২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আশা

আশা - ছবি : সংগ্রহ

মুরশিদাকে নিয়ে এলো মমতাজ। এক নিঃশ্বাসে আমাকে বলল, আপা উনি মুরশিদা, উনার কেউ নেই। ভালো ছেলে পেলে বিয়ে করবে। উপায় নেই কী করবে, বাসা ভাড়া, থাকা-খাওয়া অনেক টাকার দরকার। এত টাকার উপার্জন করার ক্ষমতা তার নেই। কাজ করে যা পায় সে তা দিয়ে সংসার চলে না। জিনিসপত্রের যা দাম কুলিয়ে উঠতে পারে না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিয়ে করে সম্মানের সাথে বাঁচবে। আমার সাথে অনেক দিনের পরিচয়, ভালো মানুষ।

আমি তাকে ভালো করে দেখলাম। বয়স ৩৮/৪০ হবে। তার পর জানতে চাইলাম পরিচয়, সংক্ষিপ্ত জীবন ইতিহাস ইত্যাদি। মুরশিদা নিজের জীবন সম্পর্কে বলতে লাগল।

আমার নাম মুরশিদা। বগুড়া জেলায় মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম। বাবার নিজের সম্পত্তির থাকায় চাষাবাদ করে যা আয় হয়, বছর চলে যায়। তিন ভাই আর এক বোন হওয়ায় সবার আদরে বড় হয়েছে। তিন ভাই তার দিকে খুব খেয়াল রাখে। বোন একটু ব্যথা পেলে মনে হয়, নিজেই ব্যথা পেল। এভাবে কেটেছে শৈশব। আস্তে আস্তে বয়স বাড়তে লাগল। ভাইরা সবসময় বোনের আবদার মেটাতে চেষ্টা করে ৷গঞ্জের বাজারে যাবে, জিজ্ঞেস করে কী আনতে হবে- চুড়ি ফিতা, মালা, নূপুর, আলতা ইত্যাদি নানা আবদার ৷তিন ভাই বড় হয়ে গেছে ৷বাবার সাথে কাজ করার পাশাপাশি ব্যবসা করে আর্থিক সচ্ছলতা বেড়ে যায় বোনের বায়না পূরণে অস্থির, ভাইদের চোখের মণি সে ৷ মুরশিদা কৈশোরে পা দেয়৷ তার প্রাণ-চঞ্চলতা হাসি-খুশিতে ঘর মেতে উঠে ৷ বাবার সংসারে ঠিক যেন সূর্যের মতো আলোকিত করে রেখেছে ৷ সুন্দর সুখের দিন কাটাচ্ছে ৷ এমন করে সুন্দর সময় দ্রুত বই যায় টের পাওয়া যায় না ৷ যৌবনে পদার্পণ করল মুরশিদা ৷

মা-বাবা এবার মেয়ের বিয়ের কথা ভাবছেন ৷ সুন্দর ফুটফুটে হাওয়ায় বিয়ের জন্য ছেলে পেতে অসুবিধা হয়নি ৷ঘটকের মাধ্যমে বিয়ে ঠিক করে একটু দূরের গ্রামে বশির মিয়ার ছেলে কামাল মিয়ার সাথে ৷ মিয়া বাড়ির ছেলে বলে কথা ৷ দেখতে সুন্দর, লম্বা, কাজে কর্মে ভালো। এমন কর্ম ছেলেই খুঁজছিল মুরশিদার বাবা ৷ ছেলে মুদির দোকান, সচ্ছল পরিবার ৷এমন ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, ঘটকের কথা শুনে সবাই খুশিতে আটখানা, ছেলে তো নয় যেন ননীর পুতুল। নম্র ভদ্র কিছু লেখাপড়া করেছে ৷ কয়েক বছর বিদেশ করে এসে বড় একটা মুদির দোকান দিয়েছে গঞ্জের বাজারে৷

ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন হলো ৷ নতুন একটা ঘর পাততে যাচ্ছে মুরশিদা চোখে মুখে আনন্দ ৷ নতুন শাড়ি গহনা পরে নতুন সাজে সেজেছে নতুন সংসারের আশায় ভাবছে, নতুন সংসার কিভাবে ঘুচাবে ৷নতুন মা, বাবা, ননদ, দেবর নিয়ে নতুন সংসার ৷ নতুন ঘর নতুন বর, তাদের সাথে মিশে নতুনভাবে জীবনের পরিবর্তন করতে হবে ৷ একদিন ছেলে হবে মেয়ে হবে তাদের বড় করতে হবে তাদের বড় করতে হবে ৷ স্বামীর পাশে থেকে সংসার সুখের চিন্তায় বিভোর ৷ স্বামী কামালকে নিয়ে নানা সুখের মালা কিভাবে গাঁথবে পরিকল্পনা৷ মনে মনে খুব খুশি ৷ গায়ে বান্ধবী, চাচা, চাচি, ভাই, বোন, খেলার সাথে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেল নতুন ঠিকানায়৷

