরানোর সুযোগ হয় লাপাত্তা। এমতাবস্থায়, অন্যের কাছে নিজের অজ্ঞাত দোষত্রুটি ধরা পড়ার ফলে অপমানিত হতে হয়। আত্মসচেতন কোনো মানুষ অহমিকায় অন্ধ হতে পারে না। তার এই একান্ত ইচ্ছা বরাবরই বলবৎ থাকে যে, যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশেও নিজের আত্মসম্মানবোধ যেন জাগ্রত থাকে।

বড় হওয়ার জন্য জ্ঞানার্জন প্রয়োজন। জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞানের আলোকে অন্তরে ও বাইরে দেখা, জানা ও শোনার শক্তি বেড়ে যায়। শেখ সাদির গুলিস্তাঁর সেই মহান বাণী চিরস্মরণীয়- ‘বয়সে না বড় লোক, বড় হয় জ্ঞানে/জ্ঞান শ্রেষ্ঠতম ধন সকলেই জানে/টাকা থাকিলেই লোকে ধনী নাহি হয়/জ্ঞানীই প্রকৃত ধনী, নাহিকো সংশয়।’

জ্ঞানার্জনের জন্য শ্রম ও অধ্যবসায় আবশ্যক। আলোকিত মনের অধিকারী হতে চাই লেখাপড়ার প্রতি মনোনিবেশ। নানান বাধাবিপত্তি, অলসতা, অনিয়মের বাধাবিপত্তি, পাঠাভ্যাসে বিঘ্ন ঘটাতে পারে, তাকে অতিক্রম করতে হবে। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) যেমনটি বলেছেন, ‘পাছে কানে বিঘ্ন হয়, এই ভাবি মনে/কার্যে নাহি হাত দেয় যত নীচ জনে/একবার বাধা পেলে মধ্যম যে জন/হতাশ হইয়া করে চেষ্টা বিসর্জন/কোন কাজ ধরে যদি উত্তম যে জন, হউক সহস্র বিঘ্ন ছাড়ে না কখন।’

এড়িয়ে চলা চাই ক্রোধ, হিংসা, বিদ্বেষ আর প্রতিশোধস্পৃহা
ক্রোধ, হিংসা-বিদ্বেষ আর প্রতিশোধ নেয়ার স্পৃহা সর্বতোভাবে পরিহার করে চলা উচিত। প্রতিশোধস্পৃহা থেকে বাড়াবাড়ি ব্যক্তি ও সমাজে সুখ-শান্তি, সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। কেউ অত্যাচারিত হলে, প্রতিশোধ গ্রহণের প্রশ্ন আসে। কিন্তু প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষেত্রে সাম্যের সীমা লঙ্ঘিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ অত্যাচারে পর্যবসিত হতে পারে। শেখ সাদি যেমনটি বলেছেন- ‘মাটি হতে ওহে নর, তোমার সৃজন,/মাটির মতই নত হও সর্বক্ষণ।/আগুন হইতে তুমি তৈয়ারি তো নও,/উদ্ধত আগুন সম কেন তবে হও?/মুহূর্তে অনল হয় কেমন ভীষণ,/মুহূর্তে সে ছাই হয় ইহারি কারণ।/আগুন ভীষণ, তাতে জনমে দানব/মাটিতে জনম নর, সৃষ্টির গৌরব। (গুলিস্তাঁ শেখ সাদি)

