২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আদি হিন্দুরা গো-মাংস খেতেন

-

এ বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা করে বই প্রকাশ করতে গিয়ে ভয়ানক বিপদে পড়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা। অসহিষ্ণু ধর্মান্ধ রক্ষণশীল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সমর্থকরা ‘অধ্যাপক নারায়ণ ঝা’কে বারবার মৃত্যুর হুমকি দিয়েছেন, ঈশ্বর নিন্দার কারণ দর্শিয়ে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে কোর্টের মাধ্যমে তার গবেষণার প্রকাশ বন্ধ করিয়েছে। পরবর্তীতে অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা The Myth of the Holy Cow নামে তার গবেষণার সারবস্তু লন্ডন থেকে প্রকাশ করেন।
সম্প্রতি ভারতে গো-রক্ষার নামে যেভাবে মুসলমান হত্যা চলছে তা আধুনিক জগতে চরম নিন্দনীয় ও অকল্পনীয়। গোধুলিলগ্নে চারণভূমি থেকে গরু নিয়ে ফেরার সময় গো-হত্যার অভিপ্রায়ের অজুহাতে মুসলিম রাখাল বালক হত্যা, বাড়িতে গো-মাংস রাখার অভিযোগে পুরো মুসলমান পরিবারকে পুড়িয়ে মারার কর্মকাণ্ডে সারা পৃথিবী বিস্মিত, স্তম্ভিত ও চিন্তিত।

প্রাচীন ভারতে গো-হত্যা ছিল ব্রাহ্মণ্য সেবার অবিচ্ছেদ্য অংশ
প্রাচীনকাল থেকে ভারতে গো-হত্যা ও গো-মাংস আহারের ব্যাপক প্রচলন ছিল উচ্চ ও নিম্নবর্ণের হিন্দু বাড়িতে, সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, ব্রাহ্মণ্য তুষ্টিতে এবং বিভিন্ন রাজকীয় ও ধর্মীয় গো-মেধযজ্ঞে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৬০০ শতাব্দীর সব ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ ও লোকসাহিত্যে উৎসব করে ভারতে গো-মাংস আহারের প্রমাণ পাওয়া যায় জন্মানুষ্ঠান, মহাব্রত, শ্রাদ্ধ ও ব্রাহ্মণ সেবায়। কাম সংহিতায় উল্লেখ আছে, তান্ত্রিক ব্রাহ্মণদের শারদীয় সেবা করতে হতো ১৭টি অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী খর্বকায় ষাঁড় এবং তিন বছরের কম বয়সী গো-শাবক হত্যা দিয়ে। অবশ্য ন্নিবর্ণের দরিদ্র হিন্দুদের কালভদ্রে গো-মাংস আহারের সৌভাগ্য হতো। চণ্ডাল ও অচ্ছুতদের গো-হত্যা করে গো-মাংস আহারের অধিকার ছিল না। তারা মৃত গরুর মাংস খেত এবং গরুর চামড়া দিয়ে জুতা ও অন্যান্য দ্রব্য তৈরি করত, তারা গরুর হাড়ের ব্যবহারও করত। এ প্রথা ভারতের নিম্নবর্ণের অচ্ছুত হিন্দুদের মধ্যে আজও বহাল আছে। পুষাণ দেবতার পছন্দ কালো গাই, রুদ্রের প্রিয় লাল গরুতে। বৈদিক দেব-দেবীরা বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণীতে অনুরক্ত ছিলেন। কেউ বা মহিষ, কেউ বা ছাগল, কেউ ভেড়ায়। ইন্দ্রের পছন্দ গোলাকার শিংযুক্ত ষাঁড় ও সাদা হাতিতে, অগ্নিদেবতার আকর্ষণ ছিল অশ্ব ও গো-মাংসে।
রিগবেদে কি করে তলোয়ার বা কুড়াল দিয়ে গরু হত্যা করতে হবে এবং পরে রন্ধন করে ভোগ করতে হবে তার বর্ণনা আছে। বৈদিক ও বৈদিক পরবর্তী যুগে ভারতীয়রা গো-মাংস কেবল আহার করত তাই নয়, তাদের বিশ্বাস ছিলÑ পিতা-মাতার শবদেহ দাহনের সময় একই সাথে রিষ্টপুষ্ট ষাঁড় পোড়ালে মৃত ব্যক্তি ষাঁড়ে আরোহণ করে স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবেন। এরূপ ঘটনার উল্লেখ আছে অর্থ বেদের বর্ণনায়।
ভারতে আগত আর্যরা ছিল যাযাবর এবং কৃষিতে অনভ্যস্ত। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ থেকে কাজাকিস্তান, কিরগিজস্তান, তাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তুরস্ক ও পূর্ব ইউরোপের পোলান্ড, রুমানিয়া, শ্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, নরওয়ে প্রভৃতি দেশ থেকে আর্যরা ভাগ্যের অন্বেষণে স্থলপথে কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছে। অবশ্য দ্রাবিড়রা ভারতে বসতি গড়েছিল আর্যদের আগমনের কয়েক হাজার বছর আগে ৮০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে।
যাযাবর জীবনের পরিসমাপ্তিতে আর্যরা পরিচিত হয় সহজলভ্য খাদ্য হিসেবে গো-মাংসের সাথে। বৃহৎ জনবসতির কারণে ভারতে বনজ প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেয়েছিল, তবে গৃহপালিত ষাঁড়, মহিষ, গরু ও ছাগলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল দ্রুত গতিতে।
ব্রিটিশ প্রশাসক উইলিয়াম ক্রুক ১৮৯৪ সনে প্রকাশিত তার ব্যাপক গবেষণা গ্রন্থ The Veneration of the cow in India তে দেখিয়েছেন, আর্যরা কেবল গো-মাংসভোগী ছিল তাই নয়, তাদের গো-মাংসে বিশেষ আকর্ষণ ছিল।
মহাভারত ও রামায়ণ চরিত্রদের গো-মাংসপ্রীতি বিশেষভাবে প্রাণিধানযোগ্য। ধ্রুপদি দেবতাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, পঞ্চপাণ্ডবের বনবাসের অবসান হলে যুধিষ্ঠির সহস্র ষাঁড় ও গরু বলিদান করে দেবতাদের তুষ্ট করবেন। পঞ্চপাণ্ডবরা তাদের বনবাসকালে সহজলভ্য গৃহপালিত গরুর মাংস সংগ্রহ করত এবং গো-মাংস আহারে তাদের শক্তি সঞ্চিত হতো, গোবর ও গোমূত্রের ব্যবহারও ছিল তাদের জীবনযাত্রায়। মহাভারতে আরো উল্লেখ আছে, রাজা রতিরতœদেব প্রতিদিন সহস্র গরু জবাই করে ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিলি করে পুণ্য অর্জন করত।
বাল্মিকীর রামায়ণে এ জাতীয় আরো ঘটনার বিবরণ আছে। জনশ্রুতি যে, ব্যাপক সংখ্যক গরু বলিদানের ফলে রাজা দশরথের সন্তান রামের জন্ম হয়। রাম পতœী সীতা যমুনা নদী অতিক্রমকালে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, রাম তার পিতৃ আদেশ সফলভাবে পালন করতে পারলে তারা যমুনা নদীতে দেবীকে সহস্র গাই-গরু ও সহস্র ভাড় মদ উৎসর্গ করবে। অবশ্য সীতা নিজে গো-মাংসের চেয়ে হরিণের মাংস বেশি পছন্দ করত।
চরক সংহিতা ও সুশ্রুত সংহিতায় ওষুধ হিসেবে গো-মাংস আহার এবং গোমূত্র সেবনের উপকারিতার বিবরণ আছে। গরুর লেজ ও হাড়ের ঝোলের বিধান আছে বিভিন্ন প্রদাহের চিকিৎসা হিসেবে। চরম সর্দি, সাধারণ জ্বর, পেটের গণ্ডগোল নিরাময়ে গো-মাংস পথ্য হিসেবে বিধান দিয়েছে। সুশ্রুতের মতে, শ্বাসকষ্ট, শ্লেষ্মাজনিত সমস্যা ও দীর্ঘস্থায়ী জ্বরে গো-মাংস ওষুধের কাজ করে। সুশ্রুত গরুর মাংসকে ভগবানের পবিত্র দান রূপে চিহ্নিত করেছে। গর্ভবতীকে গো-মাংস খাওয়ালে গর্ভস্থ শিশু বলবান হয়।
সপ্তম শতাব্দীতে, চিকিৎসক ভগবত গোমূত্র ও গো-কন্যা (ইরষব) বিবিধ রোগ নিরাময়ের জন্য বিধিপত্র (প্রেসক্রিপশন) দিত। গরুর পঞ্চ উপাদানে প্রস্তুত পঞ্চ গর্ভের আধুনিক সংস্করণ পঞ্চমর্ত্য যা পূজা-পার্বণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। পাসর, বৈষ্য ও শঙ্করের মতে, গরুর মুখ ছাড়া সব অংশ আহারযোগ্য ও পাপ মোচনে ব্যবহারযোগ্য। শল্যবিদ সুশ্রুত এক হাজার ২০টি রোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছে সুশ্রুত সংহিতায়। সুশ্রুতকে প্লাস্টিক সার্জারির জনক বলা হয়। তিনি শতাধিক মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করেছিলেন। প্রাচীন ভারতে গো-মাংস ভক্ষণের বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে পিভি কেইন সম্পাদিত বৈদিক যুগের ৫ (পাঁচ) খণ্ড ধর্মশাস্ত্রের ইতিহাসে।
ভারতের জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও গো-মাংসে তৃপ্তি পেতেন, গৌতম বুদ্ধও একসময়ে গো-মাংস আহার করতেন। জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীরও গো-মাংস ভক্ষণ করতেন। পরবর্তীকালে তারা উভয়ে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন ধর্মীয় কারণের জন্য নয়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের সাথে ব্রাহ্মণদের সাথে পার্থক্য সৃষ্টির জন্য ও রাষ্ট্রীয় শাসন সুবিধার জন্য।
গো-হত্যা প্রাচীন যুগে মহাপাপ বলে স্বীকৃত হয়নি। বৈদিক যুগে মনু-সংহিতায় গো-হত্যা সাধারণ পাপ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে ব্রাহ্মণের গরু অব্রাহ্মণ বধ করলে কঠিন শাস্তির বিধান হয়Ñ গো-শালায় রাত্রি যাপন করে কেবল গরুর পাঁচ উপাদান (পঞ্চগর্ভ) ভক্ষণ করে। গো-হত্যাকারীকে ২৫ দিবা-রাত্রি অনাহারে থাকতে হতো।
রিগবেদ ও উপনিষদের সাতটি মহাপাপ হলোÑ (১) ব্রাহ্মণকে অপমান; (২) ব্রাহ্মণ হত্যা; (৩) চৌর্যবৃত্তি; (৪) প্রতারণা; (৫) মদ্যপান (সুরাপান); (৬) গুরু স্ত্রীর সাথে যৌনাচার এবং (৭) ব্যভিচার।
আরবরা ভারতে পৌঁছে গো-মাংস আহারে পরিচিত হয়। ভাগ্যের অন্বেষণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী রাজা ও দলপতিরা ভারত বিজয় করেছেন বিভিন্ন শতাব্দীতে। এদের কেউ এসেছেন ইরান থেকে, কেউ বা আফগানিস্তান থেকে, কেউ বা তুরস্ক থেকে, কেউ মধ্যপ্রাচ্য, কেউ বা রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। তাদের দীর্ঘ পথযাত্রায় খাদ্যের জোগান এসেছে বনজ প্রাণী, হরিণ, অর্শ্ব, উট, দুম্বা, গণ্ডার ও মহিষ থেকে। রোদ্রে শুকিয়ে এসব প্রাণীর মাংস দীর্ঘ দিন রেখে খাওয়া যায়। গো-মাংস কখনো এদের যাত্রাপথের সামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হতো না। ধাই মাতার সাথে আরবদের দীর্ঘ বন্ধন ছিল। তাই দুধদানকারী প্রাণী হত্যায় তাদের মানসিক অস্বস্থিবোধ ছিল। চারণভূমির স্বল্পতার কারণে গৃহপালিত গরুর সাথে তাদের পরিচয় ছিল সীমিত। মরুভূমি দেশ আরবে চারণভূমির অভাব সর্বজনজ্ঞাত। মঙ্গোলিয়াবাসীরা ছিল ব্যতিক্রম। মঙ্গোলিয়ায় ব্যাপক চারণভূমি রয়েছে। গৃহপালিত প্রাণীর রক্ষণাবেক্ষণ মঙ্গোলিয়াবাসীর মূল পেশা।
আরবরা ভারতে প্রথম পর্দাপণ করে ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দে, স্থলপথে নয়, সমুদ্রপথে। আরব সেনাপতি সোহেল বিন আবদি ও হাকাম আল তাকবি ভারত সমুদ্রে রাজিলের যুদ্ধে ভারতীয়দের পর্যুদস্ত করে সিন্ধুতে পৌঁছেন। ভারতের পথে সেনা অভিযানে পূর্বানুমতি না নেয়ার কারণে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ না করে তাদের আরবে ফিরে যেতে হয় খলিফা ওমরের নির্দেশে। সমুদ্রাভিযানে আরব সেনানিদের খাদ্য ছিল খেজুর এবং অর্শ্ব, উট ও দুম্বার শুকনো মাংস। আরবরা দুগ্ধবতী প্রাণীর মাংস ভক্ষণে কখনো উৎসাহ বোধ করেনি। খলিফা ওসমানের আমলে ৬৫২ খ্রিষ্টাব্দে আরবরা মাকরান এবং ওমাইদ খলিফা মাবিয়ার আমলে ৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে পাঞ্জাব বিজয় করে। মুহাম্মদ বিন কাশিম আরবদের সিন্ধুতে বসতি স্থাপন করায় ৭১০ খ্রিষ্টাব্দে। ঐতিহাসিক আলবেরুনি ভারত সফর করেছিলেন ১০৩০ খ্রিষ্টাব্দে। পরবর্তীকালে উজবেকিস্তান থেকে আগত তৈমুর লং, গজনীর সুলতান মাহমুদ, সাহাবুদ্দীন মহাম্মদ গৌরী, বখতিয়ার খিলজি প্রমুখ ভারত বিজয় করে শাসন করেছেন প্রায় চার শ’ বছর।
১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দে জহির উদ্দিন বাবর ভারত বিজয় করে মোঘল সাম্রাজ্যের পত্তন করেন।
ভারতে পৌঁছে ভাগ্য অন্বেষণকারী বিজয়ী মুসলমানেরা কৃষিকাজে ব্যাপক সংখ্যক গরুর ব্যবহার এবং একই সাথে ভারতীয়দের গরু বধ করে গো-মাংস আহার ও ধর্মীয় কাজে ব্যাপক গো-মাংস বিতরণ দেখে বিস্মিত হন। তারা লক্ষ করেন, গরুর দুধের বিবিধ ব্যবহারÑ সরাসরি দুগ্ধপান, দই, মাখন, ছানা ও ঘি উৎপাদনে। ভারতীয়দের গোবর ভক্তিতে মুসলমানরা আশ্চর্যান্বিত হয়েছেন। গোবর ব্যবহৃত হতো মন্দিরের বেদী পরিষ্কার করার নিমিত্তে এবং গোবর খাইয়ে ভক্তের পাপ মোচনে। নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা গোবর শুকিয়ে ব্যবহার করত জ্বালানি হিসেবে। গরুর লেজের ঝোল ও গোমূত্রের ওষুধ হিসেবে ব্যবহারে মুসলমানেরা হতবাক হয়ে পড়েন। ভারতে বনজ প্রাণীর স্বল্পতার কারণে অন্যদেশ থেকে আগত মুসলমানেরা ক্রমে ক্রমে গো-মাংস আহারে অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং একেক দেশের মুসলমানরা একেক রকমের মসলা, চর্বি ও তৈল সংযোগ গো-মাংস রন্ধনে বৈচিত্র্য আনেন। তুর্কি, মোগল, পারসিদের গো-মাংস রন্ধন প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন ধরনের রসনা তৃপ্তির স্বাদ বিস্তার লাভ করেছে ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।
অল্পবয়সী গো-শাবক মাংসে ব্রাহ্মণদের আসক্তির কারণে গাই গরুর সংখ্যা কমতে থাকলে কৃষিতে সমস্যা দেখা দেয় এবং দুধেরও অভাব সৃষ্টি হয়। গরুর দুধের স্বল্পতায় শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা স্বাস্থ্য সঙ্কটে পড়ে। চাষাবাদের ক্ষতিরোধ করার লক্ষ্যে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর ও আওরঙ্গজেব গো-হত্যা সীমিত করেন, গো বধের আগে কাজীর অনুমতি নেয়ার বিধানও চালু করেন। এতে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীরা খুশি হলেও ব্রাহ্মণরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন। তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে বিঘœ সৃষ্টি ও হস্তক্ষেপ বলে প্রচারণায় চেষ্টা করে ব্রাহ্মণরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। স্মরণযোগ্য যে, সম্রাট আকবরই প্রথম সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন।

মুসলমানরা ভারতে গো-হত্যা আরম্ভ করেননি, গো-মাংস আহারের প্রচলনও করেনি। বরঞ্চ মুসলমান শাসকরা গো-হত্যা সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন কৃষিকাজের উন্নয়ন এবং শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষার নিমিত্তে।
ভারতে গো-বধের সামাজিক আচার থেকে গো-রক্ষার রাজনীতি
প্রাচীন ভারতে গো-হত্যা মহাপাপ দূরে থাকুক, সাধারণ পাপ হিসেবে বিবেচনা হতো না। তবে ব্রাহ্মণের গরু চুরি অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো, সামান্য শাস্তির বিধান ছিল।
মধ্যযুগে সম্রাট অশোকের আমলে (খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৮ থেকে ২৩২) মূলত বৌদ্ধধর্মের সুবিধার্থে এবং হিন্দুধর্মের সাথে দৃশ্যমান পার্থক্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সম্রাট অশোক সৃষ্ট ৮৪ হাজার স্তূপের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকটি স্তূপে গো-বধ রোধের প্রস্তাবনা লিপিবদ্ধ রয়েছে।
মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে একাধিকবার পরাজিত মহারাষ্ট্রের ছত্রপতি শিবাজি ভোসলে (১৬৩০-১৬৮০) বিজয়পুর গুহায় আত্মগোপন করেন। পরাজয়ের গ্লানিতে তার সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে তিনি শঠতা ও ছলনার আশ্রয় নিয়ে নিজেকে ভগবানের পুর্নজীবন প্রাপ্ত অবতার ঘোষণা দিয়ে হিন্দুদের উজ্জীবিত করে এবং গো-হত্যা নিষিদ্ধ করে। এতে হিন্দুদের পাশাপাশি বৌদ্ধ ও জৈনরা খুশি হয় এবং তারা ভারত রক্ষার সংগ্রামে যুক্ত হয় অবতার ভগবান শিবাজির নেতৃত্বে। রায়ঘর দুর্গে অবস্থানরত ছত্রপতি শিবাজি ভোসেলের মৃত্যু হয় ৩ এপ্রিল ১৬৮০। রক্ত আমাশয়ে এবং পতন হয় মারাঠা রাজ্যের। তবে গো-রক্ষা আন্দোলন নিঃশেষ হয় না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিবাজি উৎসবে লিখলেনÑ
ধ্বজা করি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরী বসন দারিদ্র্যের বল,
‘এক ধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে’ এ মহাবচন করিব সম্বল।
মারাঠির সাথে আর্জি হে বাঙ্গালি, এক কণ্ঠে বলো জয়তু শিবাজি।
১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পাঞ্জাবে গো-রক্ষা রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়, দয়ানন্দ সারাভাস্তি ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম গো-রক্ষা সভা অনুষ্ঠান করেন যা ক্রমেই হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় পরিণত হয়। উত্তর-পশ্চিম ভারতের হাইকোর্ট ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে গরু পবিত্র প্রাণী নয় বলে রায় দেয়ার পরও আজমগড়ে ব্যাপক দাঙ্গা হয় ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে এবং শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। অযোধ্যায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৯১২-১৩, ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে এবং সাম্প্রতিকালেও একাধিবার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে গো-মাংস ভক্ষণ করলেও স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬০-১৯০২) পরবর্তীতে ভারতে ফিরে গো-রক্ষার প্রবক্তা হন।
গো-রক্ষার স্রোতের বিরুদ্ধে সাহসের সাথে একমাত্র রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) গো-মাংস ভক্ষণের অধিকার নিশ্চিতকরণের জন্য ক্রমাগত ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছেন। আধুনিক যুগে রক্ষণশীলতা পরিহার করে নির্বিবাদে গোবরের জ্বালানি ও ওষুধি হিসেবে ব্যবহার এবং গো-মাংস ভক্ষণের অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ হচ্ছেÑ Hindu Authorities in favor of slaying the cows and eating its flesh. রাজা রামমোহন রায় হিন্দু ধর্মের বিভাজনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে ভারতীয় রাজনীতিতে তার প্রবেশ সহজ করার লক্ষ্যে বেছে নেন গো-রক্ষায় আন্দোলন এবং প্রকাশ করলেন পবিত্র গাভী (Sacred Cow) তথ্য। মহাত্মা গান্ধীর পবিত্র গাভী (Sacred Cow) তথ্য রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার খোরাক সৃষ্টি করে এবং গো-রক্ষা আন্দোলন জোরদার হয়। গান্ধী লিখলেন ‘মা এবং দুগ্ধদানকারী গাভী উভয় অতীব প্রয়োজনীয়। তবে গাভীর অবদান বেশি। সন্তান জন্মের প্রথম কয়েক বছর স্তন্যদান করেন এবং প্রত্যাশা করেন যে, পরবর্তীতে সন্তানরা মাকে দেখাশোনা করবে, অসুস্থ হলে তার সেবাযতœ করবে। গাভী কশ্মিনকালে রোগাক্রান্ত হয়। মা মারা গেলে ব্যাপক অর্থ ব্যয় করে কবরস্থ বা শবদাহ করতে হয়। অপরপক্ষে মৃত গাভীর চামড়া থেকে শুরু করে প্রতিটি অঙ্গ আমাদের অর্থের জোগান দেয়।’
গান্ধীর বক্তব্যে ভর করে রাষ্ট্রের সেবক সঙ্ঘ (আরএসএস), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরঙ্গ দল গো-রক্ষা আবেদন তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করে। এ জাতীয় প্রচারণার কারণে সব ভারতীয় রাজনৈতিক দল গো-হত্যা নিষিদ্ধ করে গো-রক্ষার ধারা ভারতীয় সংবিধানে যুক্ত করার দাবিতে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় পার্লামেন্টের সামনে ব্যাপক বিক্ষোভ করে। বজরঙ্গদল গো-হত্যা নিষিদ্ধকরণের জন্য ৩০ লাখ কর্মী সমাবেশ করে ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই প্যাটেল গো-রক্ষার জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন। গান্ধীর পুনজন্ম রূপে পরিচিত আচার্য বিনোবা ভাবে এপ্রিল ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে দীর্ঘমেয়াদি অনশন পালন করে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে বাধ্য করেন গো-হত্যা নিষিদ্ধ করে গো-রক্ষা আইন প্রণয়নে।
নৃতত্ত্ব¡বিদ অধ্যাপক মারবিন হ্যারিসের মতে, গান্ধীর গাভী তথ্য ছিল ব্রিটিশ ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের বড় অস্ত্র। ‘গরু ঘিরে’ (Rallying round the Cow) রাজনীতির বিশদ বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা ভারতীয় ইতিহাসবিদ রনজিৎ গুহ। ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর হিন্দুদের গো-মাংস আহারের রাজনীতির বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছেন ‘The Untouchables: Who were they and why they Become Untouchables’ বইতে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে।

ভারতের ললাটে কি সোভিয়েতের বিভক্তি আসন্ন?
রাশিয়ার কমিউনিস্ট নেতা জোসেফ স্ট্যালিন এক হাতে সমাজতন্ত্রের আদর্শ, অপর হাতে সামরিক শক্তির দম্ভ ও চতুরতায় পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীকে পদানত করে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়া যার ইংরেজি নাম ইউএসএসআর (USSR- United States of Soviet Russia)। সোভিয়েট রাশিয়ার বিস্তৃতি ছিল উত্তর এশিয়া থেকে শুরু করে পূর্ব ইউরোপ, সীমানা ছিল পোলান্ড, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, চেকশ্লোভাকিয়া, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, তুরস্ক, মঙ্গোলিয়া, ইরান, আফগানিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও চীনের সাথে। এত বড় দেশ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র শতবর্ষ দূরে থাকুক, ৭০ বছর উদযাপন করতে পারেনি অন্য ধর্মাবলম্বী ও জাতি-গোষ্ঠীর প্রতি অসম ব্যবহার ও অন্যায় আচরণের কারণে।
ইসলাম ও খ্রিষ্টান ধর্ম পালনে বিঘœ সৃষ্টি, রুশ ভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ও বিকাশে বাধা দেয়া, ভিন্নমতের কণ্ঠস্বরদের সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে কেবল রোধ নয়, ব্যাপকভাবে গুম ও নির্বাসন দেয়া, সর্বোপরি আঞ্চলিক প্রাকৃতিক সম্পদের স্থানীয় ব্যবহার সৃষ্টি না করে মূল রাশিয়ায় ব্যাপক শিল্প সৃষ্টিতে ব্যবহার করে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর ক্ষোভ বাড়িয়েছে যা পরবর্তীতে বিদ্রোহে রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ১৫টি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পুরো স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসন অর্জন করেছে। রাষ্ট্রগুলো হচ্ছেÑ রাশিয়া, জর্জিয়া, উইক্রেন, মলডোবা, বেলারুশ, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজস্তান. তাজাকিস্তান, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এসটোনিয়া। শক্তিধর সোভিয়েত রাশিয়া স্তিমিত হয়েছে ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে।
সোভিয়েট বিভক্তির প্রায় সব উপাদান ভারত প্রজাতন্ত্রের জন্মকাল থেকে বিদ্যমান ছিল। মহাত্মা মোহনদাস করমদাস গান্ধীর অহিংসার মূলমন্ত্র ভারত প্রজাতন্ত্রের ভাগ্য নির্ধারণে নিয়োজিত ব্রাহ্মণদের অন্তরে কখনো স্থান পায়নি। ভারতে অন্য ধর্মাবলম্বী বিশেষত মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ, ধর্মীয় অনুশাসন পালনে বাধা ও ঘৃণা সৃষ্টি এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুদের পদদলিত রাখার ক্রমাগত চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশের বিপরীতে সর্ব ভারতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দির প্রচলনের জন্য উত্তর ভারতীয় শাসক ব্রাহ্মণকুলদের ব্যাপক আর্থিক সাহায্য, ক্রমাগত প্রচারণা ও আনুকূল্যে উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রগুলোর উপর হিন্দি চাপিয়ে দেয়ায় আঞ্চলিক ক্ষোভ বাড়তে থাকে।
কাশ্মির জম্মুর ৮০ শতাংশের অধিক জনগণ মুসলমান। তাদের আকাক্সক্ষা স্বাধীন কাশ্মিরের। জনগণের মতামতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে কাশ্মির জম্মুর হিন্দু শাসক ডোগরা মহারাজা স্যার হরি সিং হিন্দুপ্রধান ভারত প্রজাতন্ত্রের সাথে যুক্ত হওয়ার নিমিত্তে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু ও গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হন। ভারত প্রজাতন্ত্র সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে অতর্কিতে ২৭ অক্টোবর ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে কাশ্মির দখল করে।
কাশ্মিরের জনগণের আবেদনক্রমে পাকিস্তান কাশ্মিরের অংশবিশেষ উদ্ধার করলে, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৭ ভারত জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের সাহায্য কামনা করে। ১ জানুয়ারি ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধবিরতি ও কাশ্মিরে গণভোটের প্রস্তাব গৃহীত হয় নিরাপত্তা পরিষদে। প্রতিশ্রুতি ভেঙে ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪ কাশ্মিরকে বিশেষ বিবেচনাধীন রাজ্যরূপে ভারত অন্তর্ভুক্ত করে এবং সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে নারী ও তরুণদের উপর নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। যেই পদ্ধতিতে সিকিম রাজ্যকে ভারত প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করেছে।
সম্প্রতি ৫ আগস্ট ২০১৯, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় সংবিধানের ৩৫ (ক) ও ৩৭০ ধারা অবলুপ্ত করে মুসলমান প্রধান কাশ্মিরকে হিন্দুপ্রধান রাজ্য হিসেবে সৃষ্টির সব ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে আট লাখ সেনা মোতায়েন করেছে এবং সব মৌলিক অধিকার রহিত করেছে। কাশ্মিরের জনগণের ক্ষোভ অগ্নিস্ফুলিঙ্গে রূপ নিচ্ছে।
৩-৮ জুন, ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় জেনারেল কুলদীপ সিং ব্রারের নেতৃত্ব অপারেশন ব্লুস্টার পাঞ্জাবের অমৃতসরস্থ শিখদের প্রাণপ্রিয় হরমন্দির সাহিব (স্বর্ণ মন্দির) ধ্বংস করার চিত্র আজও সজ্জন ভারতীয়দের চিত্ত থেকে মুছে যায়নি।
হিন্দু অবতার (Hindutva) দাবিদার গেরুয়াধারী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (আরএসএস), ডিএইচপি, বজরঙ্গ দল ও শিবসেনা দলিত হিন্দু, সংখ্যালঘু মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের উপর বিভিন্ন প্রকার অত্যাচার অব্যাহত রেখেছে ভারত প্রজাতন্ত্র সৃষ্টির পর থেকে। ভারতের প্রায় ২০০ বছরের (১৭৫৭-১৯৪৭) স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের হিন্দু সরকার সুপরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের অবদানের কথা অনুল্লেখ করে বিস্মৃত করেছেন। ভারতীয় হিন্দু শাসকরা সুপরিকল্পিতভাবে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের অবদান অনুল্লেখ করে তাদের মনে হীনম্মন্যতা সৃষ্টি করেছে। জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ জেনারেল ডাজারের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগ প্রতিবাদের প্রাণপুরুষ ব্যারিস্টার সাইফুদ্দিন কিসলুর নাম নেই। তার যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়েছিল। কিশোর ক্ষুদিরামের কাহিনী ইতিহাস। অথচ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ যিনি বিপ্লবীদের অহরহ ফাঁসি দেয়া কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক নরম্যানকে প্রকাশ্য দিবালোকে হাইকোর্টের সিঁড়িতে অসম সাহসে হত্যা করেছিলেন ২০ সেপ্টেম্বর ১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে, তার স্থান হয়নি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে। নেহরুর সমসাময়িক ব্যারিস্টার খাজা আবদুুল মজিদ ও তার স্ত্রীর বহু বছর জেল খাটার উল্লেখ নেই ভারতের সরকার প্রণীত স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থে। সে ইতিহাসে উল্লেখ নেই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর প্রধান সহকারী আবিদ হাসান’ শাহনেওয়াজ খান এবং অনন্য সাহসী সেনানি কর্নেল জেড কিয়ানি, আবদুল করিম গণি, কর্নেল জিলানির সাহসিকতার কথা। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও কংগ্রেস সভাপতি হাকিম আজমল খানকেও অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। ইংরেজদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে আত্মদানকারী পাহলোয়ান শিশু খানের নামও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নেই।
লর্ড মেয়োর আন্দামান পরিদর্শনকালে বিপ্লবী কার্যকলাপের কারণে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত শের আলী হঠাৎ আক্রমণ করে লর্ড মেয়োকে হত্যা করে ফাঁসিতে আত্মদান করেন। শের আলী মুহাম্মদ আবদুল্লাহর মতো স্থান পাননি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক শান্তিময় রায় ওই বিষয়ে সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন ‘ভারতের মুক্তি সংগ্রাম ও মুসলিম অবদান’।
উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিতাড়নের জন্য অনুসরণ করেছে তাদের পূর্বপুরুষ শঠতার রাজা শিবাজির অনুকরণে বিভক্তির এক পন্থা এনআরসি (National Register of Citizens)। ফলে ৪০ লাখ মুসলমান গৃহহারা ও কর্মচ্যুত হচ্ছে। এনআরসি কার্যকর করা হয়েছে ৩১ আগস্ট ২০১৯ সালে। এনআরসির নাম বহির্ভূত আসামের হিন্দু-মুসলমানদের বিশেষ সেনা ছাউনিতে স্থানান্তর শুরু হয়েছে। হতাশায় প্রতিদিন আত্মহত্যার সংবাদ আসছে।
কেন্দ্রীয় ভারত সরকার সামরিক বাহিনীর দ্বারা নিয়ন্ত্রণ রাখছে আসাম, কাশ্মির, তামিলনাড়–, খালিস্তান, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, অরুণাচল. মনিপুর ও ত্রিপুরা। এসব রাজ্যে জনগণ উত্তর ভারতের উপনিবেশতুল্য আচরণ এবং ধর্মীয় বর্ণবৈষম্যবাদের যাতনায় জর্জড়িত। ব্যাপক সংখ্যক সেনানিদের এসব অঞ্চলের নারীদের ওপর যৌন আক্রমণ প্রত্যেক সন্ধ্যার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে উচ্চবর্ণের শাসকদের অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য সংগঠিত হচ্ছে মাওবাদী নকশালপন্থীরা। বিস্তারিত হচ্ছে তাদের বিচরণক্ষেত্র পশ্চিমবঙ্গ থেকে দক্ষিণ ভারতের কর্নাটক পর্যন্ত। মাওবাদীদের