খুব সুন্দর একটা সংসার পেল ৷ বছর ঘুরতে তার কোলে এলো ছেলে ৷ তবে আস্তে আস্তে পালটাতে লাগল কামালের স্বরূপ ৷ প্রথমে মুরশিদাকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে, 'বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে এসো, ব্যবসায় লাভ হলে টাকা ফেরত দেব। কিছু মালামাল জমা করে রাখলে সামনের সিজনে বেশি লাভে বেচা যাবে ৷ সহজ সরল মুরশিদা তার বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা এনে দেয়, ব্যবসা যদি বড় হয় ৷ টাকা এনে দেয়ার পর কামালের খুশি বেড়ে যায় এবং মুরশিদার আদর বেড়ে যায় ৷ মুরশিদা আদর পাওয়ার লোভে মাঝে মধ্যে বাবার কাছ থেকে টাকা এনে দিত ৷ সে টাকা আর ফেরত দেয়ার চিন্তাও করে না কামাল ৷ নানা কৌশল অবলম্বন করতে থাকে বাবার কাছ থেকে টাকা আনার জন্য ৷

বাবার একটা সীমা আছে। আর কত দেবেন। এক পর্যায়ে আর টাকা দিতে অস্বীকার করলেন আর তখনই শুরু হয় অশান্তি। কামালের আসল রূপ প্রকাশ পেতে লাগল ৷ তার নেশাগ্রস্ত অবস্থা প্রকটভাবে ধরা পড়ল। কামাল তাকে মারধর করে প্রতি রাতে ৷আস্তে আস্তে বুঝতে পারে, তার স্বামী লোভী, চরিত্রহীন, লম্পট, মাতাল ৷মেয়ের কষ্টে বাবা একদিন হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায় ৷ দুই বছর পর একদিন মা মারা গেলেন ৷ ভাইদের সংসার আলাদা হলো ৷

দুই চার বছরের মধ্যে সময়ের স্রোতে সংসারে পরিবর্তন হলো ৷মুরশিদাকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকে, এখন আর টাকা আনতে পারে না ৷ কামালের হিংস্রতা বেড়ে যায়৷ ঘরে বাজার নেই, খাবারের জোগাড় নেই, ছেলে স্ত্রীর প্রতি কোনো মনোযোগ নেই৷ তার ব্যবসা যা ছিল সব শেষ ৷ ক্রমেই নিজেকে সংসার থেকে আড়াল করতে লাগল ৷

ক্রমেই মুরশিদা তার শত্রু হতে লাগল ৷সংসারে অশান্তি নিত্য, মারামারি ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকে ৷বেশি সময় বাইরে কাটায়, মুরশিদার সাথে কোনো কথা নেই ৷ অর্ধাহারে অনাহারে তার দিন চলছে ৷ শিশু বাচ্চার প্রতিও কোনো দয়া নেই ৷ তবু সে স্বামীর সংসার আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করে ৷ অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে যায় ৷ মুরশিদা ভাবে, সংসার ছেড়ে যদি চলে যাই সমাজ আমাকে খারাপ বলবে ৷ চোখ, মুখ, কান বন্ধ করে সংসার করার চেষ্টা করে ৷ কামাল আর বাসায় আসে না, যদিও মাঝে মধ্যে আসে, কোনো কথা নেই ৷

অবশেষে হতভাগীনি মুরশিদা তার ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয় ৷ সংসার এমন একটা জায়গা পেছনে ফিরে, সে জায়গা আর থাকে না ৷ অভাগি যেদিকে যায়, সাগর সেদিকে শুকায় ৷ ভাইদের কাছে আসে, কিন্তু তিন ভাইয়ের তিন সংসার ৷ কার কাছে যাবে? বড় ভাই আদর করে কাছে নিলো। কিন্তু তার বউ মোটেও সহ্য করতে পারছে না ৷ দুজন মানুষ- খাওয়া, পরা, থাকা ৷মেজভাইয়ের উপার্জন কম ৷ আমি নিজেই কষ্টে আছি, তোকে খাওয়াব কিভাবে৷ ছোট ভাইয়ের কাছে থাকার জায়গার ব্যবস্থা হলো ৷ ভাই তাকে ছাড়তে পারল না ৷ কিন্তু তিন বউ শলাপরামর্শ করে, বড় দুই বউ ছোট বউকে বলে কেন থাকতে দিবি ইত্যাদি নানা কথা ৷ দুই বউয়ের কথা শুনে ছোট বউ বিগড়ে যায় ৷ কোনো ভাইয়ের ঘরে শান্তি মেলে না৷

সময় সুযোগমতো কথা শুনাতে কার্পণ্য করে না ৷হাতে মারিত না যত মারিত তত ঠোঁটে ৷ অনাদর অবহেলায় জীবনের প্রতি বিরক্ত ৷ভাইয়েরা একদিন বলে দিলো, 'শোন তোর ছেলেকে ওর বাপের কাছে রেখে আয়। তোকে একটা বিয়ে দিয়ে দেই।'
উপায়ন্তর না দেখে বাধ্য হয়ে নাড়ি ছেঁড়া ধন রেখে এলো তার বাপের কাছে ৷ ছেলে দূরে রেখে চোখের পানি শুধু মোছে ৷ ছেলের কষ্টে অনেক দিন খাওয়া নাওয়া, ঘুম বন্ধ৷ জীবন সংগ্রামের কাছে হেরে ছেলেটাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে ৷একদিন একটা লোক ধরে বিয়ে দিয়ে দেয় ৷ছেলে ঢাকায় চাকরি করে ৷ হাসপাতালের পরিচ্ছন্নকর্মী ৷ বিয়ে করে ঢাকায় নিয়ে আসে ৷ ছোট একটা বাসা করে। আবার সংসার ঘুচানোর স্বপ্ন দেখে ৷কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। স্বপ্নের কথা স্বপ্নই রয়ে গেল ৷এখানে আরো বেশি যন্ত্রণা

একদিন মুরশেদা হাসপাতালে চাকরি নেয় ৷ দুজনে চাকরি করে কঠিন সংসার করে৷ মুরশেদা চাকরি করে যা বেতন পায়, পুরোটাই নিয়ে নেয় তার দ্বিতীয় স্বামী নাসির ৷ গ্রামের সহজ সরল মেয়েটা শহরে এসে কী করবে দিশেহারা ৷ নাসিরের কাছেও সুখী হতে পারেনি, তারপরও হাল ছাড়েনি ৷নাসিরের সাথে সংসার করার জন্য যত কষ্ট হোক, সহ্য করার সংকল্প করেছে ৷তা না হলে তার যে আর থাকা খাওয়ার জায়গাও থাকবে না ৷ নাসিরও চরম নেশাখোর ৷নেশার টাকা যোগাড় করতে সব রকম অপকর্ম করতে পারে ৷ অত অত্যাচারের পরও তাকে সে ছাড়ে না ৷তবুও শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারল না।

পাষাণ্ড নাসির ছয় মাসের বাসা ভাড়া বাকি রেখে মুরশিদাকে একা ফেলে চলে গেল৷ অত টাকা বাসা ভাড়া দিবে কিভাবে ৷ অপেক্ষা করতে থাকে নাসির ফিরে আসবে ৷ ফোন দেয়া হলে ফোন ধরে না ৷ বন্ধু, স্বজনদের বাসায় খুঁজতে থাকে ৷ কোথায় গেল? বার বছর ঢাকায় থেকে চাকরি করে, মনের অজান্তে নিজেও অনেক বুঝতে শিখেছে ৷ নানা জায়গায় খোঁজ করে। কিন্তু কোথাও সন্ধান পেল না ৷

এদিকে বাড়িওয়ালা ভাড়ার জন্য চাপ দিতে থাকে ৷ ত টাকা পাবে কোথায়৷ ঘরে যা আসবাবপত্র ছিল তা বিক্রি করে বাড়ি ভাড়া সামান্য পরিশোধ করে। খাবার যোগাড় করবে কোথা থেকে ৷ হাসপাতালে যে চাকরি করত, সেটা বছরখানেক আগে ছেড়ে দিয়েছে ৷ নাসির মেরে হাত ভেঙে ফেলেছে, সে হাত দিয়ে তেমন কিছু করতে পারে না ৷ অধিক দুঃখে সে পাথর হয়ে গেল ৷ বাসা থেকে বের করে দেয়া হলো৷

এখন যাবে কোথায়? মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এমন কোনো বোঝা কাউকে দেয় না যা বহন করার ক্ষমতা কারো নেই ৷বিশাল পৃথিবীতে কেউ না কেউ আছে যার মনে একটু মায়া আছে ৷ আশ্রয় জুটল খালাত বোনের ছেলের বাসায়। খাবার দেবে কে? ভাগিনার সংসার তেমন সচ্ছল না ৷ সেখানে থেকে অন্যে বাসায় কাজ করে খাবারের জোগাড় করে। এখানে ওখানে বান্ধবী, পরিচিত জনের কাছে আসে আশ্রয় নিরাপত্তার আশায়। আবারো যদি ভালো মানুষ পায় বিয়ে করবে, শান্তির আশায়। এখনো আশায় আছে একজন ভালো মানুষের।


আরো সংবাদ



premium cement