ঈদুল আজহার আর্থসামাজিক তাৎপর্য
- ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
- ১৪ জুন ২০২৪, ০০:০৫
- ঈদ উৎসবে উৎসর্গের সব আয়োজন আপ্যায়নের মর্মবাণীই হলো সামাজিক সমতা-সখ্যতা বৃদ্ধি এবং সম্পদ, সুযোগ ও সৌভাগ্যকে বণ্টন ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা, ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে যা নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। আত্মশুদ্ধির জন্য উৎসর্গ বা সংহার প্রকৃত প্রস্তাবে আল্লাহভীতি ও তার সন্তুষ্টি অর্জনের উপায় হিসেবে জীবে প্রেম বা দয়া ও সেবার প্রেরণাপ্রদায়ক হিসেবে প্রতিভাত হয়
হজরত ইবরাহিম আ:-এর নিজের প্রাণাধিক পুত্র ইসমাইল আ:-কে আল্লাহর রাহে কোরবানির সর্বোচ্চ ত্যাগ শিকারের স্মরণে পবিত্র ঈদুল আজহার উৎসব পালিত হয় মুসলিম বিশ্বে। এই উৎসবকে ভারতীয় উপমহাদেশে ‘বকরি ঈদ’ এবং ব্যবহারিক অর্থে ‘কোরবানির ঈদ’ও বলা হয়। বকরি ঈদ বলার কারণ এই ঈদে খাশি কোরবানি করা হয় আবার ‘বাকারা’ বা গরু কোরবানির ঈদ হিসেবেও ভাবা হয়। আরবি পরিভাষায় এই ঈদকে বলা হয় ‘ঈদুল আজহা’ বা আত্মত্যাগ বা উৎসর্গের উৎসব। সুতরাং ঈদুল আজহার তাৎপর্যগত বৈশিষ্ট্য বিচারে এই উৎসব পালনে গরু বা পালিত পশু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ বা কোরবানি করা। আর এই কোরবানির আগে পবিত্র হজ পালনের প্রসঙ্গটিও স্বতঃসিদ্ধভাবে এ উৎসবের সাথে এসে সংযুক্ত হয়। ঈদুল আজহার এই উৎসব হজ পালন ও পশু কোরবানিসূত্রে সমাজ ও অর্থনীতিতে বিশেষ তাৎপর্যবাহী প্রভাব ও কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
ঈদ উৎসবে উৎসর্গের সব আয়োজন আপ্যায়নের মর্মবাণীই হলো সামাজিক সমতা-সখ্যতা বৃদ্ধি এবং সম্পদ, সুযোগ ও সৌভাগ্যকে বণ্টন ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা, ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে যা নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। আত্মশুদ্ধির জন্য উৎসর্গ বা সংহার প্রকৃত প্রস্তাবে আল্লাহভীতি ও তার সন্তুষ্টি অর্জনের উপায় হিসেবে জীবে প্রেম বা দয়া ও সেবার প্রেরণাপ্রদায়ক হিসেবে প্রতিভাত হয়। ঘূর্ণিঝড় ও বন্যাকবলিত বাংলাদেশে এবার ঈদুল আজহা যেভাবে পালিত হোক না কেন, তা নিয়ে যত পর্যালোচনা চলছে, তার মধ্যে আর্থসামাজিক শক্তির উদ্বোধনের প্রত্যাশা পরিব্যাপ্ত হচ্ছে।
বিগত কয়েক বছরের মতো এবারো বাংলাদেশে ঈদুল আজহায় বাধ সেধে চলেছে বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনীতিতে, বিশেষ করে জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে চলমান মূল্যস্ফীতির সঙ্কট, কেননা এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ নিম্ন ও মধ্যবিত্তের বলয়ে, এখানে উচ্চবিত্তের সাথে মধ্য ও নিম্নবৃত্তের আনুভূমিক ও উলম্ব সম্পর্কেও দূরত্ব সাধারণ সমীকরণ ও সূচকের ধারেকাছে নয়। আসন্ন ঈদুল আজহার উৎসবে কর্মযোগ উপলক্ষে আয় উপার্জনের জন্য মুখিয়ে থাকা দেশের অধিকাংশ মানুষকে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ঈদুল আজহার সাথে সংশ্লিষ্ট হজব্রত পালন ও কোরবানি উপলক্ষে জেগে ওঠার সুযোগ মিশ্র সম্ভাবনার সুযোগ হাতছাড়া হতে চলেছে। অথচ এই উৎসব উপলক্ষেই আয় ব্যয় বণ্টন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বৈষম্য দূরীকরণের, সম্পদ ভাগাভাগির এবং মধ্য ও নিম্নবিত্তের জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে একটি উপায় উপস্থিত হয়ে থাকে।
হজ পালন ঈদুল আজহা উৎসবের একটি বিশেষ অংশ। পবিত্র হজ অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে বিশ্বের সব দেশের মুসলমানরা সমবেত হন এক মহা সম্মিলনে। ভাষা ও বর্ণগত, দেশ ও আর্থিক অবস্থানগত সব ভেদাভেদ ভুলে সবার অভিন্ন মিলনক্ষেত্র কাবা শরিফে একই পোশাকে, একই ভাষায় একই রীতি-রেয়াজের মাধ্যমে যে ঐকতান ক্ষণিত হয় তার চেয়ে বড় ধরনের কোনো সাম্য-মৈত্রীর সম্মেলন বিশ্বের কোথায়ও অনুষ্ঠিত হয় না। হজ পালনের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন রঙ ও গোত্রের মানুষের মধ্যে এক অনির্বাচনীয় সখ্য সংস্থাপিত হয়। বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের যা অনুপম আদর্শ বলে বিবেচিত হয়। করোনার কারণে গত বছর সীমিত অবয়বে হলেও এবার হজ, বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণের সুযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ। হজ পালন উপলক্ষে বৈদেশিক মুদ্রাসহ বিপুলসংখ্যক অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে। এবারো বাংলাদেশ থেকে লক্ষাধিক হজযাত্রী হজে গিয়েছেন। প্রতিজনে গড়ে ১০ লাখ টাকা ব্যয় নির্বাহ করলে এ খাতে মোট অর্থব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি, বৈদেশিক মুদ্রায় ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। হাজীদের যাতায়াতসহ সেখানকার ব্যয় বৈদেশিক মুদ্রাতেই নির্বাহ হয়। এর সাথে এই হজের ব্যবস্থাপনা ব্যয়েও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাংলাদেশী টাকা ও বিদেশী মুদ্রা ব্যয়ের সংশ্লেষ রয়েছে। ব্যাংকিং সেক্টরে এ উপলক্ষে লেনদেন ও সেবা সূত্রে ব্যয় বেড়েছে। গোটা সৌদি আরবের অর্থনীতি সেই প্রাচীনকাল থেকেই হজ মৌসুমের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বা ব্যবসায়-বাণিজ্যকে ঘিরে বা অবলম্বন করে আবর্তিত হয়।
পশু কোরবানি উপলক্ষে জাতীয় অর্থনীতিতে এক ব্যাপক আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় ঈদুল আজহায়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ গরু ও ৭০-৭৫ লাখ খাশি কোরবানি হয়। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) মতে- ২০২৩ সালে ৮০-৮৫ লাখ গরু ও ৭০ লাখ খাশি কোরবানি কর হয় । গরুপ্রতি গড় মূল্য ৬০ হাজার টাকা দাম ধরলে এই ৮৫ লাখ গরু বাবদ লেনদেন হয়েছিল ৩৪ হাজার কোটি টাকা এবং ৭০ লাখ খাশি (গড়ে আট হাজার টাকা দরে) আট হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ পশু কোরবানিতে প্রায় ৪০-৪২ হাজার কোটি টাকার ব্যবসায় হয়েছিল। কোরবানি উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রায় ছয় হাজার কোটির টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয় এ খাতে। কোরবানিকৃত পশুর সরবরাহ ও কেনাবেচার শুমার ও পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- চাঁদা,টোল,বখ শিশ, চোরাকারবার, ফড়িয়া, দালাল, হাসিল, পশুর হাট ইজারা, চাদোয়া, বাঁশ খুঁটির ব্যবসায়, পশুর খাবার, পশু কোরবানি ও বানানো এমনকি পশুর সাজগোজ বাবদও বিপুল অর্থ হাতবদল হয়ে থাকে। অর্থাৎ অর্থনীতিতে ফর্মাল-ইনফর্মাল ওয়েতে আর্থিক লেনদেন বা মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়।
কোরবানিকৃত পশুর চামড়া আমাদের অর্থনীতিতে রফতানি বাণিজ্যে, পাদুকা শিল্পে, পোশাক, হস্তশিল্পে এক অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রয় ও ব্যবহার উপলক্ষে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের ও প্রতিষ্ঠানের কর্মযোজনা সৃষ্টি হয়। এই চামড়া সংগ্রহ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকরণের সাথে ১৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও ব্যবসায় জড়িত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি বিশেষ ঋণ দিয়ে থাকে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৮০-১০০ কোটি টাকা। চামড়া নিম্ন দামে পাচার হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি মোকাবেলার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণর্ । দেশী-বিদেশী সিন্ডিকেটের কবল থেকে চামড়া ব্যবসায়কে উদ্ধারের কোনো বিকল্প নেই। দেশে নিজেদের চামড়া প্রক্রিয়াকরণ এবং উপযুক্ত মূল্যে তা রফতানির প্রণোদনা সৃষ্টি করাই এ পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি লাভ ঘটতে পারে। লবণ চামড়া সংরক্ষণের একটি অন্যতম উপাদান । ২০২৩ সালে সরকারকে ২০-২৫ হাজার টন লবণ শুল্কমুক্ত আমদানির উদ্যোগ নিতে হয়েছিল যাতে সিন্ডিকেট করে লবণের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি না হয়।
কোরবানির পশুর গোশত আমিষজাতীয় খাদ্যের উপাদান এবং এই গোশতের বিলি-বণ্টন প্রক্রিয়ায় রয়েছে আর্থসামাজিক তাৎপর্য-ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে বছরের একটি সময়ে সবার আমিষপ্রধান এই খাদ্যের সন্ধান-সরবরাহ লাভ করে থাকে। গোশত রান্নার কাজে ব্যবহৃত মশলা বাবদ প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার ব্যবসায় হয়ে থাকে এ সময়ে। মশলার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে ঈদ উদযাপনের ব্যয় ব্যবস্থাপনাকে বেচাইন পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করায়। সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল শুধু মিয়ানমার থেকে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার মশলা অবৈধভাবে প্রবেশ করে বাংলাদেশে।
উপরে উল্লিখিত লেনেদেনে দেশের ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য বাড়ে , তারল্য সঙ্কটে পড়ে যায় আর্থিক খাত, কলমানি মার্কেট থেকে চড়া সুদে ধারকর্জে নামে ব্যাংকগুলো। চামড়া ঋণ থেকে শুরু করে ঈদের বোনাস বাবদ বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ও এগিয়ে আসতে হয়। জাল নোট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নতুন নোট সরবরাহে নামতে হয়। মোদ্দা কথা, হজ ও কোরবানি উপলক্ষে মুদ্রা সরবরাহ ব্যবস্থায় যে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয় ব্যাংকিং খাতে তা তারল্য সঙ্কট সৃষ্টি করে এবং কলমানি মার্কেটে সুদের সূচকের ওঠানামা দেখে তা আঁচ করা যেত। এ সময়ে অবধারিতভাবে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পায়। তবে এবারে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মন্দার কবলে থাকার প্রেক্ষাপটে পশু বিপণন ও কোরবানি, চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ সব ক্ষেত্রেই দারুণ হতাশাজনক পরিস্থিতি বিরাজমান। ঈদ উপলক্ষে পরিবহন ব্যবস্থায় বা ব্যবসায় ব্যাপক কর্মতৎপরতা বেড়ে বেড়েছে। এটিও অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টির পথে সহায়ক ভূমিকায় আসছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা