২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯ ফাল্গুন ১৪৩০, ২২ শাবান ১৪৪৬
`

ভাষার আগ্রাসন এবং নতুন বাংলাদেশ

ভাষার আগ্রাসন এবং নতুন বাংলাদেশ -

ভাষার আগ্রাসন কী? কিভাবে হয়? এই প্রশ্নই সব কিছুর আগে মনে এলো। কারণ শাদা চোখে দেখলে আমাদের আম-জনতার মনে তেমন কোনো কিছু ফোটে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো রাজনীতিক বা প্রজ্ঞাবান ভাষানীতিক চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দেন। আমরা দেখি বা শিখি তখনই, যখন আঙুলটি পড়ে গিয়ে আক্কেলের ওপর।
আমরা যখন বাংলা ভাষার ব্যাকরণ পড়ি তখন বুঝি যে আমাদের বাংলার ওপর যেন কিছু একটা চেপে বসে আছে। সেটি কী। সেটি যে সংস্কৃত ভাষা, তখন বুঝিনি এখন বুঝি। বাংলা ব্যাকরণ প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সংস্কৃত পণ্ডিতদের। তারা সংস্কৃতি পণ্ডিত হলেও বাংলা পড়া ছিল নিষিদ্ধ। কেউ যদি পড়েন, তাহলে তাকে রৌরব নরকে যেতে হবে। কিন্তু অন্য কোনো উপায় না থাকায় পণ্ডিত ঠাকুরদেরই শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। পণ্ডিতরা জাতীয় দায়িত্ব পেয়ে বাংলাভাষাকে শব্দের সাহায্যে জোড়াতালি দিয়ে সংস্কৃতদুহিতা হিসেবে ছেড়ে দিলেন। আর তারাই এ কথা রাষ্ট্র করে দিলেন যে, বাংলা হচ্ছে সংস্কৃতভাষার মাতৃভূমি। অর্থাৎ সংস্কৃতদুহিতা বলে বাংলার যাত্রা শুরু হলো। আমরা বহুকাল ধরে জেনে আসছি বাংলা হচ্ছে সংস্কৃতের দুহিতা বা কন্যা। এই কন্যা সাবালগ হয়ে গা ঝাড়া দিলে বাংলার যৌবন মুক্তবিহঙ্গের মতো উড়ে গেল সংস্কৃত ডাল থেকে প্রকৃতিতে। আসলে সংস্কৃত ভাষার সাথে বাংলা ভাষার নিকট-আত্মীয়তাও নেই। বাংলা ভাষার জন্মইতিহাস পড়ে আমরা জেনেছি প্রকৃত ইতিহাস। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংল ভাষার ইতিহাসের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে দেখা যায় নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার প্রাচ্য শাখা থেকে জন্ম হয়েছে ১. বিহারী (মৈথিলী, মগধী, ভোজপুরিয়া) ২.ওড্র-বঙ্গ-কামরূপী। এই ওড্র-বঙ্গ কামরূপী থেকে জন্ম হয়েছে উড়িয়া ও বঙ্গ-কামরূপী। এই বঙ্গ-কামরূপী থেকে জন্ম হয়েছে বাঙ্গালা ও আসামি ভাষার। এই বিচার-বিশ্লেষণই বলে দিয়েছে বাংলা কোনো মৃতভাষার দুহিতা নয়; বরং সংস্কৃত পণ্ডিতরা বাংলা ভাষার ওপর আগ্রাসন চালিয়েছেন। সেই আগ্রাসনের দৌলতে আমরা অনেকেই জানি যে বাংলার মাতৃভূমি হচ্ছে সংস্কৃত।
এই মিথ্যাকে শেকড়-বাকড়শুদ্ধ উৎখাত করে দেয়নি আমাদের নাগরিক প্রজ্ঞাবান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। অবশ্য দায়িত্ব মূলত সরকারের। সরকার নিজেদের ক্ষমতাকেন্দ্রিতায় এতটাই মগ্ন থাকেন যে, কীভাবে ভিনদেশী, ভিন্নভাষার শব্দ শব্দসম্ভার বাংলার পঙক্তিসরণিতে ঢুকে পড়ল, সেটি খেয়াল রাখেন না। ভিন্ন ভাষার আগ্রাসন মূলত ঘটে রাজদরবার থেকে। মুসলমান রাজত্বকালে এ দেশের বাংলায় আস্তে-ধীরে ঢুকে পড়ে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনেই পারসি বা ফারসি ভাষার অনেক শব্দ আমরা পেয়েছি। আইন-আদালতের অনেক শব্দই ফারসি কিন্তু জানি না। মনে করি ওগুলো বাংলা। বিচারক যে মঞ্চে বসে বিচার করেন, তার নাম এজলাস। পাইক-পেয়াদা, বরকন্দাজ, সমন জারি করা, আর্দালি, পেশকার ইত্যাদি শব্দ ফারসি ভাষাজাত। একটি নমুনা উদাহরণ দেয়া যাক বিদ্রোহী কবির কামাল পাশা কবিতা থেকে... খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া/বুজদিল ঐ দুশমন সব বিলকুল সাফ হো গিয়া/ খুব কিয়া ভাই খুব কিয়া।
দুশমন, বিলকুল, বুজদিল সাফ এই শব্দগুলো আজ বাংলায় গৃহীত হয়েছে যুগের পর যুগ ধরে ব্যবহারের ভেতর দিয়ে। কারা ব্যবহার করল? জনগণ? তারা এই শব্দগুলো কোথা থেকে পেল? শাসকগোষ্ঠীই তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। নজরুল যখন ওই কবিতা লেখেন তখন কিন্তু তিনি একবারও মনে করেননি যে ওই শব্দগুলো ভিন্ন ভাষার শব্দ। আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে, ওই ভাষার জন্ম বাংলা ভাষার আগে হয়ে থাকলে ও ওই ভাষা থেকেই কিঞ্চিৎ ভাষিক ঋণ নেয়াটা তো আদিকালও খারাপ বলে চিত্রিত হতো না; বরং সাদরে গৃহীত হতো। কারণ তাতে করে বাংলার শব্দ সম্ভার বেড়ে যাবে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আগে এদেশে বহু শাসকের অধীনে আমরা ছিলাম। ছোট ছোট রাজ্য ছিল তখন। তাম্রলিপ্ত, গৌড়, কঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ, হরিকেল, ইত্যাদি। তাদের নিজস্ব ভাষাও ছিল। কিন্তু ওই সব রাজ্য আজ আর নেই কিন্তু আছে ওই সব জাতিসত্তার ভাষার কিছু শব্দ, যা আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহারে লাগে। আবার ওই সব রাজ্যের প্রান্তদেশীয় মানুষরা ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ। তাদের একটির নাম মুণ্ডা। মুণ্ডাভাষার অনেক শব্দই বাংলায় আত্মীকৃত হয়েছে। দা, কুড়াল তার নমুনা শব্দ। আবার হিন্দির প্রভাবও আছে বা ছিল। কারণ হিন্দি ভাষা বাংলার আগে জেন্মেছে। গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলার তুলনা হয় না। বাংলা তার চারপাশের বিভিন্ন ভাষা থেকেই অকাতরে গ্রহণ করেছে। বার প্রয়োজনে গ্রহণ করেছে। যেমন ফারসি ভাষার প্রভাব প্রচণ্ড হওয়ার কারণ, ওই ভাষিক শাসকরা শত শত বছর ধরে এদেশের জনমনে নিজেদের ভাষা ও সাহিত্যের শাখা বিছিয়ে দিয়েছিল। বিশেষ করে মোগল সাম্রাজ্যের সাড়ে তিন শ’ বছরসহ মূলত ৭০০ বছরের মুসলিম শাসনের ফলে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ফারসি ও ফারসির উচ্চারণে আরবি শব্দের অধিকারী হই আমরা। আবার ইংরেজ আমলে আমাদের ওপর চেপে বসে ইংরেজি ও হিন্দুর বিভিন্ন চেহারা। আমাদের ভাষার ওপর ইংরেজি ও হিন্দির প্রভাব মূলত প্রকাশ শাসক ও অপ্রকাশ্য শাসকদের রাজনৈতিক চাপ। আজকে লক্ষ করলেই আমরা দেখব ও শুনব তরুণ ছেলেমেয়েরা বাংলিশে কথা বলছে। বাংলার সাথে ইংরেজির মিশ্রণে নির্মিত কথাকেই অনেকেই বাংলিশ বলছেন। উদাহরণ দেয়া যাক চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ব্যবহৃত স্লোগান থেকে। স্টেপ ডাউন হাসিনা। আমরা মহাজন একা নই, আমরা সহস্রজন। দেশটা কারো বাবার না। রাজাকার রাজাকার/কে বলেছে, কে বলেছে?/স্বৈরাচার স্বৈরাচার। নিঃশঙ্কচিত্তের এই স্লোগান আমাদের চিন্তার ভাষাকে যেমন উন্মুক্ত করেছে, তেমনি আমাদের সংস্কৃতিতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপাদান। বলা হয়েছে ওইগুলো আমাদের ট্রাডিশনের অংশ। ঐতিহ্য কী এবং কোনটি ঐতিহ্য নয়, সেটি বোঝার সময় ও চিন্তা নেই আমাদের সামাজিক মানুষের। ফলে দেশের সর্বত্রই এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। এই মহানগরের দোকানগুলোর নাম, রেস্তোরাঁর নাম বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নামের ওপর ইংরেজির কী দুর্দম প্রভাব।
বাংলার ওপর সংস্কৃতের প্রথম ও প্রধান আগ্রাসনে হয়েছে প্রতিবেশী ভাষার অধিকারীদের হাতে। এটিই সব দেশেই, যারা নিজেদের মাতৃভাষা আগ্রাসনের শিকার হয়ে লুপ্ত হয়েছে, তাদের কেউ কেউ জানে, অধিকাংশই জানে না। দক্ষিণ আমেরিকার, যাকে আমরা ল্যাটিন আমেরিকা নামে জানি/ চিনি, তারা কিন্তু জানেই না যে আদিতে তাদের জাতিগত মাতৃভাষা কি ছিল। আজকে অনেক গবেষক খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। স্প্যানিশ, ডাচ, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজ বা ইংলিশ ঔপনিবেশিক সরকার বা শক্তি গোটা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আদিভাষী আদিবাসীদের হত্যা করে কেবল দেশটিই দখল করেনি, জীবিতদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে ভাষিক আধিপত্য ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। সে সব দেশের আদিবাসীরা দখলদার ইউরোপিয়ানদের হিংস্র ও নির্মম আগ্রাসন ঠেকাতে পারেনি; বরং বেঁচে থাকার জন্য তাদের কথা মেনে নিয়ে তাদের ভাষা ও ধর্ম গ্রহণ করেছে। এই একই কাজ শুরু হয়েছিল এই বাংলাদেশেও। আজ যেসব বাংলাদেশী খ্রিষ্টান আছেন, তারা সেই ধর্মান্তরিত মানুষ, যাদেরকে জোর করে, অর্থের বিনিময়ে, খাদ্যশস্য সাহায্য দিয়ে , পড়াশোনোর সুযোগ করে দিয়ে খ্রিষ্টান করা হয়েছিল।
দায় কি আমি এড়াতে পারি? দায় কি দেশের প্রজ্ঞাবান সংস্কৃতিবান সব স্তরের শিক্ষক, সমাজনেতা, রাজনৈতিক নেতা দায় এড়াতে পারেন? যারা ব্যবসায়-বাণিজ্য করেন তাদের কি কোনো দায় নেই? যারা নুন, চিনি, হলুদ মরিচের ব্যবসায় করেন, তাদের দায় আমরা কেমন চোখে দেখব? যারা আমদানি-রফতানি বাণিজ্য করে তারা কি এড়াতে পারেন? একটি কোম্পানির নাম যদি হয় ফ্যাসন অ্যাপারেল বা এমজিআই গ্রুপ, মুরগির খাদ্যের জোগানদানের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নাম যদি হয় কাজী ফার্ম, সয়াবিন তেলের আমদানিকারকের নাম রূপচাঁদা বা তীর হওয়াটা অন্যায় নয়, বসুন্ধরা গ্রুপের আসল ব্যবসায় যাই হোক না কেন, পুঁজির ধর্ম অনুযায়ী তারা ইউরোপীয় বা আমেরিকান সংস্কৃতির প্রভাবে পোক্ত।
এদের বাইরে, যারা ছোট দোকানদার বা আগোরা, ডেইল শপিং, রেস্তারাঁর নাম রাখছে ইংরেজিতে। লেঠারিং হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে রোমান হরফ, (যাকে আমরা জানি ইংরেজি হরফ হিসেবে। পিজ্জা হাট, ও হান্ডি, সান্দ্রা, গ্লোরিয়া জিন্স, বিল্ডিংয়ের নাম টুইন টাওয়ার, সেন্টার পয়েন্ট, আর্টিসান, সিটি সেন্টার, পিংক সিটি, পুলিশ প্লাজা, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, যমুনা ফিউচার পার্ক, পেট শপ, ফার্মফ্রেশ, মিল্ক ভিটা, আড়ং, এসিআই, ভূতের বাড়ি, পার্লার, পেস্তা শপ, নাপিতের দোকানের নামও ভিনদেশী। এরকম অগণন নাম এই ঢাকা শহরের বিচিত্র ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের, যা আমাদের এটিই বলছে যে, আমরা কি বাংলা ভাষার জন্য জীবন দান করেছিলাম? এই নামের মহিমা ছড়ানোর জন্যই কি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ হানাদারমুক্ত করেছিলাম? মহান একুশ কি তার গৌরব আর গাথা নিয়ে আমাদের শিশু-কিশোরদের জীবনচেতনায় জেগে আছে। নাকি তাদের নামের বহুভাষিক প্রভাব নিয়েই হয়ে উঠছে এক একজন আন্তর্জাতিক শিশু-কিশোর-যুবক। তাদের পিতা-মাতাদের মতোই শেকড়-বাকড়হীন হয়ে গড়ে উঠছে বামনগাছ হয়ে আপনারা নিশ্চয় বামনগাছ বা বনসাই বৃক্ষ দেখেছেন। আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠছে ওই বনসাই বৃক্ষ হয়ে। শেকড়-বাকড়হীন মানে, আত্মপরিচয় ছাড়াই। কারণ তাদের নামের সাথে ও তাদের সাংস্কৃতিক চিন্তাধারার সাথে জীবন যাপনের মিল-মহব্বত নেই। তারা বাংলাদেশের সোসিও-কালচারাল এনভারমেন্টে বেড়ে উঠছে, কিন্তু তার চিন্তাভাবনার আবহটি বিদেশী বা ভিনদেশী। সংস্কৃতিগতভাবে তারা নো-ম্যান্সল্যান্ডের মানুষ। আমি নিজেও কিন্তু লিখিনি যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠছে। লিখেছি ইংরেজির বাংলা উচ্চারণে। কারণ আমার সত্তার নিয়ন্তক হচ্ছে পশ্চিমা সভ্যতার প্রাগ্রসরতা, এটাই আমরা ভাবি এবং মেনে নিয়েছি। ব্রিটিশদের কালচারাল হেজেমনির কী প্রভাব ঢাকার দোকানি সংস্কৃতি পর্যন্ত গ্রাস করেছে।
এই আগ্রাসন থেকে কি আমরা মুক্ত হতে পারব? নতুন বাংলাদেশের নির্মাতাদেরও দশা তো কালচারাল হেজেমনির অন্তর্গত। তারা নাকি আন্তর্জাতিক চেতনার ধারক। সে আমরা বুঝলাম। দানবী হাসিনা উৎখাতে তারা বিজয়ী হয়েছে, কিন্তু ভাষিক আগ্রাসন থেকে দেশ ও দেশের ভাষা তারা কি রক্ষা করতে পারবেন?


আরো সংবাদ



premium cement