২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

মাথা কেটে ফেলা সমাধান নয়

সিলেটের শাহজালাল মাজার - ছবি : সংগৃহীত

এক তথ্যমতে, দেশে ৯৫০টি মাজার রয়েছে। রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান ছাড়া প্রত্যেক জেলায় মাজার আছে। বেশি মাজারের কারণে আউলিয়ার দেশ বলা হয় সিলেটকে। কমবেশি ১৬টি মাজার রয়েছে সিলেটে।

ইসলামের ইতিহাস পড়তে গিয়ে সুফিবাদের সাথে পরিচয়। মক্কা গিয়ে পবিত্র কাবাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করাকালেও সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে মন ছুটে এসেছিল বাড়িতে। এমন হওয়ায় আমার নিজের কাছে যে প্রশ্নটি মনে বার বার দোলা দিয়েছে তা হলো- আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে নামাজ ত্রুটিপূর্ণ হয়েছিল। মন ও শরীর মৌলিকভাবে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। পবিত্র কাবার সামনে দাঁড়িয়েও মনকে বশ করতে পারিনি। মনকে আল্লাহর পথে বশ করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম বলে মন চলে এসেছিল বাড়িতে।

অনেকে মনে করেন, মন বশের উপায় সুফিবাদ। সুফিবাদে ‘ফানা’ এবং ‘বাকা’ এ দুটো শব্দের ব্যবহার পাশাপাশি দেখা যায়। ‘ফানা’ অর্থ- লীন হওয়া। অর্থাৎ নিজেকে আল্লাহর রাহে লীন করা। ‘বাকা’ অর্থ- স্থিতি, স্থিরতা বা সংস্থাপক। মানুষের আত্মার দুটো অংশ। রূহ ও নফস। রূহ ঊর্ধ্বস্তরের এবং গুপ্ত, নফস নিম্নস্তরের এবং প্রকাশ্য। রূহ আল্লাহ প্রদত্ত অবস্তুগত, অমর ও পরম। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আছে- ‘আমি আমার নিজ প্রকৃতিতে আদমকে সৃষ্টি করেছি।’ ‘ফানা’ আর ‘বাকা’র মাঝখানে অবস্থান করে ‘প্রবৃত্তি’। ‘প্রবৃত্তি’ অর্থ- বস্তুগত মনোবাসনা, ইন্দ্রীয় পূজা, ইসলামের সুফি মতবাদে প্রবৃত্তির আরেক পরিচয় নফস।

‘নফসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে- নফসে আম্মারা, নফসে লাওয়ামা ও নফসে মুতমাইন্না। নফসে আম্মারা মনের মধ্যে কামনা, বাসনা, ভোগ, পাপ ও অহঙ্কার জাতীয় প্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলে। নফসে মুতমাইন্না হলো সর্বোৎকৃষ্ট শুদ্ধ ও শান্তমন। নফসে আম্মারার নাফসানিয়তের দ্বারা পাপকাজে লিপ্ত হওয়ার আগে নফসে মুতমাইন্না বাধা দেয়। একদিকে আম্মারার নাফসানিয়তের তাড়না আর অপরদিকে মুতমাইন্নার অসম্মতি- মন দোটানায় পড়ে যায়। এ দোটানা দোলা মনকে বলে নফসে লাওয়ামা। যার পরিষ্কার অর্থ- ‘দোদুল্যমান মন’। যখন নফসে আম্মারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন মানুষ পাপ করে, আর নফসে মুতমাইন্না শক্তিশালী হলে মানুষ পাপকাজ থেকে বিরত থাকে।

সুফি মতবাদ, সুফি দর্শন, সুফি তত্ত¡, মুসলিম মরমিবাদ ও তাসাওফ বর্ণনা করতে গিয়ে, প্রখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি রহ: বলেছেন, ‘তাসাওফ দু’টি গুণের নাম- একটি স্রষ্টার সাথে সদ্ব্যবহার বজায় রাখা এবং অপরটি সৃষ্টির সাথে সদ্ব্যবহার বজায় রাখা। যিনি স্রষ্টা ও সৃষ্টির সাথে সমভাবে সদ্ব্যবহার বজায় রাখতে পেরেছেন, তিনি প্রকৃত সুফি। কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু প্রকাশ করলে তা তাসাওফ নয়। সুতরাং বলা যায়, পবিত্র কুরআনের ভিত্তিতে কোনো বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে অনুসন্ধান চালিয়ে তার মূল উদ্ঘাটনে যে প্রচেষ্টা চালানো হয় তা-ই তাসাওফ। তাসাওফকে অন্য কথায় মুসলিম দর্শন বা সুফি দর্শন বলা হয়ে থাকে এবং তাসাওফ সাধকদের মুসলিম দার্শনিক বা সুফি সাধক বলা হয়ে থাকে।’

হজরত নিজামউদ্দীন রহ:-এর দরগাহর দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈয়দ আজিজ নিজামি সম্পাদিত হজরত সুলতান আল মাশাকে গ্রন্থে বলেন, সুফিবাদ কোনো মতবাদ নয়, এটি ¯স্রষ্টাকে ভালোবাসার মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা।

বাংলা মুল্লুকে আসেন হজরত শাহজালাল রহ:। তখন এ দেশে রাজা বল্লাল সেন, শশাঙ্ক, গৌড় গোবিন্দ রায় প্রমুখ প্রতাপশালী রাজার অবর্ণনীয় অত্যাচারের মধ্যেও আসেন শাহ সুলতান মাহি সওয়ার রহ:, শাহ কলন্দর রহ:, গরিব শাহ রহ:, মখদুম শাহ দওলাহ শহিদ রহ:, খান জাহান আলী রহ:, রাশতি শাহ রহ:, বদর পীর রহ:, সৈয়দ মিরান শাহ রহ:, কুতুব শাহ রহ:, শাহ সুলতান রুমি রহ:, শাহজামাল রহ:, নাসির উদ্দিন শাহ মীর নেকমর্দ রহ:, হজরত শাহ আলী বাগদাদী রহ:, শেখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা রহ: (সোনারগাঁ মোগড়াপাড়া) ও খাজা শরফুদ্দিন চিশতি রহ: (হাইকোর্ট মাজার)।

রাজা পৃথ্বিরাজ আগে থেকে মুসলমানদের সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত ছিলেন। মুসলমানদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে কোনো সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ না হলেও তাদের শৌর্যবীর্য, সাহস ও বীরত্বের কথা নানাভাবে জানতেন। পৃথ্বিরাজের বাবা সোমেশ্বর রায় একজন জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তিনি নানাভাবে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, অচিরে মুসলমানদের দ্বারা দিল্লি ও আজমির আক্রান্ত হতে পারে। তাই মৃত্যুর আগে তিনি তার ছেলেকে বলে গিয়েছেন-‘বৎস আমার অন্তিমকাল আসন্ন, মৃত্যুর আগে কিছু প্রয়োজনীয় কথা তোমাকে জানানো আবশ্যক। আমি জানতে পেরেছি, হিন্দুস্তানের কোনো রাজা তোমার বিরুদ্ধাচরণ করবে না, তবে তোমার রাজ্যে কোনো মুসলমান ফকির বা সাধু-সন্ন্যাসী আগমন করলে তাদের যেন কোনোরূপ অবমাননা করা না হয়। তিনি অনেক অসাধ্য কাজ সাধন করার যোগ্যতাসম্পন্ন। কোনো রাজশক্তি তার কোনো কাজে বাধা দান করে সফল হতে পারবে বলে মনে হয় না। বাবা পৃথ্বিরাজ, এ জন্য আমি তোমাকে পুনরায় সাবধান করছি, কখনো তোমার রাজ্যে যেন কোনো মুসলমান সাধু-দরবেশের প্রতি অন্যায়-অনাচার করা না হয়।’

হজরত শাহজালাল রহ: ছিলেন উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত দরবেশ। সিলেট অঞ্চলে তার মাধ্যমে ইসলামের প্রসার ঘটে। সিলেটের প্রথম মুসলমান শেখ বোরহান উদ্দিন রহ:-এর ওপর রাজা গৌড় গোবিন্দের অত্যাচার এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে হজরত শাহজালাল রহ: ও তার সফরসঙ্গী ৩৬০ অলির সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

সুদূর মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসে হজরত শাহজালাল রহ: সিলেটে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। হজরত শাহজালাল রহ:-এর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে হজরত নিজামুদ্দিন রহ: তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ তাকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন। সিলেট ও আশপাশের অঞ্চলে বর্তমানে যে সুরমা রঙের কবুতর দেখা যায় তা জালালি কবুতর নামে পরিচিতি পেয়েছে।

হজরত শাহপরাণ রহ: ছিলেন হজরত শাহজালাল রহ:-এর বোনের ছেলে। জন্ম ইয়েমেনের হাদরামাউত অঞ্চলে। ৩৬০ আউলিয়ার তিনিও একজন। হজরত শাহপরাণ রহ: শায়িত আছেন সিলেটের খাদিমপাড়ায়। সিলেট শহরের প্রায় আট কিলোমিটার পূর্বদিকে সিলেট-তামাবিল সড়ক থেকে প্রায় ০.৩ কিলোমিটার ভেতরে সু-উচ্চ ও মনোরম টিলায় অবস্থিত হজরত শাহপরাণের মসজিদ ও দরগাহ। মসজিদের পূর্বদিকে রয়েছে সমাধিটি। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাজার জিয়ারত করতে পুণ্যময় সিলেট ভ্রমণে আসেন।

সাম্প্রতি দেশের চারদিক থেকে মাজার ভাঙচুরসহ আগুন লাগিয়ে দেয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ দেশের সুফি-সাধকরা আল্লাহর পরহেজগার বান্দা হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। বিশ্বে মোট মুসলমানের প্রায় ১১ শতাংশ ভারতে বাস করে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৯১.০৪ মুসলমান। ভারতবর্ষে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি রহ:, খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী রহ: ও খাজা ফরিদউদ্দিন মাসুদ গঞ্জশাকের রহ: এবং খাজা সৈয়দ নিজামউদ্দিন রহ: ইসলাম প্রচার করেন। আর বাংলাদেশে হজরত শাহজালাল রহ: ৩৬০ অলিসহ ছড়িয়ে পড়েন পূর্ব বাংলার আনাচে-কানাচে।

এগারো শতকের দিকে সুফিদের ওপর চরম অত্যাচার নেমে আসে। আলেমসম্প্রদায়ের অনেকে তাদের ইসলামের সাথে সম্পর্কহীন বলে ঘোষণা করতে থাকেন। তাদের চরিত্রে নানা কালিমা লিপ্ত করে সমাজে হেয়প্রতিপন্ন করেন। অন্যদিকে, নানা প্রকার জাগতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে শাসকরা ওলামাদের কাছে পরামর্শ নিয়ে সুফি সাধকদের নানাভাবে নিপীড়ন করতে শুরু করেন। সুফিদের এই দুঃসময়ে আবিভর্‚ত হন ইমাম গাজ্জালি রহ:। তিনি শরিয়ার সাথে সুফি-দর্শনের সমন্বয় সাধন করে বহু বই লিখেন। এর পরপর একে একে আবির্ভূত হন ফরিদউদ্দিন আত্তার রহ:, আব্দুল কাদির জিলানী রহ:, খাজা ওসমান হারুনি:, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি রহ:, হজরত খাজা সৈয়দ নিজামউদ্দিন রহ: ও শাহজালাল রহ:। (আমার দেখা আরব, পৃষ্ঠা নং-২৩৮)

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- গত কয়েক দিন ধরে পত্রিকার পাতা খুললেই মাজার ভাঙার খবর পাওয়া যাচ্ছে। মাজার না ভাঙতে বিশিষ্ট বৃদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার সম্প্রতি রাজধানীর শাহবাগে মানববন্ধন করেছেন। আমাদেরও প্রশ্ন, কারা কোন মতলবে এসব মাজার ভাঙছেন? তারা কি আদৌ সমাজের স্থিতি চান; নাকি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে মাজার ভাঙছেন? এটি খতিয়ে দেখা দরকার।

আমাদের বক্তব্য হলো- স্বাধীনভাবে যে কেউ নিজ নিজ আদর্শ চর্চা করার অধিকার রাখেন। শুধু দেখার বিষয় তা যেন দেশ-সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতায় কোনো নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে। তাই পরিশেষে একথা বলা যায়, যেসব মাজার ভাঙচুরসহ পোড়ানো হয়েছে সেসব মাজারের ভক্তরা যদি ‘কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু প্রকাশ করেন তা তাসাওফ নয়।

পবিত্র কুরআনের ভিত্তিতে কোনো বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে অনুসন্ধান চালিয়ে তার মূল উদঘাটনে যে প্রচেষ্টা চালানো হয় তা-ই তাসাওফ’-এ সংজ্ঞা থেকে যারা বিচ্যুত হয়েছেন, তাদের সঠিক পথে আনার চেষ্টা করা উচিত। তা না করে মাজার ভাঙচুরসহ জ্বালাও-পোড়াও করলে, মাথা ব্যথার কারণে ব্যথা নিরাময়ের ট্যাবলেট না খেয়ে মাথা কেটে ফেলার শামিল হবে বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement