অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা
- আবুল কাসেম হায়দার
- ১৪ জুন ২০২৪, ০০:০৫
দেশের বাজেট নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রতি বছর বাজেটের আগে আলোচনার ঝড় ওঠে। তেমনি এ বছর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে বিভিন্ন সমিতি ও চেম্বারের সাথে বাজেটের আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পরামর্শ গ্রহণের উদ্দেশ্যে আলোচনার আয়োজন করে থাকে। এবারো তেমনি হয়েছে বা চলেছে।
আগামী বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, রাজস্ব আহরণ ও বাজেট বাস্তবায়নে শ্লথগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অপচয় কমিয়ে দক্ষতার সাথে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ জন্য মধ্যবর্তী সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া উচিত।
বর্তমানে চ্যালেঞ্জ : দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি এখন নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। রাজস্ব আহরণ ও বাজেট বাস্তবায়নে শ্লথগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক খাতের তারল্য সঙ্কট, রফতানি, প্রবাসী আয় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এমন বাস্তবতায় আগামী বাজেটে তিনটি বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের চাপে রয়েছে। বিশেষ করে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সঙ্কটে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করাই বাজেটের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি আগামী বাজেটে পিছিয়ে পড়া মানুষের সুরক্ষা ও নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে ব্যাংক ঋণনির্ভরতা কমিয়ে রাজস্ব আয় দিয়েই সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয়। তবে জনগণের ওপর অর্থনৈতিক, অন্যায় চাপ সৃষ্টি করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা উচিত হবে না। যার ফলে ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় বন্ধ করার উপক্রম হবে। তবে সরকারের অপচয়, দ্রুত কমিয়ে আনতে হবে। আমাদের সব কর্ম তার ও প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। খরচের ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি।
চলতি অর্থবছরে অর্থনীতির স্থিতিশীলতার স্বার্থে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন টাকা বেশি না ছাপানো, ডলারের দাম বাজারের কাছাকাছি রাখা। তবে এসব উদ্যোগের পরও মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর রয়েছে। এ ছাড়া রফতানি, রিজার্ভ, প্রবাসী আয়, বিদেশী বিনিয়োগসহ বেশির ভাগ সূচকেই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
আইনের কঠোর প্রয়োগ : বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি কমানোর প্রধান লক্ষ্য স্থির করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। জোর করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য হঠাৎ হঠাৎ কিছু জরিমানা করে উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। তাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে আইনের কঠোর ও নিরপেক্ষ প্রয়োগের প্রয়োজন এবং এই প্রয়োগ অবশ্যই জনগণের কাছে দৃশ্যমান হতে হবে।
সবধরনের শিল্প খাতের ন্যূনতম মজুরি কাঠামো গঠন ও তা পুনর্নির্ধারণ করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নিত্যপণ্যের মূল্য লাগামহীন বৃদ্ধি রোধ করতে হবে। তার জন্য আমদানি মূল্যের ভিত্তিতে পণ্যের মূল্য সরকার নির্ধারণ করে দিতে হবে। তা বাস্তবায়নের জন্য কঠোর আইনের প্রয়োগ করতে হবে।
রাজস্ব ঘাটতি প্রসঙ্গ : বিগত ১৫ বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব ঘাটতি নিয়মিত থেকে যাচ্ছে। ২০২৩-২৪ সালে ঘাটতি থাকবে এবং বছর শেষে এই ঘাটতি ৮২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে। সরকারের বাজেট ঘাটতি কিছুটা কমেছে; কিন্তু ঘাটতি দূর করতে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বেড়েছে। তাতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমেছে। তাই নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে অনেক কম। শিক্ষিত বেকার সংখ্যা বাড়ছে। অন্য দিকে ব্যক্তি খাতের ঋণের প্রবাহ বেশ কমে যাচ্ছে। নতুন সরকারের ১০০ দিনের কর্মসূচির মধ্যে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যে কর্মচাঞ্চল্য থাকা প্রয়োজন, তা দেখা যাচ্ছে না। অর্থনীতি খাতের সংস্কার বড় ধরনের প্রয়োজন; কিন্তু আংশিক সংস্কার করে কোনো উপকার আসবে না। সার্বিক অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য আগামী বাজেটের অবশ্যই কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে।
ব্যাংকের একীভূত হওয়া : বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। সরকার বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক কারণে বহু ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। বর্তমানে অনেক ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকে সুশাসনের অভাবে এবার রাজনৈতিক অর্থনৈতিকতার পরে ব্যাংকিং খাত দেশে সবচেয়ে দুর্গম খাত। অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য সরকার দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। তা ভালো উদ্যোগ। তবে নিয়মনীতি মেনে তা করতে হবে। অন্য দিকে নতুন ব্যাংক দেয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করা প্রয়োজন। ব্যাংকিং আইনের সংস্কার জরুরি। অর্থ পাচার রোধে কঠোর কর্মসূচি নেয়া প্রয়োজন। ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে সুফল আসবে।
এডিপি পুরোটা ঋণনির্ভর : বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রায় পুরোটাই ঋণনির্ভর, এটি খুবই খারাপ দিক। এই দুর্বলতা ভবিষ্যতে দেশকে বিপজ্জনক ও বাধ্যতামূলক ঋণনির্ভরতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বিদেশী ঋণে গ্রহণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। তাতে দেশের অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। ঋণনির্ভর প্রকল্প গ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত। নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প গ্রহণে মনোযোগ দিতে হবে।
প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি, অনিয়ম ও দুর্নীতি দেখার জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠন খুবই প্রয়োজন। ২০২৩-২৪ বাজেট ওই কমিশন গঠনের প্রস্তাবনা মানা উচিত।
আরো কিছু প্রস্তাব : ১. দেশের শিল্প খাতের বিকাশের জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিত। বিশেষ করে স্পিনিং ও বস্ত্র খাতে সরকারের নজর দেয়া উচিত। স্পিনিং খাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য ৫০ শতাংশ কমানো উচিত। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ফলে এই খাত ভারতীয় পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতা টিকতে পারছে না। এই খাতের যে লোকসান চলছে, তা আরো দীর্ঘ হলে দেশের স্পিনিং খাতে ধস নামবে। তখন তৈরী পোশাক শিল্পের বিপর্যয় ঘটবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভাটা পড়বে। দেশের অর্থনৈতিক বিপদ আরো বৃদ্ধি পাবে। তাই স্পিনিং খাতে গ্যাসের মূল্য আগের পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য আগামী বাজেটে প্রস্তাবনা থাকা প্রয়োজন।
২. বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি কমিয়ে আনা উচিত। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণে বিনিয়োগ প্রয়োজন। বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারে সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া প্রয়োজন।
৩. দেশের পরিবেশ উন্নয়নের জন্য প্লাস্টিক ও প্লাস্টিক ব্যাগের উৎপাদনে বিধিনিষেধ আরোপ দরকার। পরিবেশ ভালো থাকার জন্য পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তাতে পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়বে। পরিবেশ ভালো থাকবে।
৪. স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বরাদ্দ দেয়া দরকার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৫ শতাংশ কর প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। ইংরেজি শিক্ষা খাত ভ্যাটমুক্ত হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষা বাণিজ্য নয়। তাই কর ও ভ্যাট শিক্ষা খাতে রাখা উচিত নয়।
বিদেশ থেকে স্কুল-কলেজ ছাত্রছাত্রীদের জন্য এই আমদানি সম্পূর্ণভাবে কর ও ভ্যাটমুক্ত করা উচিত। প্রকৌশল ও কারিগরি কলেজের ১৫ শতাংশ আয়কর প্রত্যাহার করা উচিত।
৫. ব্যাংকের সুদের হার অতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের জন্য এটি বড় সমস্যা। ব্যাংকের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার জন্য সরকারের নীতি সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন। ব্যাংকের লুটপাট ও অর্থপাচার রোধে কার্যকর দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের মধ্যে সুশাসন ও সবার জন্য সমান আইন এই ভিত্তিতে বিচার বিভাগকে গড়ে তুলতে হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা