১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ঈদুল ফিতর

-

পবিত্র রমজান মাসের পুরো সময় সিয়াম সাধনা তথা রোজা পালনের পর শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে মুসলিম জাহানে যে আনন্দ-উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে তা ‘ঈদুল ফিতর’ নামে অভিহিত। ‘ঈদুল ফিতর’ আরবি ভাষার দু’টি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ‘ঈদ’ অর্থ খুশি, আনন্দ; আর ‘ফিতর’ শব্দের অর্থ স্বভাব, উপবাস ভঙ্গকরণ। দীর্ঘ একটি মাস মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পালনার্থে উপবাস ও সংযম সাধনার পর বিশ্ব জাহানের মুসলমানরা এই দিনে উপবাস ব্রত হতে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং এ উপলক্ষে আনন্দ-উৎসব করে থাকে; এ জন্য এ উৎসবের নামকরণ করা হয়েছে ‘ঈদুল ফিতর’ বা স্বাভাবিকতায় প্রত্যাবর্তন বা উপবাসব্রত ভঙ্গের উৎসব।
উম্মাতে মুহাম্মদিকে আল্লাহ তায়ালা বিশেষ কিছু বরকতময় অনুষ্ঠান প্রদান করেছেন, যা অন্য কোনো নবী-রাসূলের অনুসারীরা লাভ করেনি। তন্মধ্যে পরস্পর ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা, প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে এক অনুপম দৃষ্টান্ত প্রদর্শন ও মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার অনুকম্পা লাভের অন্যতম প্রধান অনুষ্ঠান পবিত্র ঈদ।

প্রাচীনকাল থেকেই এ বিশ^ চরাচরের প্রায় প্রতিটি জাতি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসব পালন করে আসছে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে। এসব উৎসবে কোনো প্রকার উঁচু-নিচুর বৈষম্য, ধনী-গরিবের শ্রেণী-বিভেদ, কালো-ধলোর দ্বন্দ্ব সচরাচর তেমন লক্ষ করা যায় না, তবে ক্ষেত্রবিশেষে এর ব্যত্যয় যে ঘটে না তা হলফ করে বলা যাবে না। তেমনিভাবে সমগ্র বিশ^জাহানের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর বিভিন্ন উৎসবের মধ্যে ঈদ হচ্ছে বিশ^ মুসলিমের একটি বার্ষিক সম্মিলন ও উৎসবের দিন। এই বিশেষ দিন মুসলমানদের জীবনে বছরে দু’বার ফিরে আসে। সৌর বছরের এই দু’টি প্রধান উৎসবকে ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় বলা হয় ঈদ; এর একটি ‘ঈদুল ফিতর’, অন্যটি ‘ঈদুল আজহা’। ঈদের দিন বিশ^ মুসলিম পরস্পর হিংসাবিদ্বেষ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঈদগাহে গিয়ে ছোট-বড়, ধনি-নির্ধন, আমির-ফকির মিলিতভাবে একই কাতারে দাঁড়িয়ে এই বিশেষ দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করে থাকে। এ নামাজ আদায়ের উৎকৃষ্ট সময় সূর্যোদয়ের পর থেকে দ্বিপ্রহরের পূর্ব পর্যন্ত। কেউ বিশেষ কোনো কারণে এ নামাজ আদায় করতে না পারলে এর কোনো কাজা আদায় করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ ইসলামী শরিয়াহতে ঈদের নামাজের কাজা আদায় করার কোনো বিধান নেই।
হজরত রাসূলে করিম সা: মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর সেখানে দেখতে পান যে, প্রতি বছর মদিনায় পারসিকদের প্রভাবে শরতের পূর্ণিমায় ‘নওরোজ উৎসব’ এবং বসন্তের পূর্ণিমায় ‘মিহিরজান উৎসব’ উদ্যাপিত হয়ে আসছে। এ দু’টি বিজাতীয় উৎসবের রীতিনীতি ইসলামী রীতিনীতির পরিপন্থী ছিল বলে নবী করিম সা: মুসলমানদেরকে এতে যোগদান হতে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করেন এবং তদস্থলে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা- এই দু’টি উৎসব পালনের রীতি প্রবর্তন করেন।
ইসলাম এমন একটি পরিপূর্ণ জীবনাদর্শ যার কোনো বিধিবিধান, রীতিনীতি তথা কোনো কার্যাবলিই তাৎপর্যহীন, অকল্যাণকর, অনর্থক ও সাওয়াবশূন্য নয়। এ জন্যই মুসলমানরা একই সাথে আনন্দ-উৎসব পালন ও নানা রকম ইবাদত পালনের মাধ্যমে অশেষ সাওয়াব হাসিল করে থাকে। আল্লাহ তায়ালার মহান দরবারে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করার নামই ইসলাম, আর তার তাওহিদ বা একত্বের স্বীকৃতিই ইসলাম ধর্মের মূলকথা। মুমিন ব্যক্তির আকিদায় আল্লাহ তায়ালা সর্বশক্তিমান ও সর্বস্থানে সদা বিরাজমান। এ বিষয়ের আন্তরিক বিশ^াস, মৌখিক স্বীকৃতি এবং কার্যত এর অনুষ্ঠানাদি- এ তিনটি উপাদানের সমাবেশে ঈমান পরিপূর্ণতা লাভ করে। কেবল বিশ^াস বা শুধু মৌখিক স্বীকৃতির ফলে কেউ খাঁটি মুমিন বা সত্যিকার মুসলমান হতে পারে না। ওই উপাদানত্রয়ের একত্র সমাবেশের মাধ্যমেই প্রকৃত মুমিন হওয়া যায়। দীর্ঘ এক মাসকাল রোজা পালনের মাধ্যমে মুসলমানগণ বিশ^াসের স্বীকৃতি ও কার্যত প্রমাণ দিয়ে থাকে; তৎসঙ্গে খোদাপ্রীতি, ধর্মনিষ্ঠা, সংযম ও সাধনার পরিচয়ও দিয়ে থাকে। এভাবে ঈদের দিনে মুসলিম জীবনের বিশ^াস ও সাধনার বিজয় ঘোষিত হয়ে থাকে।

ঈদের দিন মুসলিম মিল্লাতের জন্য এক পরম আনন্দ উৎসব ও সামগ্রিক উৎকর্ষ সাধনের দিন। নবী করিম সা: ইরশাদ করেছেন, রোজাদারের জন্য দু’টি আনন্দ হলো- ১. রোজা ভঙ্গের সময় অর্থাৎ ইফতারের সময় ও ২. শেষ বিচারের দিনে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের সময়। পূর্ণ এক মাস সিয়াম সাধনা আর কঠোর সংযম ও কৃচ্ছ্র সাধন শেষে রোজাদারের অবস্থা পুরোপুরি উদ্ভাসিত হয় আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী তথা সবার সাথে পবিত্র ঈদের আনন্দ ভাগাভাগির মধ্য দিয়ে।
আল্লাহর হুকুমে তারই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মাসব্যাপী রোজা রাখার পর ঈদের নামাজ আদায় করার উদ্দেশ্যে ঈদগাহে গেলে একে অপরের হাতে হাত, বুকে বুক রাখলে মুসলমান ভুলে যায় সারা মাসের উপবাসের কষ্ট। ঈদের নামাজ হলো সামাজিক নামাজ। বছরান্তে দুই দিন সমাজের সর্বস্তরের মুসলিম জনতা ঈদের জামাতে সানন্দে উপস্থিত হয়। একে অন্যের সাথে সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময়ের একটা অপূর্ব সুযোগ আসে এই দিনে। তখন ছোট-বড়, ধনী-নির্ধন, আমির-ফকির, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের কোনো ভেদাভেদ থাকে না। মহান আল্লাহর কাছে আত্মনিবেদনের পর একে অন্যের সাথে বুক মিলিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়ের যে অনন্য সুযোগ লাভ করা যায়, তার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ঈদের নামাজ। ঈদুল ফিতরের সময় সমাজের গরিব-দুঃখীকে সাদ্কা-ফিতর প্রদান এবং একে অপরের সাথে সাক্ষাতে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয় তা-ই দুনিয়াকে বেহেশ্তের বাগানে পরিণত করে।
ঈদের দিন ও ঈদের রাতের ফজিলত অসীম। হজরত নবী করিম সা: যে পাঁচটি রাতের দোয়া কবুল হওয়ার কথা বলেছেন তার মধ্যে ঈদুল ফিতরের রাতটি অন্যতম। নবী করিম সা: আরো বলেন, প্রত্যেক জাতিরই খুশির দিন থাকে, আর আমাদের খুশির দিন হচ্ছে- ঈদুল ফিতরের দিন (সহিহ্ বুখারি ও সহিহ্ মুসলিম)।
ঈদ উৎসবের সন্ধিক্ষণে কে কত দামি এবং সুন্দর পোশাক পরল বা কে কত উন্নতমানের, সুস্বাদু পানাহার করল সেটা কখনো বিচার্য নয়, বরং বিচার্য বিষয় হচ্ছে পার্থিব জগতের সর্ব প্রকার লোভ-লালসা বিসর্জন দিয়ে নিজ আত্মাকে কে কতটুকু নিষ্পাপ রাখতে পেরেছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে ত্যাগ স্বীকার করে তার নৈকট্য লাভে সফলকাম হয়ে কে কতটা ধন্য হয়েছে।
অপর এক হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ঈদুল ফিতরের দিন উপস্থিত হলে আল্লাহ তায়ালা রোজাদার বান্দাদের বিষয়ে ফেরেশ্তাদের নিকট গৌরব করে থাকেন। তিনি ফেরেশ্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন- হে ফেরেশ্তা সব! কারো ওপর কোনো কাজের দায়িত্ব অর্পিত হলে সে যদি পুরোপুরিভাবে তা পালন করে, তবে তাকে কিরূপ প্রতিদান দেয়া উচিত? ফেরেশতারা উত্তরে বলেন, তাকে তার পুরোপুরি পারিশ্রমিক দেয়া উচিত। তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি আমার বান্দাদের ওপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিলাম তারা তা যথাযথভাবে পালন করেছে। অতঃপর মুমিন বান্দাগণ যখন দলে দলে দোয়া পাঠ করতে করতে ঈদগাহের দিকে রওনা হয়, তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের উদ্দেশ্যে বলেন- আমার ইজ্জত-প্রভাব-প্রতিপত্তির কসম! আমি অবশ্যই তাদের দোয়া কবুল করব। তার পর তিনি বান্দাদের উদ্দেশ্যে ডেকে ডেকে বলেন, হে আমার প্রিয় বান্দাগণ! আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি, তোমাদের পাপকার্যসমূহকে পুণ্যে পরিণত করে দিয়েছি; এবার তোমরা নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন কর। তখন তারা নিষ্পাপ অবস্থায় এবং প্রভূত পুণ্যের অধিকারী হয়ে নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করে।

ঈদুল ফিতরের দিন কিছু কাজ করা সুন্নত। আর তা হলো : ১. যতদূর সম্ভব অতি প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করা। ২. মিস্ওয়াক করা এবং সকাল সকাল গোসল করা। ৩. নিজের সাধ্যানুযায়ী উৎকৃষ্ট তথা পবিত্র, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা। ৪. সুগন্ধি দ্রব্য ও চোখে সুরমা ব্যবহার করা। ৫. যথাশীঘ্র প্রত্যুষে ঈদগাহে গমনে অযথা বিলম্ব না করা। ৬. সামর্থ্য অনুযায়ী উত্তম খাবারের বন্দোবস্ত করা এবং প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ইয়াতিম, ফকির-মিসকিন, গরিব-দুঃখীকে পানাহার করানো। ৭. ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে মিষ্টিমুখ করা, আর ঈদুল আজহার নামাজের পূর্বে কোনো প্রকার আহার গ্রহণ না করে নামাজের পর যথাশিগগিরই সম্ভব পশু কোরবানি করে সেই গোশত দ্বারা আহার করা। ৮. ঈদগাহে গমনের পূর্বেই সাদকায়ে ফিতর আদায় করা। ৯. ঈদগাহে এক পথে যাওয়া আর ফেরার সময় অন্য পথে আসা এবং যথাসম্ভব হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া। ১০. ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পথে চুপে চুপে তাক্বির (আল্লাহু আক্বার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার ওয়াল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ) পাঠ করা আর ঈদুল আজহা তথা কোরবানির ঈদের দিন উচ্চস্বরে উক্ত তাকবির পাঠ করা।
ঈদের দিন এবং রাতের মতো ঈদের নামাজের গুরুত্বও অপরিসীম। ঈদ আসে বিশ^-মুসলিমের দ্বারপ্রান্তে বার্ষিক আনন্দের বার্তা নিয়ে, আসে সীমাহীন প্রেম-প্রীতি, সৌহার্দ্য-ভালোবাসা ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে, সেই ঈদকে যথার্থ মর্যাদায় উদযাপন করা এবং ঈদের নামাজ যথাযথভাবে আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। বছরে দুই দিন বিশ^ মুসলিমের জন্য যে মহাসম্মিলনের ব্যবস্থা মহান আল্লাহ তায়ালা করে দিয়েছেন, যার অনুপ্রেরণায় সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষ পারে কোরআন নির্দেশিত সমাজ নির্মাণ করতে, পারে ন্যায়নীতি ও ইনসাফভিত্তিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিতে, সমাজের কলুষতা বিদূরীত করতে, পারে দল-মত নির্বিশেষে হিংসা-বিদ্বেষ-কলহ ভুলে পরস্পর প্রেম-প্রীতির ডোরে আবদ্ধ হয়ে ঈদের আনন্দের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণ করতে যার মাধ্যমে এই কণ্টকাকীর্ণ ও সঙ্ঘাতময় পৃথিবীতে স্বর্গীয় আবেশ সৃষ্টি হতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল