১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

দুষ্টু ভূতের কারসাজি

দুষ্টু ভূতের কারসাজি -

ভূত আছে ভূত নেই এ নিয়ে তর্কবিতর্কের মাঝখানে বকুদের বাসায় এলেন পিপলু মামা। মামা তো মামা তার উপর হৃষ্টপুষ্ট দুষ্টু মামা। বিশাল এক পোশাকী নাম আছে বটে কাজী আনোয়ার হোসেন । অনেকেই নাম শুনে তাকে রহস্য কাহিনী কুয়াশা সিরিজের লেখক বলে ভুল করে। নামে নামে এত মিল? সেসব ছাপিয়ে পিপলু নামটাই চালু হয়ে গেছে। কথায় কথায় ভাগ্নেদের হারিয়ে দেয়া চাই। আর রহস্য তো থাকবেই। মামা এলে বকু ও সুকুর কাজও যায় বেড়ে। সব কিছু সামলিয়ে আবার মামাকেও সামলাতে হয়। শফিউল কাদের বকুল ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। আর রিজওয়ানা কাদের শুক্লা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। তাদের দুজনের বকু শুকু নামও পিপলু মামার দেয়া। নাম সংক্ষেপ করলে অনেক সুবিধা এ কথা বলে তিনি এ কাণ্ড ঘটান। ভাইয়ের নামে পাগল ওদের মা এবং শালাবাবুর নানা আবদার অত্যাচারের শিকার ওদের বাবা কাদের সাহেরও এ নাম নির্বিবাদে মেনে নিয়েছেন। বকু শুকুর মা রিফাত আরা সেই কাজে বাগড়া দেবেন তা হতেই পারে না। এ কম্মো তার নয়। আর পিপলু সাহেবের দুলাভাই কাদের সাহেব এই নাম শুনে তো হেসেই খুন। শালাবাবুর এ মহৎ কর্মে তারও সায় মিলল সহজেই। অতএব বকু শুকু চালু হয়ে গেল। অথচ নিজে একটা ব্রিটিশ আমলের নাম নিয়ে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছেন পিপলু মামা। বকুর কথা হলো কাজী আনোয়ার হোসেন পিপলু এটা এ যুগের নাম হলো। শুক্লারও সায় মিলল এ কথায়। তাতে কি ইতোমধ্যে শুকু বকু চালু হয়ে গেছে।
পিপলু মামা বাসায় আসার পর থেকে শুরু হলো ভূতের উপদ্রব। খাবার টেবিলের ওপর থেকে রান্নাঘর থেকে এটা সেটা উধাও। ভূতটা যে খুব ক্ষুধার্ত এটা বোঝা যাচ্ছে। পরে সেই পেয়ালা বাটি পাওয়া যাচ্ছে হয় ছাদে না হয় রান্নাঘরের প্যাসেজে- নতুবা রান্নাঘর বরাবর বাইরে বাগানের ঘাসের ওপর। এগুলো খুঁজে বের করে আনার দায়িত্ব বাসার কাজের ছেলে দিদারের। আর এতে তার কোনো আলস্য তো নেইই; বরং সোৎসাহে করছে।
বকুদের বাসা একটি মফস্বল শহরে। ঢাকা শহরের কোলাহল ভালো লাগে না বলে ইচ্ছে করেই মফস্বলে বদলি হয়েছেন কাদের সাহেব। বাসাটা দেড়তলা। সামনে বোগেন ভেলিয়ার ঝাড়। ফুল পাতা মিলিয়ে সুন্দর একটি দৃশ্যপট। আশপাশে ছোট-বড় অজস্র গাছ। সকাল-সন্ধ্যা পাখির কিচিরমিচির। বিশেষ করে সন্ধ্যায় পাখির কিচিরমিচিরে একটি অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মনে হয় পাখ-পাখালির দল ঝগড়া করছে। এ দৃশ্য ঢাকায় পাওয়া যাবে? আর এটি দেখেই বাসাটি ভাড়া নিয়েছেন কাদের সাহেব। তার কথা কাউকে না কাউকে তো গ্রামে থাকতেই হবে। সব লোক ঢাকায় থাকতে চাইলে চলবে কী করে।
বকুলের আম্মা ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার কথা চিন্তা করে প্রতিবাদ করেছিলেন। কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত স্বামীর যুক্তির কাছে পরাস্ত হয়েছেন। তিনি বলেছিলেন-
: ওই শহরে ভালো স্কুল আছে? শুক্লা বকুলের লেখাপড়ার কী হবে।
: সেখানে বুঝি স্কুল নেই?
: তা হয়তো আছে। কিন্তু মান দেখতে হবে তো?
: প্রতি বছর মফস্বলের কত স্কুল ভালো রেজাল্ট করে আজকাল। পেপারে দেখো না কুমিল্লা ও নরসিংদীর কী কী যেন স্কুল।
: তা ঠিক। তবুও-
: কি তবুও। আমরা মফস্বল থেকে পাস করে এসে সরকারি চাকরি করছি না।
আর তর্ক চলে না।
আর সত্যি বলতে কী ময়মনসিংহ শহরটাতে তো খারাপ নেই তারা। ছেলে-মেয়েরা দিব্যি ভালো রেজাল্ট করছে। ভালো স্কুলে পড়ছে ।
শীতের কটা দিন কাটাবেন বলে এসেছেন পিপলু মামা। এসেই শুনেছেন এখানে ভূতের উপদ্রব নাকি খুব বেশি।
চতুর্দিকে গাছপালা। আর ফাঁকে ফাঁকে বাড়িঘর। সন্ধ্যার দিকটায় শহরের এ মহল্লায় লোক চলাচল এমনিতেই কমে যায়। এলাকাটা বাউন্ডারি রোডের শেষ মাথায়। ভুতুড়ে পবিবেশ হওয়ার জন্য এই যথেষ্ট। তখন গা ছমছম করে। পথে বের হতে চায় না কেউ নেহাত কোনো জরুরি কাজ না থাকলে।
কিন্তু পিপলু মামার কোনো ভয় নেই। তিনি ও-পাড়ায় কাদের সঙ্গে যেন ব্যাডমিন্টন খেলে দিব্যি আলো-আঁধারিতে হেঁটে হেঁটে বকুদের বাসায় ঠিকই ফিরে আসেন।
: মামা চার দিকে এত ভূত তোমার ভয় করে না? শুক্লা জানতে চায়।
: আমি কি তোদের মতো ভিতু নাকি ভয় করবে। কোথায় কোথায় ভূত কোথায়?
: বলেন কী? অবাক হয় শুক্লা ও বকুল।
: শুনছি রোজই কেউ না কেউ ভূতের পাল্লায় পড়ছে।
: ওদের কথা বাদ দে। আজ তোদের কি হারালো রে?
: কেন তুমি শোননি? পানির জগটা খাবার টেবিল থেকে নিরুদ্দেশ। আমরা পানি খাচ্ছি ডাইরেক্ট ফিল্টার থেকে। সকাল বেলা পানির জগটা পাওয়া গেল মেইন গেটের বাইরে উল্টো করে রাখা অবস্থায়।
: না তাহলে বাড়িতে ভূতের উপদ্রব কমল না। নাকাল বকুর মন্তব্য।
: উ মাগো ! জড়োসড়ো হয়ে যায় শুক্লা।
: আমি ভেবে পাই না কিভাবে হচ্ছে এসব। শেষমেশ আমাদের বাড়িতেও ভূতের উপদ্রব? না বাপু। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। রীতিমতো চিন্তার ভাঁজ বকুলের মায়ের কপালে।
কাজের ছেলেটা জড়োসড়ো হয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে। বুকের ভেতর ভয়ের ঠকঠকানি। কিন্তু জানান দিতে নারাজ। কাল কি এই ভূতের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে? তবে খাবে কি? ওরা কতগুলো ভাইবোন। বাবা মা সবার খাবার জোগাড় করতে পারে না বলেই না ওকে রেখে দিয়েছে কাজের ছেলে করে এই বাসায়।
ভয়ার্ত হাতে পানির জগটি উঠিয়ে আনে দিদার।
: না কোনো ক্ষতি হয়নি। ভাঙেওনি খালাম্মা।
: তাই নাকি? ভয় মেশানো কণ্ঠ। তবু খুশি হন শুক্লার আম্মা।
বাড়ির এই ভূত কাহিনী মোটেই আকর্ষণ করল না বাড়ির কর্তা কাদের সাহেবকে।
তিনি বিকেলে অফিস থেকে ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে একেক দিন একেক জায়গায় চলে যান। আছে অফিসার্স ক্লাব, মাঝে মাঝে সেখানেও যান।
অনেক দিন পর আজ তিনি জানলেন বাড়ির এই ভূত কাহিনী। তাও আবার দিদারের কাছে। শুক্লার মা চোখ বড় বড় করে শুনছিলেন সে কথা। বকু শুকুও অবাক চোখে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে খাবার টেবিলে বসে। হো হো করে হেসে উঠলেন কাদের সাহেব।
: এত কাণ্ড হয়ে গেল আমি জানি না।
: কিভাবে জানাব, এসব ঘটনার সময় তুমি বাসায় থাক নাকি? তুমি তো অফিসের কাজকম্ম নিয়েই আছ। শুক্লার মায়ের সরল উত্তর।
: শালাবাবু কী বলে? কী হে ভূত রহস্যের কোনো সমাধান করতে পারছ না। ইয়াং ম্যান।
এ সব কথায় মামা গম্ভীর হয়ে গেলেন।
: না না দুলাভাই, বিষয়টি নিয়ে আমিও ভাবছি।
: কী আশ্চর্য শুধু খাবার টেবিলের সরঞ্জাম লাপাত্তা হচ্ছে।
: জানো আব্বু আজ পানির জগ পাওয়া গেছে মেইন গেটের বাইরে। কাল চায়ের কাপ মিলেছে রান্নাঘরের জানালা বরাবর ঘাসের উপর।
: আর কী কী খোয়া গেছে। আব্বা জানতে চান।
: মধু শুদ্ধ মধুর বয়াম বকুর পানির গ্লাস, শুক্লার খাবার বাসন। এবার জবাব দিলেন শুক্লার মা। কী আশ্চর্য মধুর বয়াম পাওয়া গেল ছাদে, ভূত এতটুকু মধু খায়নি। বাকি সবই পাওয়া গেছে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়।
: হা হা হা তোমাদের এই ভূতকে উপকারী ভূতই বলতে হবে। বললেন কাদের সাহেব। ভাগ্যিস আমার পকেটে আর টাকার দেরাজে হাত দেয়নি।
পিপলু মামা মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন। বললেন-
: এর একটা ইমিডিয়েট সমাধান বের করতেই হবে দুলাভাই। ময়মনসিংহে ভূতের উপদ্রব বেশি জানি। কিন্তু তাই বলে এই বাড়িতে?
: ভূত যদি ময়মনসিংহে থেকেই থাকে তবে এ বাড়িতে আসতে কতক্ষণ।
তাই এসব ঘটনার পর পুরো বাড়ির পরিবেশ থমথমে হয়ে পড়ল। কারো মুখে কথা সরে না এখানে ওখানে ফিসফিস।
ভূত ব্যাটাকে উপকারী বললেও বেশ দুষ্টু ভূতই বলতে হবে। কাদের সাহেবের মুখ এবার না গম্ভীর না স্বাভাবিক এমন একটা ভাব।
আবার পিপলু মামা বলে উঠলেন-
: দুলাভাই, চিন্তা করবেন না। এর কি সমাধান- গণক কবিরাজ না ইমাম সাহেব কালকের মধ্যেই করে ফেলব ।
এতক্ষণ মুখ গম্ভীর করে বসেছিলেন শুক্লার মা। ভাই পিপলুর কথায় অনেকখানি সাহস ফিরে পেলেন। খাবার টেবিলে ভূতবিষয়ক আলোচনা তৎক্ষণাৎ ভেঙে গেল। কেউ আধপেটা কেউ ভরপেট খেয়ে উঠে গেলেন।
বকুল আর শুক্লা এ নিয়ে গবেষণা কম করেনি। এ গবেষণায় যোগ দিয়েছে পাশের বাসার জয়তী। জয়তীর মা হেমবতী ভূতবিষয়ক কবিরাজের সন্ধানও দিলেন।
সেই মতো কাজও শুরু হয়ে গেল। অবশ্য এগুলো পিপলু মামাকে কিছুই বলা হলো না।
দু’দিনেও ভূত সমস্যার কিছু হলো না। পরিবেশ আগের মতোই থমথমে। অবশ্য একটা ভালো খবর হলো ভূতের উৎপাত কমে এসেছে। গত দু’দিনে কিছু খোয়া যায়নি। সবাই ভাবতে শুরু করল তান্ত্রিক বা কবিরাজের গোনা গুনতিতে কাজ হয়েছে।
পরের দিন বেড়ানো শেষ করে বিদায় নিলেন পিপলু মামা। তার নাকি জরুরি ম্যাসেজ এসেছে ঢাকায় যেতে হবে। পিপলু মামা চলে যাওয়ার পর ভূতের উপদ্রব একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচল।
পিপলু মামা চলে যাওয়ার কয়েক দিন পর শুক্লার আম্মার মোবাইলে একটি ম্যাসেজ এলো। এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেল, দুষ্টু ভূতের কারসাজির সব কিছু। মামা লিখেছেন দিদারের সহায়তায় ভাগ্নে-ভাগ্নিকে ভয় পাইয়ে দিয়ে নিছক মজা করার জন্য এ কাজটি করেছেন। আম্মা এ কথায় হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে পারছেন না।
শুক্লা আর বকুল লাগল দিদারের পেছনে, তবে রে শয়তান।
: আমার কী দোষ মামা সব শিখিয়ে দিয়েছে। বাঁচার আশায় জবাব দিলো দিদার।
: তবে মোক্ষম অভিনয় করেছিস সেটি মানতে হবে। এ কথা বলে আম্মা পরিবেশটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন।


আরো সংবাদ



premium cement