২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

সাকিব নিশ্চয়ই অত বোকা নন

-


বাঁ হাতি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান হয়তো হোম অব ক্রিকেটের সবুজ গালিচা, গ্যালারির হর্ষধ্বনিতে বিদায় নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে নয়। তাই মিরপুরের মায়ার টানে লাঞ্ছিত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। বরং অন্তঃপুরের লড়াই থামিয়ে কানপুরে যবনিকা টেনে দেয়াই পরিস্থিতি বিবেচনায় নিরাপদ ও সম্মানজনক হবে সাকিবের জন্য। ফরম্যাট যাই হোক, ২২ গজে আপন গতিতে ব্যাটিংয়ে অভ্যস্ত তিনি। ক্রিকেটের অভিজাত, বিশুদ্ধ ফরম্যাটে ক্যারিয়ার শেষের বিন্দুতে এসে একটু বিচক্ষণ হওয়া তো এখন সময়ের দাবি। জেনেশুনে সাকিব বিপদের দিকে পা ফেলবেন না। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার নিশ্চয়ই এত বোকা নন।

গত বৃহস্পতিবার কানপুরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাকিব আল হাসান বলেছেন, আগামী অক্টোবরে মিরপুরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজের বিদায়ী টেস্ট খেলতে চান এবং দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তার খেলার পথ নির্বিঘ্ন করতে সব ধরনের কাজ করছে বিসিবি।
নব্য বোর্ড সভাপতি ফারুক আহমেদের বরাত দিয়ে দেশের সর্বকালের সেরা এই ক্রিকেটার বলেছেন, সভাপতির সাথে কথা হয়েছে তার, সংশ্লিষ্ট সবার সাথে আলোচনা করবে বিসিবি। আয়োজনটা কিভাবে সুন্দর করা যায় সেই চেষ্টায় আছে দেশের ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
কিন্তু ঠিক কয়েক ঘণ্টা পর মিরপুর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ফারুক আহমেদ যা বলেছেন, তাতে সাকিবের আশায় গুড়েবালি। বোর্ড সভাপতি স্পষ্ট করে বলেছেন, অক্টোবরে সাকিবের দেশে অবস্থানকালীন নিরাপত্তা ও পরে দেশ ত্যাগের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে বিসিবির করণীয় কিছু নেই।

দেশের ইতিহাসের সেরা ক্রিকেটারকে প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা দিতে গিয়ে পানিতে পা ভেজাতে রাজি নয় বিসিবি। ফারুক আহমেদ, একজন সাবেক ক্রিকেটার, সাবেক অধিনায়ক। মোদ্দা কথা ক্রিকেটের লোক। এমন বোর্ড সভাপতির কাছে সবার প্রত্যাশা ছিল অনেক। কিন্তু প্রশাসনিক পদে বসে তিনিও ক্রিকেটারদের পাশে দাঁড়াতে অপারগ। ফারুকের বক্তব্য, বিসিবি সাকিবের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে না। এ দায়িত্ব সরকারের।
পুরো কাসুন্দির মূলে দেশের পট পরিবর্তন ও সাকিবের ছয়-সাত মাস স্থায়ী রাজনৈতিক পরিচয়, যা কারোই অজানা নয়- এটা বাস্তবতা। বিসিবির অবস্থান না বদলালে দৃশ্যত কানপুরেই সাদা পোশাকে সাকিবের বিদায় হতে যাচ্ছে সাকিবের।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে সাকিবের মতো এমন তারকা আসেনি কখনই। ভবিষ্যতেও সাকিবের বিকল্প খুঁজে পাওয়া যাবে কি না তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। মেহেদী হাসান মিরাজে অনেকে সাকিবের বিকল্প ভাবলেও মক্কা বহু দূর। তিন ফরম্যাটেই বিদায় নেয়ার দ্বারপ্রান্তে সাকিব। দেশে যদি আসতেই না পারেন তাহলে ২০২৫ সালে ওয়ানডে ফরম্যাটের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও খেলা হবে না তার। সুখের তীব্র অনুভূতির সাথে দুঃখের বেদনায় মর্মাহত হয়ে ব্যর্থতায় মুষড়ে পড়ার গল্প দুই জায়গাতেই রয়েছেন সাকিব। যদিও কোনোটাই চিরস্থায়ী হতে পারেনি। দেখতে হয়েছে মুদ্রার দুই পিঠই। বাংলাদেশের বড় সাফল্য মানেই যেন ছিলেন সাকিব।