হিংসা-বিদ্বেষে মানুষের মনের সুকোমল অনুভূতির অপমৃত্যু ঘটে। হিংসায় উন্মত্ত হয়ে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, বিদ্বেষের আগুনে তার অনুভূতি হয় আহত। অথচ মানুষের উচিত সব ব্যাপারে তার সুকোমল সুন্দর অনুভ‚তিতে আনত হওয়া। হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতিশোধস্পৃহা কারো একক বিষয় নয়। অন্যের আচরণে তার প্রতি এটি প্রক্ষেপিত হয়ে থাকে। সুতরাং পারস্পরিক আচার-আচরণ, ব্যবহার, লেনদেনের ক্ষেত্রে সবাইকে সতর্ক ভূমিকা পালন করতে হয়, যাতে হিংসা-বিদ্বেষ বা প্রতিশোধ গ্রহণের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব না হয়। বুঁস্তার কবির ভাষায়- ‘ব্যথা দিয়ে থাকো যদি তুমি কারো হৃদয়ে/একদিন প্রতিশোধ পেতে হবে তোমারো।/ঢিল যদি মেরে থাকো, কারো কোনো সময়ে/একদিন সেই ঢিল খেতে হবে তোমারো। (‘বুঁস্তা’-শেখ সাদি)

ক্রোধ আর রাগের বাহুল্য বহু অনিষ্টের কারণ হয় দাঁড়ায়। ক্রোধ ও রাগের কারণে অনেক নির্দয় অত্যাচারমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়। পরবর্তী সময়ে এ জন্য অনুশোচনা, অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হয়। সে কারণে রাগের সময় নিজেকে সম্বরণ করা কর্তব্য। উচিত কারণে-অকারণে রাগ প্রকাশ করা থেকে সর্বতোভাবে বিরত থাকা। আল্লাহ ‘মুত্তাকি’ বা আল্লাহভীরুদের প্রশংসামূলক পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন- ‘যখন তারা ক্রোধান্বিত হয় তখন তারা তা দমন করে।’ স্বাভাবিক অবস্থায় কাউকে ক্ষমা করে দেয়া সহজ ব্যাপার; কিন্তু রাগের সময় ক্ষমা অর্থাৎ রাগ সম্বরণ করা তেমন সহজ বিষয় নয়। রাসূল সা: বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তি বীর পুরুষ নয় যে অন্যকে ধরাশায়ী করে; বরং সেই প্রকৃত বীর যে রাগের সময় নিজেকে সম্বরণ করতে পারে।’

গোস্বা বা রাগ, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতিশোধস্পৃহা শয়তানের তরফ থেকে আসে। শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুনকে পানি ঠাণ্ডা করে। হাদিসে উপদেশ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘যদি কারো রাগ হয় তবে তার উচিত অজু করে নেয়া।’ অন্যের সুখ-সম্পদ নষ্ট হয়ে নিজে এর মালিক হওয়ার কামনা করাই হিংসা। শত্রুতা, অহঙ্কার, নিজের অসদুদ্দেশ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা, নেতৃত্বের লোভ, কাক্সিক্ষত অনুগত লোকদের যোগ্যতাবান হয়ে যাওয়া, কোনো সুযোগ-সুবিধা হাসিল না হওয়া, নীচতা ও কার্পণ্যের কারণে হিংসার উদ্ভব হয়। হিংসা থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ দিয়ে রাসূল সা: বলেছেন, ‘হিংসা নেক আমলকে খেয়ে ফেলে যেমনভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়।’ ভগবদ্গীতায় (অধ্যায়-২, শ্লোক-৬৩) একইভাবে ধ্বনিত হয়েছে,‘From anger, complete delusion arises, and from delusion bewilderment of memory. When memory is bewildered, intelligence is lost, and when interlligence is lost one falls down again into the meterial pool.’

গুলিস্তাঁর কবি বলেছেন- ‘শত্রুর মরণে সুখী হইও না ভাই/কে কখন মরে তার ঠিক কিছু নাই; পারো যদি ফলবান তরুর মতন/সবারে কল্যাণরাশী করো বিতরণ/না পারো নির্মুক্ত রও, একপাশে থাকো/সংসারের গোলযোগে জড়াইও নাকো।/যবে কারো পরে তব হয় রাগ অতিশয়/অতিশয় সাজা দেয়া তারে কভু ভাল নয়।/অমূল্য মুকুতা পারো সহজেই ভাঙ্গিবারে/ ভাঙ্গিলে আবার তাহা জুড়িতে কেহ না পারে।’

লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement