২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯ ফাল্গুন ১৪৩০, ২২ শাবান ১৪৪৬
`

ফাগুন রাতের পরী

ফাগুন রাতের পরী -


পূর্ণিমা রাত। আকাশের রূপালী চাঁদ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। সাদা ধবধবে ফ্রক পড়ে ফুল বাগানে ঘুরে বেড়ায় বিন্দু। আচানক তাকিয়ে দেখে পরী মেয়েরা গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে উড়ে যাচ্ছে। লাল পরী, নীল পরী, সবুজ পরী, হলুদ পরী, কমলা পরী, সোনালি পরী... আরো কত কি বাহারি রঙের পরী!!
বিন্দুকে দেখে লাল নীলকে বলছে, দেখ দেখ ফুল বাগানে ফুটফুটে শিশু কন্যা। আমাদের মতোই সুন্দর লাগছে।
-আরে ধ্যাত। কি বলতে কি বলিস। আমাদের মতো সুন্দর হতে যাবে কেন ? ওদের সুন্দরের মধ্যে কৃত্রিমতা আছে। যা আমাদের মধ্যে নেই। ফুলের সৌন্দর্য থাকলেও যেমন ভেতরে কাঁটা থাকে কিংবা পোকা থাকে। ওদের সুন্দরের ভেতরও তেমনি কিট আছে। আমরা পবিত্র সুন্দর। দেখিস না ওরা কথায় কথায় সুন্দরকে আমাদের সাথে তুলনা করে।
-চল যাওয়ার আগে একটু খেলে যাই। নেচে গেয়ে এই সুন্দর রাত মুখরিত করে তুলি।
-হে চল চল। যেমন কথা তেমন কাজ।
পরীরা নেমে আসে বিন্দুর ফুল বাগানে।
পরীদের দেখে বিন্দুর চোখ ছানাবড়া!!

-শুভ রাত্রি বিন্দু!!
-শুভ রাত্রি!! বলতে বলতে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে এক ঝাঁক পরী।
-তোমরা। কেন এসেছ এখানে ? বিন্দু জানতে চায়। -জানো না এই বাগানে কারো ঢুকতে মানা। আমার অনুমতি নেই। এই ফুল বাগানে শুধু আমি একা থাকব। আর কেউ নয়।
-দুঃখিত। বড্ড ভুল হয়ে গেছে বিন্দু। এখন থেকে তোমার অনুমতি নিয়েই খেলতে আসব। এখন কি তোমার সাথে খেলতে পারি।
-হে পারো? সম্মতি দেয় বিন্দু। হুম কি চাও এখানে?
-তোমার ফুল বাগানটা খুব সুন্দর। -সবুজ পরী বলে। কত ফুল ফুটে আছে। আমাদেরকে একটি করে ফুল দেবে? আমাদের সবার একটি করে ফুল দেবে কেমন? তুমি আমাদের বন্ধু হবে?
-ইশ শখ কত। এত শখ করে ফুল বাগান করেছি তোমাদের ফুল দেয়ার জন্য। যাও ভাগ এখান থেকে। এই ফুল কাউকে দেবো না। কাউকে না। বিন্দু রেগে যায়।
-দাও না বন্ধু একটি ফুল দাও। দাও না প্লিস।
-না, একটিও ফুল পাবে না। বিন্দুর চোখ ঝাড়া কথা। বেশি করলে তোমাদের সুন্দর ডানায় আগুন ধরিয়ে দেবো। ভালোয় ভালোয় কেটে পড় বাপু।
-মুহূর্তেই পরীদের সুন্দর মুখে কালো মেঘ জমে উঠল। মায়ের কষ্টে বলেই বসল, এই অভিশাপ দিচ্ছি তোমায়। তোমার ফুলবাগান জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাবে। বলতে বলতে বিন্দুর চোখের সামনে থেকে হাওয়া হয়ে গেল পরীর দল।

দুই চোখ কচলে নিয়ে বাগানের চারপাশ তাকিয়ে থাকে বিন্দু। কোথাও কিছু দেখতে পায় না। আচানক দমকা হাওয়ায় বাগানের সব আলো নিভে গেল। আকাশের চাঁদ নেই। জোছনা নেই। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক নেই। বাগানের ফুলগুলো হাওয়ার দাপটে দুলছে। ফুলের আগের সেই মিষ্টি সুবাস আর নেই। আচানক কেমন একটি ফ্যাকাসে রঙ ধারণ করতে শুরু করেছে বিন্দুর বাগানের ফুলগুলো। দম বন্ধ হয়ে আসে বিন্দুর। মুখে কোনো রা নেই। জবান বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে বিন্দুর। ভয়ে দুচোখ বন্ধ হয়ে আসে বিন্দুর। অনেকক্ষণ পর আস্তে আস্তে চোখ খোলে ও। দেখে ফুল বাগানের একটিও ফুল নেই ওর। ডালগুলো কেমন খালি গায়ে ঝুলে আছে যেন। সব পাতা ঝরে গেছে। দুচোখ ছাপিয়ে জল আসে বিন্দুর। কেঁদেই ফেলে ও। এত কষ্টের সাজানো গোছান ফুলবাগানে ফুল নেই। সৌরভ নেই। আকাশের নীলে দুই চোখ প্রসারিত করে বিন্দু। রূপালী চাঁদ বিন্দুকে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে শুরু করে। আকাশের মিটিমিটি তারাগুলো বিন্দুকে দেখে তিরস্কার করছে।
-ছিঃ ছিঃ বিন্দু। ছিঃ। তুমি এত খারাপ।
-আরে ধ্যাত। কি ভাবতে কি ভাবছি! দুচোখ মুছে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে বিন্দু। আমি আবার ফুলবাগানের জন্য কষ্ট করব। আবার নতুন করে গাছ লাগাব। ফুল ফোটাব। সারা বাগানজুড়ে ফুলের গন্ধে মউ মউ করবে। আমি আবার নতুন করে ফুল ফোটাব।
-কিন্তু কেমন করে?
চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই দেখে গাছের আড়ালে কে যেন চুপটি করে বসে আছে।
-কে? কে ওখানে?

-আমি। আমি লাল পরী।
-আমি সবুজ পরী।
-তোমরা কেন এসেছ আবার? বিন্দু জানতে চায়। আমাকে ছাই ভস্ম করে দেবে তাই না? করো। করো। যা ইচ্ছে তাই করো। রাত বেড়েই চলেছে। গভীর রাত। আমার বন্ধুরা সবাই স্মৃতিসৌধে ফুল নিয়ে যাবে। যেতে পারব না আমি। -বিন্দু বলে।
-কেন জানো ? না জানার ভান করে পরীগুলো। তোমরা পরীরা মানুষের ভালো চাও না? তুমিই বলো লাল পরী।
-আমার বাগানের একটিও ফুল নেই যে, বীর ভাষা শহীদদের স্মরণ করে ফুল দেই। অথচ স্মৃতি সৌধ সেদিন ফুলে ফুলে ছাওয়া থাকবে। শুধু ফুল আর ফুল। তাই তো মনের দুঃখে কাঁদছি।
তুমি জানো না বিন্দু, আমরা তোমার কতটুকু উপকার করেছি।

-মা-নে ? আকাশ থেকে পড়ল যেন বিন্দু। মানেটা কি? কমলা পরী বলতে শুরু করল। -তখন সন্ধ্যে বেলা। সূর্য ডুবতেই আমরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়েছি ফুলের সন্ধানে।
হঠাৎ এদিক দিয়ে আসতেই শুনি, পাড়ার দুষ্টু ছেলেদের ফন্দিফিকির। কতগুল দুষ্টু ছেলে ফন্দি আটছিল আজ রাতেই সব ফুল চুরি করে নিয়ে যাবে।
তাই তোমার বাগানের ফুলগুলো অদৃশ্য করে রেখেছি তাই। যদিও আমরা পরীরা জানি তুমি ফুল খুব ভালোবাসো। বাগান করা তোমার শখ। এটি খুব ভালো অভ্যাস। তোমার চোখে মুখে সাফল্যের যে আলো ঝলকানি দেয় তার প্রতিফলন ঘটুক এই কাজের মাঝেই।
-দুষ্টু ছেলেগুল এইমাত্র ফিরে গেছে খোলা মাঠ দেখে। -পরীর কথা শুনে বিন্দুর দুচোখ ছলছল করে ওঠে। আনন্দে। মহা আনন্দে।
চোখের সামনে ডালে ডালে বসন্তের নতুন পাতা গজায়। ফুল ফোটে। পলাশ, শিমুল, গোলাপ, জবা, রজনীগন্ধা, গাঁদা, সূর্যমুখী, আরো কত কি? থোকায় থোকায় ফুল বাগানটিকে অপরূপ লাগছে। চাঁদের রূপালী আলো ঠিকরে পড়ে বাগানজুড়ে।

বিন্দুর মুখে গোলগাল চাঁদের মতোই হাসি ফোটে। খুশিতে খলখল করে হেসে ওঠে।
পরীদের সাথে হাত ধরাধরি করে খেলায় মেতে ওঠে মুহূর্তেই। জোছনা রাতে ঝলমল চাঁদের আলো নেচে ওঠে, গেয়ে ওঠে ওরা। আনন্দের সীমা নেই। আচমকা মাথাটা ঝাঁকি খায় বিন্দুর। -আরে এখন তো খেলার সময় না। আব্বু আম্মু কি করছে এখন। জানতে পারলে আচ্ছা করে বকুনি দেবে মা। এত মজার খেলা ফেলে বাড়ি ফিরতেও মন চায় না বিন্দুর।
অমনি চোখ দুটোকে সামলে নিয়ে সাবধানে পা ফেলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় বিন্দু। পড়ে গিয়েই পা-টা মচকে গেল বুঝি!!
-বিকট চিৎকারে চেচাতে শুরু করল, মা, মা- গো, ও মা! বাঁচাও, পা-টা বুঝি ভেঙেই গেল আমার।
ঘুমের ঘরে আরো জোরে চেঁচাতে লাগল বিন্দু। বাঁচাও! বাঁচাও! মা মা গো!

-মা পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে বিন্দুর কাছে এসে হাত দিয়ে সজাগ করার চেষ্টা করল।
-বিন্দু। অ্যাই বিন্দু। তোর কি হয়েছে? পা ভাঙল কেমন করে? কি যাতা বলছিস মা?
বিন্দু ঘুমের ঘোরে বলতে লাগল, বাঁচাও, বাঁচাও, বাঁচাও, বাঁচাও, বাঁচাও...মা।
এক প্রকার জোর করেই ওর ঘুম ভাঙানো হলো। বিন্দু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মায়ের মুখের দিকে। অস্ফুট স্বরে জানতে চায়, মা কি হয়েছে?
-স্বপ্ন দেখছিলি বুঝি মা?
-হুম। বিন্দু জানায়। আব্বু কোথায়?
-সকালে চা বিস্কুট খেয়ে বাজারে গেছে। ফিরে এসে গা গোসল দিয়ে নাশতা করবে।
-ইশকুল থেকে ফিরে এসেই ড্রেস চেঞ্জ না করে ঘুম দিয়েছিস। এক্কেবারে সকালে উথলি। রাতে পেটে খাবার পড়েনি মা। মুখ ধুয়ে আয়। আমি নিজে হাতে খাইয়ে দেবো মা।
-মা, ফাল্গুন এলে পরীরা ফুল বাগানে নেমে আসে, তাই না, মা ? বিন্দু জানতে চায়। বিন্দুর চোখে মুখে খুশির ঝলক বইছে। কিন্তু এত খুশির কারণও জানে না?
বিন্দুর চোখে ভেসে উঠছে শুধু রাতের স্বপ্নের ফুলবাগান আর এক ঝাঁক পরীর মুখ।

 


আরো সংবাদ



premium cement