অবাধ বিচরণের কারণে ওই অঞ্চল লাল অলিন্দ (Red Corridor) নামে পরিচিতি লাভ করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে তাদের প্রায়শই আক্রমণের কথা ভারতীয় মিডিয়াতে স্থান পাচ্ছে। ২০১৫ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী রাজনাথ সিং অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, ছত্রিশগড় এবং লাল অলিন্দের নিরাপত্তার জন্য ২৫ ব্যাটালিয়ন নিরাপত্তা সেনাবাহিনী সৃষ্টি করেছেন জনগণকে সাহায্যের জন্য নয়, চরম নিপীড়নের মাধ্যমে দমনের নিমিত্তে। মহারাষ্ট্র ও ছত্রিশগড়ের সীমানা বিভক্তকারী ইন্দ্রবতি নদীর পাড়ে গ্যাডচিলি জেলায় ২২-২৩ এপ্রিল ২০১৮ সালে এক সম্মুখ সংগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক সংখ্যক সেনানি নিহত হয়েছে। ওই সংঘর্ষে ৩৯ জন মাওবাদী কর্মীও মারা গেছে।
ভারতে মুসলমানরা নিজের পছন্দমতো খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না, নিজস্ব উপাসনার অধিকার নেই, সরকারি চাকরিতে তাদের অবস্থান দলিতদেরও নিচে। গো-মাংস রন্ধন ও আহার স্বপ্নাতীত ব্যাপার হয়ে গেছে। অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও দখল করায় ঘটনা ভারতীয় আদালতের বিচারাধীন। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গেরুয়া ভারত সরকারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (আরএসএস) প্রধান মোহন ভগবত বলেছেন, উন্নত হিন্দু সংস্কৃতির কারণে ভারতের মুসলমানেরা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুখী, বিদ্রƒপ না কাটা ঘায়ে লবণের ছিটা? ভিন্নধর্মাবলম্বীদের জোর করে জয়শ্রীরাম বলানো ব্রাহ্মণ্যবাদের বিকাশ এবং সরকারের অলিখিত নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত।
সাত কন্যা রাজ্যের (Seven Sister) বিপ্লবীদের ব্যাপক জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে বিবেচনায় না নিয়ে বিচ্ছিন্নবাদী (স্বাধীনতাকামী) যাতায়াত ও প্রশিক্ষণ বাংলাদেশ সরকার বন্ধ করে দেয়ায় আসামে ‘উলফা’ কার্যক্রম স্তিমিত হয়েছে বটে, তবে আসামের জনগণের আকাক্সক্ষা কখনো মুছে যাবে না।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মাওবাদীদের আখ্যা দিয়েছেন The Single biggest internal Security Challenge রূপে, ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব জি কে পিল্লাই বলেছেন, মাওবাদী নকশালদের লক্ষ্য ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের অবসান!
২০৪৭ সালে ভারত প্রজাতন্ত্রের শতবার্ষিকী কি কেবল পশ্চিম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, মহারাষ্ট্র, মধ্য প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে পালিত হবে? না দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্ব ভারতেও? ভারত প্রজাতন্ত্রের কপালে কি সোভিয়েত রাশিয়ার (১৯২২-১৯৯১) ভাগ্যলিখন নির্ধারিত? বাংলাদেশ সরকার কি তার সংবিধানিক প্রতিশ্রুতি অনুসারে ‘উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত কন্যার দেশের জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার এবং সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতের সংগ্রামী নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন দেবে? ঠিক যেভাবে ১৯৭১ সালে ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন?
ঋণ পরিশোধের অপূর্ব সুযোগ সমাগত।
তথ্যসূত্র :
১. The Myth of the Holy Cow, Navayana Publishing, New Delhi,2015, 4th Reprint
২. W. Crooke, The Veneration of the Cow in India, Folklore, London, 1912
৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সঞ্চয়িতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থ বিভাগ, কলকাতা ১৪০৯ বাংলা সন।
৪. R.K Dasgupta, Spirit of India, The Statesman, ১৫ মার্চ ২০০১ এ পুনঃ মুদ্রিত।
৫. M.K. Gandhi, How to Serve the Cow, Navajivan, Ahmedabad,1954,১৯৫৪.
৬. Marvin Harris,The Cultural Ecology of India’s Sacred Cattle, Current Anthropology ১৯৬৬.
৭. Ranajit Guha, Rallying round the Cow, Subaltern Studies Oxford University Press, Delhi 1983.
৮. আরএসএস প্রধান, ‘ভারতের মুসলমানরা সবচেয়ে সুখী- দৈনিক সময়ের আলো ও দেশ রূপান্তর, ঢাকা ১৪ অক্টোবর ২০১৯।
৯. M. Serajuddin, Kashmir may prove India’s Soviet Union, the Weekly Holiday, Dhaka 26 Aug; 2019
১০. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ধারা ২৫ (খ,গ), গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (অক্টোবর-২০১১)।

 


আরো সংবাদ



premium cement