১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১, ১৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়

গণবিপ্লব ২০২৪ -


২০২৪ সালের জুলাই মাস এবং আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহজুড়ে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব ও অভূতশ্রুত গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক পতন ঘটে। উদীয়মান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিকশিত নবজাগরণের বা রেনেসাঁর উন্মেষ থেকেই নবপর্যায়ের এই গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। এ দেশের ছাত্র-জনতার বহু ত্যাগ, তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে এই বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছে। তাই এ মুহূর্তে তাই বলতে ইচ্ছে করে- ‘বীরের এই রক্তস্রোত, মাতার এই অশ্রুধারা যায়নি বৃথা, যাবে না বৃথা।’
গত শতাব্দীর অন্যতম ফ্যাসিবাদী শাসক হিটলার তার পতনের বছর কয়েক আগে দম্ভ করে ঘোষণা করেছিলেন ‘The third reich will rule the world for one thousand years’, অর্থাৎ হিটলারের জার্মানি (তৃতীয় জার্মান রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য) এক হাজার বছর পৃথিবী শাসন করবে। এই ঘোষণার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে হিটলারের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। তার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এক নতুন পৃথিবীর যাত্রা শুরু হয়। ইতালীয় দার্শনিক ফ্যাসিবাদের প্রবক্তা ভিলফেডো পেরেটো (Pareto) মুসোলিনির শাসনকে বৈধতা দেয়ার জন্য তত্ত্ব হাজির করেন- 'History is the graveyard of aristocracy', অর্থাৎ মানব ইতিহাস অভিজাততন্ত্রের সমাধিক্ষেত্র। কিন্তু পেরেটোর তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণিত করে মুসোলিনির ভাগ্যে নেমে আসে করুণ পরাজয়। তারও আগে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি দেশের অত্যাচারী রাজা চতুর্দশ লুই ঘোষণা করেন 'I am the state, What I say is law অর্থাৎ ‘আমি রাষ্ট্র, আমি যা বলি তা আইন’। এই ঘোষণার কয়েক বছরের মাথায় ষোড়শ লুইয়ের রাজত্বকালে বাস্তিল দুর্গের পতনের মধ্য দিয়ে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়। রাজা ষোড়শ লুই ও রানী মেরি আতোয়িকে গিলোটিনে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ওই দেশের বীর জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সেখানে রাজতন্ত্রের অবসান হয়। মানুষ মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করে। ফ্রাঙ্কোও মার্কোসের মতো অনেক স্বৈরশাসকের করুণ পরিণতির কথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।

গভীর পরিতাপের বিষয়, একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে। নিষ্ঠুর ও নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনা প্রায় ১৬ বছর যাবৎ দোর্দণ্ড প্রতাপে তার স্বৈরশাসন অব্যাহত রাখে। ফলে জনগণের জীবনে নেমে আসে এক দুর্বিষহ অমানিশার ঘোর অন্ধকার। তার অবিচার, অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন, হত্যা, গুম, খুন, সম্পদ লুণ্ঠন, শোষণ, বঞ্চনা ও অধিকার হরণের কাহিনী বিশ্বের যেকোনো বিবেকবান মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও শিহরণ সৃষ্টি করবে। অবশেষে গত জুলাই আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার বিদ্রোহ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। দাম্ভিক হাসিনা তার পতনের কিছু দিন আগে ঘোষণা দেন ‘হাসিনা পালায় না’। ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস, এ ঘোষণার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে, নির্লজ্জভাবে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেন। বাংলাদেশের তরুণ ছাত্র-সমাজ এই বিপ্লবের, এই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। ছাত্র-জনতার বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশে সূচনা হয় এক নবযুগের।

২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে যে অন্ধকার যুগের সূচনা হয়েছিল, সে অন্ধকার ধীরে ধীরে পুরো দেশ ও জাতিকে গ্রাস করেছিল। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, লুটপাট, হত্যা, ঘুম, অপহরণ, খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণ, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি পুরো সমাজকে পঙ্গু করে ফেলে। এর ফলে দেশ ও জাতি গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। ইউরোপের মধ্যযুগকে বলা হতো অন্ধকার যুগ। কারণ তখনকার যাজক-শাসক শ্রেণীর সীমাহীন শোষণ, নির্যাতন, অত্যাচার, অনাচারে মানুষের জীবনে নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ ও দুঃখ কষ্ট। অবশেষে পঞ্চদশ শতাব্দীতে (১৪৫৩ সালে) রেনেসাঁসের (Renaissance) সূত্রপাত এবং তারই ধারাবাহিকতায় রিফর্মেশন (Reformation) আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানুষ মুক্তির সন্ধান লাভ করে। শেষ হয় অন্ধকার যুগের, সূত্রপাত হয় আধুনিক যুগের। রেনেসাঁস ঘোষণা করে মানুষের মুক্তি। নিজস্ব শক্তিতে বলিয়ান, কর্মঠ, যুক্তিঋদ্ধ বিপ্লবের পর বিপ্লবের ভেতর দিয়ে ইউরোপের সমাজ ও সভ্যতাকে বিকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর আবির্ভাবের আগে তদানীন্তন আরব দেশও অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। পাপ, পঙ্কিল, কুসংস্কারের সেই সময়টিকে বলা হতো আইয়ামে জাহেলিয়া। কিন্তু আইএমএ জাহেলিয়া যুগের অবসান হয়েছিল, আমাদের মহানবী সা:-এর অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম ও শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রচারের মধ্য দিয়ে। অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করে তখনকার আরববাসীকে তিনি আলোর সন্ধান দিয়েছিলেন।

বিগত দেড় দশকের বাংলাদেশের সময়টা আরবের আইয়ামে জাহেলিয়ার এবং মধ্যযুগের কৃষ্ণসময়ের সাথে তুলনীয়। শাসক শ্রেণীর শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, সীমাহীন দুর্নীতি, শেয়ার বাজার লুট, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্প ও সর্বোপরি সরকারদলীয় পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক টাকা লুটের মাধ্যমে দেশকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে; যার ফলে এ দেশের জনগণের কপালে নেমে এসেছে অসহনীয় ও অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।
ফ্যাসিবাদ, রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ও অভিজাতন্ত্রের যুগ পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করেছি গণতন্ত্রের যুগে। সারা বিশ্বের মানুষ আজ স্বাধীনতা ও সাম্যের জয়গানে মুখরিত। তাই স্বাধীনতা কথাটি সবার কাছে অতিপ্রিয়। তাই বলছিলাম, যেকোনো জাতির জীবনে বা জাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং গৌরবময় অধ্যায় হলো সে জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম। বাংলাদেশের বাঙালি জাতির সবচেয়ে মহান অর্জন তার স্বাধীনতা। এ জাতির সবচেয়ে গর্বের বিষয় মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা যুদ্ধ তাই আমাদের এক পরম গর্বের বিষয়।

১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করার পর অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ হয়ে উঠবে বিশ্বে সাম্য ও গণতন্ত্রের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। ইতিহাসের এক পরম দুর্ভাগ্য এই যে, আমাদের সেই বহু লালিত স্বপ্ন থেকে যায় সুদূর পরাহত, কোনো এক অজ্ঞাত অন্ধকারে নিমজ্জিত। এই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির অন্যতম প্রধান কারণ গণতন্ত্রহীনতা। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, গণতন্ত্র হচ্ছে উন্নয়ন ও অধিকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহন; যার অনুপস্থিতি বা বিকৃতি একটি রাষ্ট্র বা সমাজের প্রকৃত বন্ধনমুক্তির সব পথ রুদ্ধ করে দেয়।
মানব ইতিহাসে একাধিকবার দেখা গেছে ফ্যাসিবাদের নির্মম ও নিষ্ঠুর পরিণতি। ক্ষমতার নিরঙ্কুশ আস্ফালন অচিরেই নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের নির্ধারিত আঁস্তাকুড়ে, তবে ইতিহাসেরই নির্মম পৃষ্ঠার দিকে দৃষ্টি পড়ে না অনেক ফ্যাসিবাদী শাসকের। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ইতিহাসের এই শিক্ষা এখনো ফ্যাসিবাদী শাসকরা গ্রহণ করেননি। তারা আজো ক্ষমতার-অহঙ্কারে স্ফীত হয়ে দুর্দান্ত প্রতাপে শাসন ও শোষণের বল্গাহীন অশ্বের পিঠে সওয়ার হয়ে আছেন।

বাংলাদেশে গত দেড় দশকে প্রতি মুহূর্তে প্রত্যক্ষ করেছি ফ্যাসিবাদের বিলুপ্ত প্রেতাত্মার পুনরুত্থান। এক নিষ্ঠুর ও নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদের কবলে পড়ে আমাদের স্বদেশ; এর স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জনগণের মৌলিক চাহিদা তথা সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক সুস্থতা। গত দেড় দশকে এই ধারা গণতন্ত্রের কবর রচনা করে জনগণের সর্বপ্রকার অধিকার হরণ করেছে। অপহরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে নির্বাচন চুরি।
তস্করবৃত্তির মাধ্যমে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং এই অবৈধ দখলকে কায়েম রাখার স্বার্থে গুম, হত্যা, বিনাবিচারে আটক, নির্বিচার গ্রেফতার তথা সব প্রকার রাষ্ট্রীয় ত্রাস ও সন্ত্রাসের এক বীভৎস রাজত্ব গড়ে তোলা হয়। সীমাহীনভাবে অবিরাম লঙ্ঘন করা হয় মানবাধিকার।
এ সবের পাশাপাশি অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলে জনগণ ও রাষ্ট্রের সম্পদের অবাধ লুণ্ঠন। জাতীয় সম্পদ লুট করে এরা বিদেশে পাচার করছে, গড়ে তুলছে সম্পদের পাহাড়। গণতন্ত্রহীনতার এমন এক দুর্বিষহ দুষ্কালে প্রতিবাদের কণ্ঠগুলো স্তব্ধ করার হীন প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। আমরা অবশ্যই ইতিহাসের অনিবার্য গতি ও পরিণতির শিক্ষা ভুলে যেতে পারি না। আমরা ইতিহাসের প্রতি উদাসীন থাকলেও ইতিহাস জড়িয়ে থাকে আমাদের জীবনের পরতে পরতে।

বিশ্বের মুক্তিপাগল মানুষের মতোই বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম, ছাত্রসমাজ ও জনগণ স্বৈরাচারের শাসন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে। সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী ও শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়ের সাধে দেশের সুশীলসমাজ একযোগে এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা, গুম ও শোষণ-বঞ্চনার কথা সবার জানা। তার অলিন্দ উপচে পড়েছিল স্বৈরাচারের সর্বপ্রকার উপাদানে- কী অর্থনীতি, কী রাজনীতি, কী সমাজ, সংস্কৃতি- সর্বত্র হাসিনার আগ্রাসী স্বৈরতন্ত্র ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো। বিশ্বের বহু স্বৈরাচারীর অসংখ্য ‘কীর্তি’ বিবর্ণ হয়ে গেছে হাসিনার ‘মহাকীর্তির’ কাছে। আলাদীনের দৈত্য ফ্যাসিবাদের সব চেরাগ ধরিয়ে দেয় হাসিনার হাতে এবং ইতিহাস আতঙ্কে হেসে উঠেছে তার অবধারিত বিনাশের গতিপথের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে।

গণ-আন্দোলনেই যে হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের ঐতিহাসিক পতন হবে এ বিষয়ে আমি আগেই সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করি। স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র-জনতার এই ঐতিহাসিক বিজয়লগ্নে দাঁড়িয়ে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, এবারের গণ-আন্দোলন বৈশিষ্ট্যগত ও গুণগতভাবে ছিল বহুলাংশে ভিন্নতর, মৌলিকতার দিক থেকে এবং এর প্রকৃতির দিক থেকে। বাংলাদেশের জনগণ তাদের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিন্যাস ও পটভূমির আলোকেই আজ এক নতুন রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছে। আমার বহু প্রত্যাশিত এ রেনেসাঁ ইউরোপের মতো নয়; চরিত্রগতভাবে এ রেনেসাঁ শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার ক্ষুরধার দিয়ে ইহলৌকিকতার জয়গান নয়- এ রেনেসাঁ জাতীয় মুক্তির চেতনায় আলোকিত একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রেনেসাঁ। এ নব উন্মেষ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের এক সম্মিলিত অঙ্গীকার। এ নবজাগরণ একটি জাতিকে নবউদ্বোধনের চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমার বহুলালিত এ রেনেসাঁ বাংলাদেশের সামগ্রিক জাতীয় চেতনা, আবেগ ও প্রত্যাশার এক উজ্জ্বল অগ্রদূত। এ দেশের ছাত্রসমাজ এ রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছে। তারা সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছেন রেনেসাঁর চিরাচরিত ধারণা। তারা ভাবমানসের অতিন্দ্রীয় কুহক থেকে রেনেসাঁকে সরিয়ে এনেছেন স্বৈরতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের মুক্তি।

তারা মহামতি কালমার্কসের সেই অমর বাক্যের মূর্তরূপ দিয়েছেন বাংলাদেশে। ‘Philosophers have hitherto interpreted history, now the task is to change it’ বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ মার্কসের গভীর প্রত্যাশাকে আজ পূর্ণ করেছে। তারা আবদ্ধ কক্ষের গ্রন্থঠাসা আলো-আঁধারিতে বসে বাংলাদেশকে তথ্য ও তত্ত্বের সারণি ও সিদ্ধান্ত নিয়ে মস্তিষ্ক উত্তপ্ত করেননি; তারা গণমানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামে সেনানায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। মার্কস ‘পরিবর্তনের’ যে আশার কথা শুনতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ পুরো দেশবাসীকে সাথে নিয়ে সেই আশা পূর্ণ করেছে। ছাত্র-জনতা পরিণত হয়েছে সংগ্রামরত গণদার্শনিকে।
ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে এবং সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। গভীর আনন্দের কথা যে, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। অধ্যাপক ইউনূস আজ বিশ্বব্যাপী নন্দিত, নোবেল কমিটি তাকে শান্তি পুরস্কার দেয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী শান্তি, সংহতি ও উন্নয়নের ধারায় তার অবদানের প্রতি শ্রদ্ধাবনত সম্মান দেখিয়েছেন। এ জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে অহঙ্কার বোধ করি।

আমি বিশ^াস করি, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন এবং অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ- এ দু’টি অর্জন আমাদের জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের গর্বের পাশাপাশি আরো একটি অহঙ্কারভূষণ হয়েছে অধ্যাপক ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তি। তার নোবেল প্রাপ্তির সম্মান কেবল তার ও তার পরিবারের নয়- এ সম্মান দেশ ও জাতির।
একবার আমার সুযোগ হয়েছিল তার গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মসূচি প্রত্যক্ষ করার। আমার সাথে ছিলেন অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া এবং ড. ইবরাহিম। সেটি ছিল একটি সমাবেশ। অধ্যাপক ইউনূস সেই বিশাল বড় সমাবেশে যে ভাষণ দেন তা আমি আজো গভীরভাবে স্মরণ করি। সেই ভাষণ ছিল নিপীড়িত, বঞ্চিত, ভাগ্যহত দরিদ্র মানুষকে জাগিয়ে তোলার, অনুপ্রাণিত এবং উদ্বুদ্ধ করার এক আশ্চর্য জাদুমন্ত্র।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস চিন্তাচেতনা, আদর্শ ও জীবনাভাবনার ক্ষেত্রে ছিলেন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও দ্বিধাহীন। একবার কোনো লক্ষ্য স্থির করলে তিনি সেই লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকেন। ড. ইউনূস সন্দেহাতীতভাবে এক মহান ও অসাধারণ দেশপ্রেমিক। এখানেই তার সাহস ও শক্তি পুঞ্জীভূত।
তার উদ্ভাবিত সামাজিক ব্যবসায় (Social Business) আজ বিশ্বের বহু দেশে বহু প্রতিষ্ঠানে চালু হয়েছে। এর সুফল লাভ করছে বিশ্বের বিপুল মেহনতী মানুষ। গ্রামীণ ব্যাংক মডেল যেমন অনেক দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে, তেমনি সামাজিক ব্যবসায় ও অধস্তন শ্রেণীর সামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে। তার ‘তিন শূন্যের’ ধারণা বাস্তবায়িত হলে, বিশ্ব হবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত এবং সুন্দর পৃথিবী হবে দূষণমুক্ত ও বাসযোগ্য।

কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এক বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে হবে। একটি স্থিতিশীল শৃঙ্খলাপূর্ণ সরকারব্যবস্থা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিলুপ্ত গণতান্ত্রিক কাঠামো ফিরিয়ে আনা সময় সাপেক্ষ হলেও অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলাকে এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে। স্বৈরাচার পতনের অব্যবহিত পরই এমন কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা দেখেছি, যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি এত বড় একটি ঐতিহাসিক অর্জনের গুরুত্বকে ম্লান করে দিতে পারে। সরকারের স্বাভাবিক প্রশাসনিক তৎপরতা নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে- এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার তেমন প্রয়োজন নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কয়েকটি আশু দায়িত্ব নির্ধারণ করতে হবে, যেমন :

১. অনতিলিম্বে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় জীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।
২. জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে।
৩. সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া হত্যা, লুটপাটসহ সব ধরনের অপরাধের তদন্ত ও বিচার করতে হবে। বিচারহীনতার ও জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি জাতিকে সর্বদিক থেকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়ে একে সম্পূর্ণরূপে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করে। সুতরাং সরকারকে এ বিষয়ে গভীর মনোযোগ দিতে হবে।
৪. হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে যেকোনো মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।
৫. বিদ্যমান প্রশাসন কাঠামোতে কোনো সুর্দিষ্ট কারণ ব্যতীত এ মুহূর্তে হস্তক্ষেপ করলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত করা বা পুরস্কৃত করা- উভয় বিষয়েই বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। নিয়োগ ও পদোন্নিতির ক্ষেত্রে যোগ্যতাই একমাত্র মাপকাঠি হবে।
৬. যেকোনো প্রকার বা যেকোনো ক্ষেত্রেই হোক দুর্নীতির মূল উৎপাটন করতে হবে। বিগত ১৬ বছরের সীমাহীন দুর্নীতিই আজ বাংলাদেশকে নিঃস্ব রিক্ত করছে।

৭. গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। গণতন্ত্রহীনতার অবাধ ও উলঙ্গ চর্চার প্রতিফলন ঘটেছে সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সুস্থ বিকাশ না ঘটলে এই গণবিপ্লবের সাফল্য অর্জিত হবে না। সংস্কার কাজ সম্পন্ন করে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করতে হবে।
৮. শিক্ষাব্যবস্থা বলতে বাংলাদেশে আজ কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিগত ফ্যাসিস্টরা শিক্ষা নামক বিষয়টিকে হত্যা করেছে। সুতরাং এ প্রেক্ষাপটে শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি একটি সর্বজনীন গণমুখী শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
বর্ণিত দায়িত্বগুলো সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন সময়, সদিচ্ছা, পরিকল্পনা ও আন্তরিকতা। আমি জানি যে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার এগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে পারবেন। জনমানুষের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে এ সরকার আন্তরিকতার সাথে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
আমি এ সরকারের সাফল্য কামনা করি।

 


আরো সংবাদ



premium cement
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেফতার সোনারগাঁয়ে শেখ হাসিনা-শেখ রেহেনাসহ ২৩৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা গাজার চলমান ঘটনাবলী সমসাময়িক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভুল : বসনিয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার পর থেকে ভারতের আসাম-মেঘালয় সীমান্তে আটক ৬৫ বাংলাদেশী ঐক্যের মাধ্যমেই কেবল মুসলিম উম্মাহ'র মর্যাদা প্রতিষ্ঠা সম্ভব : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হোসেনপুরে স্কুলশিক্ষকের বসতঘর পুড়ে ছাই রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রামে ভারী বৃষ্টির আভাস 'শ্রম আইন সংস্কার করে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে' সিংগাইরে ধলেশ্বরী নদী থেকে লাশ উদ্ধার সাতক্ষীরায় বজ্রপাতে মৎস্যচাষির মৃত্যু সাংবাদিক শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল বাবুর ওপর ডিম নিক্ষেপ

সকল