১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১, ১৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

স্বোপার্জিত স্বাধীনতার সোপানতলে

-


বড্ড আশায় বুক বেঁধে আনন্দ অশ্রুতে সিক্ত হয়েই এ লেখা লিখছি। সবুজ ও তাজা তরুণরা দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির আত্মধ্বংসে সম্মোহিত আধমরাদের ঘা মেরে জাগানোর যে অয়োময় প্রত্যয় প্রদর্শন করেছে তাতে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’-এর ৫৩ বছর পর ‘মুক্তির সংগ্রামে’ বিজয় অর্জিত হয়েছে। তারা আমাদের আত্মবিশ্বাসের উদ্বোধন ঘটিয়েছে। এই বিজয় স্বোপার্জিত স্বাধীনতা তথা গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্রান্তিকাল উত্তরণে নতুন উদ্যম ও সাহস জোগাবে। এই বিজয়ে স্বার্থবাদী রাজনীতি নাস্তানাবুদ হয়েছে, এটি জাতিকে বিভক্ত করণে দীর্ঘদিনের একদেশদর্শিতা, একক ব্যক্তিবন্দনা, অসংখ্য গোয়ার্তুমি, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও ভুল (political blunder, mistakes etc), আত্মশ্লাঘা, অহংবোধ ও অপশক্তির অপব্যবহার ও স্বার্থ হাসিলের জন্য রাজনৈতিক উৎকোচ (political bribing) প্রথার অতি অপব্যবহারের প্রতি প্রচণ্ড চপেটাঘাত। এই বিজয় রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাথে স্বনির্ভর ও স্বয়ম্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে আমাদের আত্মশক্তির অর্থবহ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করবে। একই সাথে এই জাগরণ দূরের ও কাছের ভূরাজনীতির ভায়রা ভাইদের কাছে আমাদের একক শক্তিমত্তার একটি শক্ত বার্তা পৌঁছাবে। আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধানে সক্ষম এটি প্রতিফলিত হবে। এই জাগরণ আমাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি উন্নয়নে শক্তি ও সাহস জোগাবে। অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা অর্জন ব্যতিরেকে আঞ্চলিক রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব সুদৃঢ় করা সম্ভব নয় এই উপলব্ধির উপলব্ধি আজ বেশি প্রয়োজন। পারস্পরিক দোষারোপের দ্বারা আমরাই আমাদের শত্রু হয়ে নয়, বিভেদ বিভাজন বিভ্রান্তি বিচ্যুতির পরিবর্তে অন্তর্ভুক্তির চিন্তা ও চেতনায় জাগ্রত হওয়ার আহ্বান এবারের গণ-অভ্যুত্থানের মর্মবাণী।

আপামর জনসাধারণ (সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রারম্ভেই উল্লেখমতো ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ’) যেখানে যে উদ্দেশ্য বিধেয় নিয়ে চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে সেটিকে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই দলীয় ও দুর্নীতিগ্রস্তকরণের দৃষ্টিভঙ্গিতে জলাঞ্জলি দেয়ার আত্মঘাতী প্রয়াস প্রচেষ্টার কারণে অর্থনীতিকেই দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৭২-৭৫ সময়ের রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি, বিশেষ করে ১৯৭৪-এ সীমাহীন অর্থনৈতিক দুর্দশার কথা পরবর্তী প্রজন্ম জানে না। রাজনৈতিক অর্থনীতিতে সীমাহীন বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিবরেই ১৯৪৭-এ ভারত বিভাগ এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যুদয়, ৫৩ বছর বয়সী সেই স্বাধীন বাংলাদেশে ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে’ অর্ধ সহস্রাধিক (এখন পর্যন্ত অগণিত) প্রাণ দিতে হয়েছে। সম্ভাবনাময় অর্থনীতিকে শোষণের হাতিয়ার বানিয়ে, সুশাসন ও জবাবদিহি রহিত উন্নয়ন সঙ্গীতের মূর্ছনায় দেশ, সমাজ ও রাজনীতিকে দুর্নীতির দাবানলে জ্বালানো ও পোড়ানো হয়েছে। মানবাধিকারের প্রশ্নে মূক ও বধির বানানো হয়েছে। নিজ সেনাপতি ম্যাকবেথের গ্রহে অতি নিরাপদ আতিথেয়তা গ্রহণকালে রাজা ডানকানকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করা হলে খুনি ম্যাকবেথ দম্পতি আর কখনো ঘুমাতে পারেনি, এ কথা বলা কি অযৌক্তিক ও অসঙ্গত হবে যে গণতন্ত্রের জন্য আজীবন লড়াকু নেতা নিজ হাতে গণতন্ত্রকে হত্যা করে থাকলে তার প্রজন্ম জাতি কি কখনো গণতন্ত্র ফিরে পাবে? কাফফারা আর কত দিতে হবে? বাকি রাত পোহাবার প্রেরণা নিয়ে নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। গোটা জাতিকে এবারের অগণিত শহীদানদের রক্তের ঋণ শোধ করার কোনো বিকল্প নেই। এবারের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা যথার্থই উচ্চারণ করেছেন ‘আর যেন কোনো স্বৈরাচারের জন্ম না হয় এই বাংলায়’ সে লক্ষ্যে তারা রাষ্ট্রকে উপযুক্তভাবে মেরামতে মন দিয়েছেন।

রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের শোভন সংস্কার আজ অন্যতম দাবি। আগেও কমবেশি ছিল কিন্তু বিগত দেড় দশকে হয় সরকার রাষ্ট্রকে অধিগ্রহণ করেছে, নয় রাষ্ট্র সরকারের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে রক্ষক ভক্ষকে পরিণত হয়েছে, রাজনৈতিক উৎকোচ দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থাপনাকে সরকার নিজের কবজায় নিয়ে নিয়েছে। দান প্রতিদানে বড় বড় দানব তৈরি হয়েছে, সিন্ডিকেট সরকারকে এবং সরকার সিন্ডিকেটকে পারস্পরিক সুরক্ষা দান করে। এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখার বিপদ জানা সত্ত্বেও সুযোগসন্ধানী চাটুকররাই, দলের লোকেরাই স্বৈরাচারকে খতম তারাবির আগেও অভয় দিয়ে ‘আমরা আপনার সাথে আছি’ বলে নেক্সট ফ্লাইটে কাট মারেন। ৪৯ বছরের ব্যবধানে একই আগস্টে নিজেরাই নিজেদের নেতাকে হত্যা করে দোষ পড়েছে অন্যদের ওপর। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধুর একটি স্বগোতুক্তি আছে ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদের সাথে কোনো দিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশ সেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’
রাজনৈতিক অর্থনীতির এই ক্রান্তিকালে মোটা দাগে দৃশ্যমান সমস্যাগুলো এরকম অব্যাহত মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক রিজাভের্র পতন, রাজস্ব সংগ্রহের স্বল্পতা, রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের স্থবিরতা, পুঁজি পাচার, ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা, সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও সরকারি ব্যয়ের অনিয়ম-অপচয়, জবাবদিহি হীনতার সংস্কৃতি এবং বৈদেশিক অভ্যন্তরীণ খাতের ঋণের সুদ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান দায়। এ বছরের বাজেটে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয়কে ১৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে বৈধ করার প্রস্তাবিত সুবিধা অন্যায্য ও অনৈতিক। অর্থনীতিতে অনৈতিকতার বিষয়ে এত উদগ্র ও বেসামাল যে একটি নৈতিকতাহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়েছে দেশ।

সর্বভুক অর্থনীতিতে ব্যয়ের বহর বাড়িয়ে পাছে টাকা লাগলে দেবে গৌরী সেন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে, গৌরী সেন তো নিজের পকেটের টাকা দেবে না, হয় চাহিবামাত্র বাহককে দেয়ার দায়িত্ব পালনার্থে নিজ স্বাক্ষরে (ক্যাশলেসের স্লোগান দিয়েও) নগদ নোট ছাপিয়ে (এত সুন্দর প্রিন্টিং প্রেস আছে না!) নয়তো কঠিন শর্তেও ধার কর্জ করে (ভবিষ্যৎ অর্থনীতির সুদাসলের কিস্তির সুগার বা ডায়াবেটিস বাড়িয়ে হাইপো হলে ক্ষতি কী?) বর্তমানে মুচলেকা দানকারী খাতকের তাতে ব্যক্তিগত কিছু হবে না, ঋণভারে জর্জরিত হবে, মাজা ভেঙে যাবে ভবিষ্যৎ অর্থনীতির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমজনতার ঢল নামার এটিও একটি নেপথ্য কারণ।

জিডিপি, রিজার্ভ, রফতানি ও রেভিনিউ আয়ের হিসাবায়ন ও প্রক্ষেপণ প্রক্রিয়াকে এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে যে, তাতে অর্থনীতি অনেকটা গরু মোটাতাজাকরণের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দেখা গেছে জিডিপি, রিজার্ভ, রেভিনিউয়ের আকার বড় দেখিয়ে বিদেশ থেকে বড় বড় ঋণ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, বড় কাজের জন্য ঋণ নিতে সভারেন গ্যারিন্টি দেয়া হয়েছে, প্রচারের প্রগলভতায় উন্নয়ন বয়ানে রাজনৈতিক সুনাম সুখ্যাতি-স্বার্থ উদ্ধারের গ্রোথ দৃশ্যমান হয়েছে। সুশাসনবঞ্চিত প্রচারসর্বস্ব উন্নয়নই ক্ষমতায় থাকার অবলম্বন সাব্যস্ত হয়। ব্যাংকিং ও বিদ্যুৎ জ্বালানি খাত সিন্ডিকেটের হাতে বন্দিত্ববরণ করায় অর্থ পাচার, উদ্যোক্তা পাচার সবই সহজ হয়েছে। দেশে বিনিয়োগ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না করে, দক্ষ জনবল গড়ে না তুলে বিদেশে বিনিয়োগের বাহাদুরি বেড়ে গেল। দেশের মানুষ কাজ পায় না সেখানে সিঙ্গাপুরে ৪০তম ধনী কোম্পানি হয়ে ওঠে বাংলাদেশী সিন্ডিকেট। ভাসুরের মতো নাম নেয়া যাবে না, এমন সিন্ডিকেটের দুর্নীতির তদন্ত করতে মহামান্য আদালতের সায় মেলে না। প্রকৃত আকারের চেয়ে জিডিপি, বাজেট ব্যয়, রিজার্ভ বড় দেখানোর মনোভঙ্গী প্রকাশ পাওয়ায় আয়ের সমবণ্টন হয়নি, উল্টো বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। কিছু মানুষের কাছে প্রচুর অর্থ আর অধিকাংশ মানুষের কাছে অর্থ নেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েই তরুণদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধে এবং তা গণ-অভ্যত্থানে পরিণত হওয়ার শানেনুজুুল এখানেই ।

যাদের জন্য জিডিপিকে মোটাতাজা হয়েছে তারা করের আওতার বাইরে থেকে গেছে। কর প্রদানযোগ্য অধিকাংশ ব্যক্তির কাছ থেকে ট্যাক্স নেয়া হয় না। দেশের বড় মেগা প্রকল্পের জন্য বিদেশ থেকে যেসব জিনিসপত্র, পরামর্শক, দেশী-বিদেশী ঠিকাদার তাদের শুরুতেই কর মওকুফ করে দেয়া হয়েছে। মওকুফকৃত করের টাকাসহ প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয় কত সেটি ঠিক না রাখলে সুশাসন সুদূর পরাহত থেকে যায়। প্রকল্পের খরচ থেকে সেই কর মাফ দেয়ায় সরকার এক দিকে কর হিসাবভুক্ত করেনি, অন্য দিকে দেখানো হলো প্রকল্পে বেশি খরচ হয়নি। প্রকৃত হিসাবটি অন্ধকারে রাখতেই সরকার আগেভাগেই কর মাফ করে দেয়। যেমন-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ইমিউনিটি দিয়ে দুর্নীতি বিস্তারের সুযোগ করে দেয়া হয়। ব্রুনাই থেকে সহজ শর্তে তেল ও গ্যাস পাওয়ার সুযোগ না নিয়ে কঠিন দামে তরলীভূত গ্যাস ও জ্বালানি কেনার কাজ কারা পেয়েছে এসব দুদক এবং বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দফতরের মৌনসম্মতি ও সমর্থনের কারণ জানা যায়নি।


আরো সংবাদ



premium cement
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেফতার সোনারগাঁয়ে শেখ হাসিনা-শেখ রেহেনাসহ ২৩৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা গাজার চলমান ঘটনাবলী সমসাময়িক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভুল : বসনিয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার পর থেকে ভারতের আসাম-মেঘালয় সীমান্তে আটক ৬৫ বাংলাদেশী ঐক্যের মাধ্যমেই কেবল মুসলিম উম্মাহ'র মর্যাদা প্রতিষ্ঠা সম্ভব : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হোসেনপুরে স্কুলশিক্ষকের বসতঘর পুড়ে ছাই রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রামে ভারী বৃষ্টির আভাস 'শ্রম আইন সংস্কার করে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে' সিংগাইরে ধলেশ্বরী নদী থেকে লাশ উদ্ধার সাতক্ষীরায় বজ্রপাতে মৎস্যচাষির মৃত্যু সাংবাদিক শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল বাবুর ওপর ডিম নিক্ষেপ

সকল