১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
ড. মোজাফফর হোসেন

আমাদের স্বাধীনতা ও রাজনীতি

-

স্বাধীনতার কথা বলতে গেলে রাজনীতির কথা বলতে হয়। রাজনীতির কথা এজন্য বলতে হয় যে, বাংলাদেশে যে রাজনীতি চর্চা হয় সে রাজনীতি স্বাধীনতাকেন্দ্রিক না হয়ে হয়েছে দলকেন্দ্রিক, পরিবারকেন্দ্রিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এ জন্য এদেশের রাজনীতি না জানলে স্বাধীনতাকে ঠিকমতো জানা হয় না। আবার রাজনীতির কথা জানতে গেলে রাজনীতির ইতিহাসকে জানতে হয়। রাজনীতির ইতিহাস থেকে যে সত্য ওঠে আসে সেই সত্যকে এ দেশে সহজে মেনে নেয়া হয় না। ধ্রুবসত্যের পক্ষে বিপক্ষেও এ দেশের লোক দাঁড়িয়ে যায়। পক্ষ-বিপক্ষরা গায়ের জোর দিয়ে, গলার জোর দিয়ে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রচার করে। প্রচার করা সেই সত্য-মিথ্যা নিয়ে বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধিবৃত্তিক ঝগড়া করে। তর্কবিতর্ক করে। শেষমেশ বুদ্ধি খাটিয়ে দেশের মানুষকে স্বাাধীনতার পক্ষে বিপক্ষে ফেলে দেয়ার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করে। আবার স্বাধীনতার পক্ষবিপক্ষ নিয়ে তুমুল হইচইও হয়। এই হইচইয়ে যে জিনিসটাকে ঠিক স্বাধীনতা বলে, সেই স্বাধীনতাটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। তখন আর স্বাধীনতাকে জানা যায় না, বোঝা যায় না, আর উপলব্ধিও করা হয়ে ওঠে না স্বাধীনতা আদতে কী। গত পঞ্চাশ বছর স্বাধীনতাকে ঘিরে এরকম নাটকই মঞ্চায়িত হতে দেখা গেছে বাংলাদেশে। স্বাধীনতা কিভাবে এসেছে সে দৃশ্য নাটকে পরিপাটিভাবে দেখা গেছে কিন্তু স্বাধীনতা জিনিসটা ঠিক কী! এ জিজ্ঞাসার জবাবদৃশ্য কোনো নাটকেই দেখা যায়নি।
ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার অব্যাহতিতে শোনা গেছে, মুসলমানরা সোচ্চার না হলে ভারতবর্ষ স্বাধীন হতে আরো সময়ক্ষেপণ হতো। এখন আর এ কথাটা একেবারে শোনা যায় না। ভারত স্বাধীনের পক্ষে মুসলমানরা সোচ্চার যে ছিল এটা এখন অনেকে স্বীকারও করতে চান না। ভারতবর্ষ স্বাধীন করার ব্যাপারে যাদের আত্মত্যাগ ছিল অগ্রগামী সেই মুসলিম বরেণ্যদের কী এক কৌশলে স্মৃতি থেকে মুছে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। এ রকমটা বাংলাদেশ স্বাধীনের ব্যাপারেও হতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ স্বাধীনের সময় যারা আত্মত্যাগ করেছে, যাদের অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখা দরকার, তাদের দু-একজনের নাম ব্যতীত আর কারো নামই স্মৃতিতে আনতে পারে না এ দেশের এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। পারে না মানে এই নয় যে, তারা মনে করতে চায় না; বরং তাদের জানতে দেয়া হয় না। এটি করা হয়েছে ইতিহাসকে আড়াল করার মধ্য দিয়ে। অথচ ইতিহাস যে চেপে রাখা যায় না; এটিও আমরা ভুলে যেতে চেয়েছি বার বার।
একটা ব্যাপার লক্ষ করা গেছে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা তথা ভারত-পাকিস্তানের জন্ম সেই ১৯৪৭ সালের সময়টাকে কে যেন বলেছে ’৪৭ সালটা দেশ স্বাধীনের সাল নয়, এটি দেশ ভাগের সাল। কথাটার গুরুত্ব একেবারে নেই, এ কথা বলা যাবে না। গুরুত্ব আছে। দেশ স্বাধীন আর দেশ ভাগ এক জিনিস নয়। ভাগ শব্দটা দ্বারা আপাতত বিরোধ মিটমাট করাকে বোঝায়। ভাগ শব্দটার তেমন কোনো তাৎপর্যও নেই। শুধু বিরোধ মিটমাটের জন্যই শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সেই অর্থে ভারতবর্ষ ভাগাভাগি হয়েছে মাত্র। কিন্তু স্বাধীনতা শব্দের তাৎপর্য আছে। স্বাধীনতা শব্দের মধ্যে আত্মসম্মান আছে। সার্বভৌমত্ব আছে। অধিকার আছে। মর্যাদা আছে। স্বাতন্ত্র্য আছে। এ বিষয়গুলোর ঘাটতি থাকলে স্বাধীনতা ঠিক স্বাধীনতা হয়ে ওঠে না। ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে যে কয়টি দেশ সৃষ্টি হয়েছে তার সব কয়টা দেশেই আত্মসম্মানবোধ, মর্যাদাবোধ, সার্বভৌমত্ব ও স্বাতন্ত্র্যের অভাব দেখা গেছে। এ অর্থে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন ভারতবর্ষের মানুষ এখনো করতে পারেনি। এ জন্যই স্বাধীনতা শব্দটি ব্যবহার না করে ভাগ শব্দটি হয়তো ব্যবহার করা হয়েছে। দেশ শুধু ভাগই হয়েছে, স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। তাহলে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে ভাগ হয়েছে? না কী স্বাধীন হয়েছে? এ জিজ্ঞাসার সরল জবাব খুঁজতে গিয়ে বিস্তর বিতর্কও লক্ষ করা যায়।
স্বাধীনতাকে জানতে হলে রাজনীতিকে বোঝা জরুরি। একটি দেশের স্বাধীনতা টিকে থাকা না থাকা নির্ভর করে সে দেশের রাজনীতির ওপর। যুগে যুগে সেটিই হতে দেখা গেছে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের ভেতর দিয়ে স্বাধীন বাংলা যে পরাধীন হয়েছিল সেখানেও রাজনীতি ভূমিকা রেখেছিল। ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। সেটিও সম্ভব করা হয়েছিল রাজনীতির মাধ্যমে। পরে পাকিস্তান থেকে পূর্বপাকিস্তান আলাদা হয়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশ হলো সেটিও সম্ভব হয়েছে রাজনীতির জন্য। এজন্য একটি দেশের স্বাধীনতাকে জানা মানে সে দেশের রাজনীতিকে জানা। রাজনীতিতে যে কাজটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় তা হলো জনমত তৈরি করতে পারা। জনমতকে পরীক্ষা করা হয় ভোটের মাধ্যমে। কল্যাণমূলক আধুনিক রাজনীতির প্রধান নিয়ামকও ভোট। ৫৪ সালের নির্বাচনে ভোটের ফলাফলকে উপেক্ষা করে পূর্বপাকিস্তানকে ধরে রাখতে পারেনি পশ্চিম পাকিস্তান। অল্প দিন পরই পূর্বপাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ হলো। সুুতরাং রাজনীতিতে ভোটের গুরুত্বকে অবহেলা করা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন ভোটের গুরুত্ব লোপ পেয়েছে। জনমত যখন উপেক্ষিত হয়েছে তখন আইন আদালত সামাজিক আচরণ ও বাজার অর্থনীতি চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। অপরাধ দুর্নীতি বেড়েছে, নিত্যপণ্যের বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সর্বোপরি জনসাধারণ চরম নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তায় জীবন যাপন করে এসেছে, যা একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌম বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়েনা। এর ফলে যা হয়েছে তা হলো- দেশের সার্বভৌমত্ব সম্মান ও মর্যাদা যেমন প্রশ্নের মুখে পড়েছে তেমনি স্বাধীন দেশের নামে মর্যাদাবোধও মানুষের মধ্যে কমে গেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিশেষ কিছু ব্যক্তির ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তা দেশের স্বাধীনতার মর্যাদাকে খাটো করেছে। যে কাজকর্মের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা সেসব কাজকর্ম কোনোভাবেই স্বাধীন সার্বভৌম দেশে চলতে পারে না। অথচ বাংলাদেশে সেসব চলেছে এবং তা সরকারের নিয়ন্ত্রণের সীমা অতিক্রম করেছে। ওদিকে দিনের পর দিন সীমান্ত হত্যাও বেড়েছে। এসব বিবেচনায় নেয়া হলে স্বাধীনতা শব্দটার সাথে যে প্রতিনিয়ত প্রতারণা চলেছে তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
দেশের স্বাধীনতা যে শুধু বহিঃশত্রুর আক্রমণে বিপন্ন হতে পারে এমনটি ভাবা সমীচীন হবে না। একটি দেশের স্বাধীনতা যেমন বহিশত্রুর আক্রমণে বিপন্ন হতে পারে, তেমনি অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বিনষ্ট হলেও স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে। তবে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা অটুট রাখতে পারলে সম্মিলিতভাবে বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার মাধ্যমে স্বাধীনতার বিপন্ন হওয়া রোধ করা যায় কিন্তু অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ভঙ্গ হলে দেশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করা কঠিন হতে পারে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ অস্থীরতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হতে পারে। চোখের সামনে এদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতায় শত শত লোক মারা গেছে। আমলাতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতায় রাষ্ট্রের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্তসারশূন্যে পরিণত হয়েছে। বড় ব্যবসায়ীরা আড়ালে রাষ্ট্রের ও জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। রাজনীতিকরা মাত্র দুজন মানুষকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাকি মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছে। এভাবেই দেশ অভ্যন্তরীণ শত্রুতে ভরে উঠেছে। এ অবস্থা এমন হয়েছে যে, স্বাধীনতার খোলসে মীর জাফরেরা বাসা বেঁধেছে এবং রাজনীতিতে তারা পুনর্বাসিতও হয়েছে। এ অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি।


আরো সংবাদ



premium cement
স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক, প্রকৃত ইতিহাস লেখা হয়নি: বদরুদ্দীন উমর রাজশাহীতে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ২ কর্মী গ্রেফতার জামায়াত নেতা ড. তাহের সম্পর্কে সাংবাদিক ইলিয়াসের মন্তব্যের প্রতিবাদ গাজীপুরে নতুন ট্রেন ও অসমাপ্ত বিআরটি লেনে বিআরটি বাস সার্ভিসের উদ্বোধন বেনজীর ও মতিউরের বিরুদ্ধে দুদকের ৬ মামলা ছিনতাই রোধে রাজধানীতে শেষ রাতে পুলিশি টহল বাড়ানোর নির্দেশ পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্টের সাথে বিএনপি নেতাদের সৌজন্য সাক্ষাৎ জামায়াতের একজন নেতাও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেনি: ড. মাসুদ মালয়েশিয়ায় বেতন না পেয়ে কোম্পানির অফিস ঘেরাও-অবরোধ, যা বলল বাংলাদেশ দূতাবাস সংস্কার বা পরিবর্তন সবকিছু শুরু হয়েছিল বিএনপির হাত ধরেই : মির্জা ফখরুল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নতুন ভর্তি ৩৭৩

সকল