মানুষ ও মানবিকতা
- শহিদুল ইসলাম
- ১২ মে ২০২১, ০০:৩৩
‘মানুষ হয় প্রাণী’-কথাটিতে মানুষের স্থান প্রাণী জাতের মধ্যে অবস্থান করে। কিন্তু যদি বলা হয় ‘মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী’। তাহলে সে বৃদ্ধিবৃত্তি দ্বারা অন্যান্য প্রাণী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। তবে মানুষের সংজ্ঞায় কেবল বুদ্ধিবৃত্তি এবং জীববৃত্তি দ্বারা সন্নিবেশ বললে মানুষ আর মানুষ থাকে না। সে হয় নিকৃষ্ট ও বর্বর। তার আচরণ দ্বারা সমাজ সভ্যতা কাঁপতে থাকে। তাই নীতিবিজ্ঞানীরা মানুষের সংজ্ঞা জীববৃত্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তির সাথে নৈতিক আদর্শ দ্বারা সন্নিবেশিত। একটি কুকুর যখন একজন পথিকের পায়ে কামড় দেয় তখন তাকে আমরা অনৈতিক বলে চিৎকার দিয়ে উঠি না। কারণ কুকুর জীবজগতের সদস্য কিন্তু নীতিসম্পন্ন না। অন্য দিকে একজন মানুষ যদি কোনো মারামারি, কাটাকাটি তো দূরে থাক ধাক্কাও দেয় তাহলে আমরা তাকে অনৈতিক বলে চিৎকার দিয়ে উঠি।
সৃষ্টিজগতে শ্রেষ্ঠত্বের স্থান অধিকার করেছে মানুষ। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার পরেই মানুষের অবস্থান। সে স্বর্গীয় অবতারেরও উপরে চলে গেছে। মানুষ সৃষ্টি না করলে স্রষ্টার জগৎ সৃষ্টি ব্যর্থ হয়ে যেত কি না সন্দেহ। কারণ স্রষ্টার সৃষ্টির বিশালতা এত বেশি যে তা নিয়ে একমাত্র মানুষই চিন্তা করতে পারে। এমনকি গবেষণাও করতে পারে, যা অন্যান্য জীব পারে না। প্রাণিজগতের আহার পরিমিত ও নির্ধারিত। কিন্তু মানুষের ক্ষুধা বাহুমাত্রিক নির্ধারিত নয়। মানুষের যেমন আছে আত্মিক ক্ষুধা তেমন আছে জৈবিক ক্ষুধা। আর এই ক্ষুধার ট্রেনিং তাকে অন্যান্য প্রাণী থেকে পার্থক্য করে ফেলেছে। মানুষের ভেতর যিনি জৈবিক ক্ষুধা দ্বারা তাড়িত তার দ্বারা জগৎ অন্য রূপে পরিগণিত হয়। আর এই ক্ষুধার ট্রেনিং দেয় মিডিয়া। মিডিয়ায় সেক্স এবং ভায়োলেন্সের কথা প্রচার প্রসার হতে দেখা যায়। এবং মানুষের স্বাধীনতা তার জৈবিক চাহিদাকে বাড়িয়ে তুলেছে। এই জৈবিক চাহিদা অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে মানুষের বেশি। অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধকে অনেক দার্শনিক ভালোভাবে মেনে নিতে পারেননি। যার কারণে সে জরায়ুর স্বাধীনতা দাবি করেছে। কিন্তু মানুষ আর প্রাণী একই শ্রেণীভুক্ত হতে পারে না। মানুষ যেমন নিরলস সাধনার ফলে নির্মাণ করেছে বিশ্বসভ্যতা; তেমনি মানুষের হাতে আছে ধ্বংসাত্মক অস্ত্র। কিন্তু অস্ত্র তৈরি হয়েছে সভ্যতার কল্যাণের জন্য। একটি রাইফেল অথবা চাকু অথবা ছুরির কথাই ধরা যাক। এগুলো তৈরি করা হয়েছে মানুষের মঙ্গলের কাজে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু মানুষ এই সমস্ত অস্ত্র তার লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে পাশ কাটিয়ে ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যয় করেছে। অথচ উদ্দেশ্য ছিল ভালো।
মানুষ ধীরে ধীরে যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে। বর্তমান সভ্যতা মানুষের সামনে আসছে মঙ্গলের বার্তা নিয়ে। কিন্তু এই মঙ্গলময় সভ্যতা মানুষ ধরে রাখতে পারবে কি না বিশ্ববিবেককে ভাবিয়ে তুলেছে। গৃহস্থালির কাজ, রান্নাবান্না, খনি গবেষণার কাজে ব্যবহার হচ্ছে কৃত্রিম মানুষ রোবট। মানুষ আরাম করে বসে থাকবে আর রোবট তার সব কাজ করে দেবে। কিন্তু এত আরাম-আয়েশ মানুষের সহ্য হবে কি না ভাবিয়ে তুলেছে। কারণ জগতে হতাশা, ব্যর্থতা, পারিবারিক ভাঙন, রোগ-ব্যাধি, আত্মহত্যা, ক্ষুধা, যন্ত্রণা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মানুষের ভেতর অবিশ্বাস এবং অশান্তি তার আরামকে কেড়ে নিচ্ছে। সে চলেছে অন্ধকার গলিপথে। যে পথ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। আর এই পথ মানুষেরই সৃষ্টি। মানুষ খামাখা রক্তপাতের পথকে বেছে নিয়েছে। এই পথ থেকে সুপথে নিয়ে আসার জন্য মনীষীদের আগমন ঘটেছে। মানবতার কথা বলতে গিয়ে তারা নিগৃহীত, বঞ্চিত ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের চলার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এই পথের কাণ্ডারিরা জীবনের মোহ ও সুখ ভোগ ত্যাগ করে জাতিকে আলোকিত করার শপথ গ্রহণ করেন। তারা নিরলস সাধনার মাধ্যমে নিজের জীবনটা পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে জগদ্বাসীর কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাদেরকে শ্রদ্ধা করা এক ধরনের নৈতিক কাজ। কিন্তু আজ যারা বিশ্বসমাজ নির্মাণ করেছেন সেই বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিক ধর্ম প্রচারকগণ তারা তাদের সৃষ্টি এবং ত্যাগ, তিতিক্ষা দ্বারা জাগতিক চেহারা পরিবর্তনের স্বপ্নে ছিলেন বিভোর। বিশ্ববাসী তাদেরকে স্মরণ করে। আমরা মানবতার অন্ধকার আকাশে কিছু তারকা উজ্জ্বল হয়ে ঝিকমিক করে জ্বলতে দেখি। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা এক ধরনের শ্রদ্ধেয় কাজ। মনীষীদের আগমন যদি দুনিয়ায় না ঘটত তাহলে এই সুন্দর আলো ঝলমল জগৎ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতো।
কোনো কবি, দার্শনিক সাহিত্যিক বিজ্ঞানী অথবা ধর্মপ্রচারক আকাশ ভেঙে নামে না আবার পাতাল ফুঁড়ে উঠে না, সমাজের বাস্তবতায় তাদের জন্ম হয়। তারা ছিল বিমোহিনী ইন্দ্রিয়জালিক নেতা। সমাজের গতানুগতিক মানুষের তুলনায় তারা ছিলেন ভিন্ন। বিশ্ববাসী তাদেরকে নেতা হিসেবে স্বীকার করে। সভ্যতার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো সত্যজ্ঞানে জ্ঞানী সুশীলসমাজ। কিন্তু আজ মানুষ কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা এই গোলকধাঁধায় একত্রে আসতে পারেনি। তারা জাগতিক রঙিন চশমার প্রবৃত্তি দ্বারা তাড়িত হয়ে আলো আঁধারির মধ্যে পড়ে গেছে। এই জ্যোতিহীন অস্বচ্ছ জীবনদর্শন দ্বারা মানবতার মুক্তি সম্ভব নয়। মানুষকে সত্য জ্ঞানে উদ্ভাসিত হতে হবে। যার মাধ্যমে মানবতা মুক্তি পাবে। মানুষ ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য স্বাধীনতা দাবি করেছে। কিন্তু স্বেচ্ছাচারিতা স্বাধীনতার ইতিহাসকে জলাঞ্জলিত করেছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের যোগ্যতা যার নেই স্বাধীনতা দাবি করার অধিকার তার নেই। স্বাধীনতা মানে সুনির্বাচিত অধীনতা।
পাশ্চাত্যের একজন চিন্তাবিদ বলেছেন মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত। তার কৃতকর্ম বিবেক দ্বারা তাড়িত যা অন্যান্য প্রাণী বা পশু-পাখির ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
স্বাধীনতা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ম্যাক্সিম গোর্কি বলেনÑ
‘সব রকম আনুগত্য বা বশ্যতাই মন্দ, কারণ এর দ্বারা অন্যায় অসত্য জোরদার হয়।’
উইলিয়াম ফ্রেডরিক বলেন, ‘খাঁচায় আবদ্ধ পাখির কণ্ঠে যে গান সে গানে তার বন্দিত্বের সুরই ফুটে উঠে।’
আমরা পরাধীনতা চাইনে আমরা স্বাধীনতা চাই। তাই এ কথা বলতে ইচ্ছা হয় খাঁচার ভেতর বন্দী বাঘের চেয়ে মুক্ত স্বাধীন গাধা অনেক ভালো। যে জাতি শান্তিতে আছে তার পেছনে আছে রক্তের ইতিহাস। কারণ শান্তির পূর্বশর্ত হলো রক্ত। আমাদের মনে রাখা দরকার স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। এত ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে এবং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জন হলো তা রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে হবে জাগ্রত বিবেককে। জাতির এই জাগরণ সৃষ্টি করতে না পারলে একটা সম্ভাবনাময় সমাজ ধ্বংস হবে। জাতির ভেতর দেশপ্রেমের শিক্ষা দিতে হবে। আত্ম মর্যাদাবোধ ও আত্মপ্রত্যয়ের শিক্ষা দিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে মূল্যবোধ ও মানবতাসম্পন্ন দেহমন। তবেই পাওয়া যাবে প্রকৃত সুনাগরিক। যারা দেশের জন্য নিজের জীবনটা পর্যন্ত বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না। আজ বিভ্রান্ত তরুণসমাজ, অবক্ষয়ের শিকার যুবসমাজ এবং নীতিজ্ঞানশূন্য সুশীলসমাজ জাতির অস্তিত্বে আঘাত হেনেছে। জাতিকে আজ মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং জ্ঞান অন্বেষণ সীমানার ভেতর ফেলে দিয়েছে। জাতির ভেতর পরমতসহিষ্ণুতার স্থানে চিন্তাচেতনায় সঙ্কীর্ণতা ও নাশকতা স্থান দখল করেছে। দয়া মায়া ভালোবাসা মানুষের মন থেকে বিদায় নিতে চলেছে।
একটি সমাজ একটি শিশু বেড়ে ওঠার জন্য দরকার যোগ্য পরিচালক। এই পরিচালকের যোগ্যতা নির্ধারণ করবে কে? কেবা এই পরিচালক? এই পরিচালকের কিভাবে তৈরি হবে? আমরা যদি বস্তুবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ি তাহলে মানুষের নন্দনতত্ত্ব এবং আত্মিক বিষয়গুলো অনুপস্থিত থাকবে এটা স্বাভাবিক। কারণ দেহ ও আত্মা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুবাদে এগুলোর স্বীকৃতি নেই। ভাববাদ বৈরাগ্য আছে কি না জানার দরকার। কারণ ভাববাদ এবং বস্তুবাদের সমন্বয় দরকার। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পাশ্চাত্য বস্তুবাদ এবং প্রাচ্যের ভাববাদী শিক্ষা দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে সাজাতে হবে। উগ্রবস্তুবাদ এবং সন্ন্যাসব্রত জীবনের ক্ষেত্রে শান্তি নেই। আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় উভয়ের স্বীকার যদি করতে পারি তাহলে আমাদের দেহ মন বিকশিত হবে এবং প্রস্ফুটিত হবে। আর তার মাধ্যমে শান্তির পথ প্রশস্ত হবে। হ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা