করোনার গ্রাস
- আজিজা বেগম
- ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ১৪:০৫
সাভারে একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করে শহিদুল৷ ছোট্ট একটা বাসায় সুখেই দিন কাটাচ্ছেন ৷ একজনের উপার্জনের সংসার চলে ৷ খুব শান্ত স্বভাব ৷ লেখাপড়া খুব মেধাবী হওয়ায় এসএসসি পাসের পর টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ নিজেকে জোগাড় করতে হয়েছে ৷ বাবা গরিব কৃষক হওয়ায় তার লেখাপড়ার খরচ যোগাড় করা সম্ভব হয়নি৷ তাই বলে সে থেমে থাকেনি৷ সংগ্রাম করেই জীবনে উপরের ধাপে উঠতে হয়- কথাটি সে ভালোভাবেই জানে৷
নরসিংদী জেলা অজপারা গায়ে তার পৈত্রিক বাড়ি ৷ সেখান থেকে লেখাপড়া শেষ করে বিভিন্ন কাজের সন্ধান করতে থাকে ৷ গ্রাজুয়েশন করে মর্যাদা অনুযায়ী চাকরি না পেয়ে সাভারে ছুটে আসে জীবিকার সন্ধানে ৷এখানেও শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাচ্ছে না ৷এখন কী করবে শহিদুল? হন্যে হয়ে কাজ খোঁজ করছে ৷ জীবনের কাছে কোনো দিন হার মানেনি ৷ হার মানবেও না৷ আল্লাহর উপর ভরসা করে ছুটছিল কাজের পেছনে ৷ অবশেষে চাকরি পেল একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৷বেতন খুব কম৷ নন-এমপিওভুক্ত হওয়ায় কোনো বাড়তি সুবিধা নেই ৷ কিন্তু আছে সম্মান। তবে এ বেতনে তো আর জীবন চলবে না ৷ বেছে নিতে হলো টিউশনি৷পরিশ্রম অনেক। তবে এ দিয়ে সে শুরু করল তার উপার্জন এখন তার বিয়ে করতে হবে ইচ্ছে হওয়াটা ই স্বাভাবিক ৷ মা-বাবার পছন্দে বিয়ে করে৷
ছোট একটা বাসায় উঠে শহীদুল শুরু হয় তার নতুন জীবন। স্কুল, টিউশনি, সংসার চলতে থাকে৷জীবন চলে জীবনের গতিতে। তাদের ঘরে আসে নতুন অতিথি ৷অল্প আয়ের সংসার ৷ ইচ্ছে হলেই আর বেশি সন্তান নেয়া যায় না৷স্বল্প আয় হলেও চাহিদা বেশি না থাকায় তিনজনের সংসার বেশ আনন্দেই চলছে দিন ৷আর সাত বছর পর এক কন্যা সন্তানের আগমনে ঘর আলোকিত হয়ে উঠে ৷এভাবেই দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় ৷
আসে ২০২০ সাল ৷ মহামারিতে সারা পৃথিবী আক্রান্ত ৷ ক্রমেই ধ্স নামছে পৃথিবী৷ মৃত্যুর তাণ্ডব৷ করোনা ছড়িয়ে পড়ছে একজনের থেকে অন্যজনের শরীরে৷ চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছে, একজনের হলে পরিবারের সবাই আক্রান্ত হবে ৷ ক্রমেই মানুষ ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে৷ কখন, কোথায়, কিভাবে আক্রান্ত হচ্ছে কেউ বলতে পারছে না ৷ তাই বন্ধ করে দেয়া হলো পুরো বাংলাদেশ ৷ একে বলে লকডাউন ৷ কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবে না ৷ শুরু হলো আরেক সংগ্রাম ৷ঘরে বসে থাকলে খাবার দেবে কে?
কঠিন রকমই অবস্থা শহীদুলের ৷স্কুল বন্ধ, টিউশনি বন্ধ। উপার্জনের কোনো পথ খোলা নেই ৷ এভাবেই আরো অনেক শহীদুল বেকার হতে লাগল ৷
হাতে যা ছিল তা শেষ 'শুরু হলো ধার-দেনা ৷ এখন আর কেউ ধারও দিতে চায় না ৷ কে দেবে কাকে? আস্তে আস্তে মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে নামতে লাগল ৷ এক বেলা খায়, অন্য বেলায় উপাস ৷ এভাবে কয়েক মাস যাওয়ার পর লকডাউন কিছুটা শিথিল হয় ৷
কয়েক মাস যাওয়ার পর শহীদুলের হাত শূন্য ৷তার পৈত্রিক সম্পত্তি না থাকায় সেখানে ফিরে যওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই শহীদুলের ৷ যেভাবেই হোক এখানে থেকেই বাঁচতে হবে৷ তাই চেষ্টার পর চেষ্টা চালাতে থাকে৷ বাসা ভাড়ার টাকা জমতে থাকে৷ বাড়িওয়ালা টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে ৷ কী করবে? নিরূপায় ৷করোনা রোগটি এমন যে নিরাপদ থাকলে হলে একজন মানুষ থেকে অন্যজন কমপক্ষে তিন ফুট দূরে থাকতে হবে ৷মহামারির ভয়ে দূরত্ব বজায় থেকে না খেয়ে কত দিন থাকা যায়? '
আবার সে টিউশনি করার চেষ্টা করতে লাগল ৷ আস্তে আস্তে পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হতে লাগল, শহীদুলের টিউশনি বাড়তে লাগল ৷
২০২১ সাল৷ আবার শুরু হলো করোনা মহামারি ৷ আবার শুরু হলো লকডাউন। ফের শুরু হলো না খেয়ে থাকার পালা ৷এমনই একদিন শহীদুলের গায়ে জ্বর অনুভব করছে, সাথে অল্প গলা ব্যথা ৷ পয়তাল্লিশ বছরের শহীদুল এখনো শরীর যৌবন ভরা ৷ভাবে কিছুই হয়নি৷ সেরে যাবে। নিজের শরীরের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে পরিবারের খাবার যোগানোর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে ৷
হঠাৎ একদিন অজ্ঞান হয়ে গেল মাথায় পানি দিয়ে পাশে ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ এনে খায় ৷ কোন কাজ হচ্ছে না ৷ ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে ৷ ডাক্তার দেখানো? টাকা কোথায় যে দেখাবে ৷ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া? প্রশ্নই আসে না ৷ সে একাই সংসারের অভিভাবক। এমন কেউ নেই যে তার পাশে দাঁড়াবে ৷ ছেলেটা কলেজে পড়ে৷ লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পারছে না ৷ টাকা হাতে থাকলে ডাক্তার-কবিরাজের অভাব হয় না ৷কিন্তু তার হাতে নেই টাকা ৷ ডাক্তার হয়তো ফিস দিয়ে দেখল, কিন্তু ওষুধ- প্যাথলজি খরচ কোথা থেকে আসবে? ওই কারণেই নিজেকে সুস্থ ভাবতে শুরু করেছে ৷ কিন্তু একদিন তার নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল৷ প্রতিবেশীরা জানতে শুরু করেছে, শহীদুল অসুস্থ ৷ তার বাসার পাশেই দুই শিক্ষক থাকেন ৷ তাদের মায়া হলো ৷তাদের সহায়তায় তার ছেলে তাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালের দিকে ছুটল ৷ টাকা যোগাড় হলো। আশেপাশে প্রতিবেশী- যাদের জীবন জীবিকা ও অর্থ কষ্টে কঠিন পর্যায়। তারাই তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো ৷
অ্যাম্বুলেন্স ছুটছে শহীদুলকে নিয়ে৷ এ হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ৷ খালি সিট নেই বলে সব হাসপাতালই বিদায় করে দেয় ৷ যে হাসপাতালে সিট আছে, সেখানে তাদের টাকা নেই৷ এভাবেই সারাদিন অ্যাম্বুলেন্সে ৷ আস্তে আস্তে অক্সিজেন লেভেল কমতে শুরু করে ৷ অ্যাম্বুলেন্সে যে অক্সিজেন সিলিন্ডার ছিল সেটা শেষ ৷এখন কী করবে? বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে একটু অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা তো করতে হবে ৷ কিন্তু আশপাশে বেসরকারি হাসপাতালও পাওয়া যাচ্ছে না।
অবশেষে অ্যাম্বুলেন্সচালক বলল, তার পরিচিত একটি হাসপাতাল আছে। সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছুটে চলল অ্যাম্বুলেন্স। হাসপাতালে নেয়া হলো, অক্সিজেনের ব্যবস্থা হলো। কিন্তু অক্সিজেন আর দেয়া হলো না। সকল মায়া ত্যাগ করে পৃথিবীর থেকে বিদায় নিলো শহীদুল। সামনে পরে রইল তার দুই সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।