২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত হিসাব করলে সাকিবের ক্যারিয়ারটা এগিয়েছে অনেকটা মাধ্যমিক পর্যন্ত স্কুলবালকদের জীবনের মতো। ঝড়ঝঞ্ঝা, তর্ক, বির্তক যে একদম ছিল না তা নয়, তবে সেসবের বেশির ভাগ ছিল সামলে নেয়ার মতো। সমর্থকরাও সাকিবের পাশে ছিলেন বেশির ভাগ সময়। এমনকি ফিক্সিং ইস্যুতে মধ্যে এক বছর নিষিদ্ধ হওয়ার পরও তার পাশে থেকে সমর্থন জুগিয়ে গেছেন সাকিবভক্তরা। ২০১৯ বিশ্বকাপে জীবনের সেরা ফর্মে ছিলেন সাকিব।
জীবনে যেমন মুদ্রার দু’পিঠ দেখতে হয় ঠিক সেভাবে ক্রিকেট ক্যারিয়ারেও মুদ্রার দুই পিঠই বেশ ভালোভাবে দেখতে শুরু করেন সাকিব। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর পারফরম্যান্সটা ‘সাকিবসুলভ’ হতে পেরেছে অল্প কয়েকবারই। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে ভারি হয়েছে বিতর্কের খাতাটা। সাকিবের ক্যারিয়ারে নানা ধরনের বিতর্ক শুরু থেকেই লেগে ছিল। ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে এসে যেন সেই বিতর্কের পাল্লাটা আরও ভারি হতে শুরু করেছে। একটা সময় বিপদে-আপদে যে সমর্থকরা সাকিবের পাশে ছিলেন তারাও যেন কিছুটা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকে সাকিবের শেষের শুরুটা ধরে নেয়া যেতে পারে। বিশ্বকাপের ঠিক আগে মুহূর্তে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের গুঞ্জনের সাথে ছিল একটি সাক্ষাৎকারে এক সময়কার বন্ধু তামিম ইকবালকে নিয়ে নানা ধরনের তির্যক মন্তব্য। বিশ্বকাপ চলাকালেও বিতর্ক চলেছে সমান তালে। ফলাফল, সাকিবের নেতৃত্বে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা নিয়ে খেলতে গিয়ে সবচেয়ে বাজে ফলাফল নিয়ে দেশে ফিরল বাংলাদেশ দল। সেই ধাক্কার পর আর সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারেনি সাকিব।

বিশ্বকাপ থেকে বয়ে বেড়ানো চোখের সমস্যার কারণে ব্যাটিংটাও হয়নি ঠিকভাবে। ক্যারিয়ারের শেষ ভাগে একাদশে জায়গা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ক্রিকেট অঙ্গনে তার অবসরের দাবিও তুলতে শুরু করলেন অনেকে। ড্রাইভার হয়ে এতদিন গাড়ি চালিয়ে যাওয়া সাকিব যেন নিজেকে প্যাসেঞ্জার মনে করতে শুরু করলেন। শেষ বেলায় সাকিবের ক্যারিয়ারে বিতর্কের আগুন ঢেলেছে রাজনীতিতে যোগদান। গত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের মধ্যে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের পতনের ফলে সংসদ সদস্যের পদটা চলে যায় সাকিবের। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সাকিবের নিশ্চুপ থাকাতে সবচেয়ে বেশি মনঃক্ষুণ্ন হন সমর্থকরা। ভালোবাসার সাকিবকে তাই শূলে চড়াতেও ছাড়েননি দর্শকরা। জীবনের স্রোতের মত বহমান হয়েই ক্যারিয়ারে সুখ এবং দুঃখ দুই ধরনের অনুভূতির তীব্র স্বাদই পেয়েছেন সাকিব। এবার মান-সম্মান বাঁচানোর পালা। সিদ্ধান্ত সাকিবকেই নিতে হবে দেশে এসে মোকাবেলা করবেন নাকি পরবাসী হবেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement