রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যেভাবে মাতৃভাষার মলাটে বিম্বিত
- হুসাইন আলমগীর
- ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০৭
আমাদের এ বৃত্তাকার পৃথিবীতে গড়পড়তা তিন হাজারের মতো ভাষা রয়েছে। এসব ভাষার প্রত্যেকটিই কারো না কারো মাতৃভাষা যে ভাষায় কোনো না কোনো জাতি বা গোষ্ঠী তাদের মনের আকুতি প্রকাশ করে থাকে। যেমন বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষাতেই আমরা আমাদের দৈনন্দিন ভাবের আদান-প্রদান করে থাকি। বৈশ্বিক নানান বিবর্তনের ফলে বহু ভাষা ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। যেসব ভাষা এখনো টিকে আছে এসবের মধ্যে হাতেগোনা কিছু ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। সাম্প্রতিক পৃথিবীতে ২৬ কোটিরও বেশি মানুষ বাংলায় কথা বলে। এর মধ্যে প্রায় ২০ কোটি মানুষই বাংলাদেশের নাগরিক। ব্যবহারকারী বিবেচনায় বাংলা পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম ভাষা। বাংলা ভাষার ইতিহাস প্রাচীন। হাজার বছরের প্রাচীন এই ভাষার জন্ম, বিবর্তন ও বিকাশের ইতিহাস আজকে আলোচ্য নয়। হালে বাংলা ভাষার ঘরসংসার এবং এর জীবনযাপনের চালচিত্র নিয়ে কথা বলাই আমার লক্ষ্য।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে বাংলাভাষী অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ, বর্তমান বাংলাদেশ পাকিস্তানের অধীনে চলে আসে এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারতের কর্তৃত্বে থেকে যায়। ৫৬-তে পূর্ববঙ্গের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানে বহু ভাষা-উপভাষা থাকলেও উর্দু ছিল প্রধান। সাতচল্লিশে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তান উর্দুকে রষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি বাংলাভাষী মানুষের ইচ্ছা আকাক্সক্ষাকে অগ্রাহ্য করা হয়। বলে রাখা ভালো, ব্রিটিশ কলোনিয়াল শাসনামলে কলকাতা বাংলা ভাষার প্রধান কেন্দ্র হলেও ১৯২৬/২৭ সালের প্রথমার্ধে বাংলাভাষা ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ঢাকা হয়ে ওঠে বাংলা ভাষার রাজধানী।
আমরা এখন যে বাংলায় কথা বলি, যে বাংলায় সাহিত্য রচনা করি তার বেড়ে ওঠা এখানে, কলকাতায় নয়। যদিও হালে কলকাতায় হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার ব্যবহার শনৈ শনৈ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বাংলা তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থান ভিন্ন। শত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে ঢাকা বাংলাভাষাকে সুদৃঢ় ভিতের ওপর অটল রাখার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাভাষা রাষ্ট্রীয় দমনের মুখে পড়েছে। সেন আমলে হিন্দু রাজারা বাংলা ভাষার গলাটিপে ধরেছিলেন। এমন এক ফতোয়া জারি করেছিলেন, রামায়ণ বা মহাভারত বাংলায় পাঠ করলে পাঠক জাহান্নামে যাবে। ১২০০ সালের শুরুতে ভারত বর্ষে মুসলিম সুলতানদের শাসন শুরু হলে ১২৩০-এর দিকে সেন রাজাদের পতন ঘটে এবং সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা আবারো মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদদৌলার পরাজয়ের পর ভারত শাসনের ভার ইংরেজদের হাতে চলে যায়। শিক্ষিত উচ্চবর্গের হিন্দু সমাজ ইংরেজদের নৈকট্য লাভ করে এবং কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপনের মাধ্যমে মুসলিম সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা বাংলা ভাষার সর্বজন নন্দিত যে রূপ পরিগ্রহ করেছিল সংস্কৃত অনুপ্রবেশের মাধ্যমে তা বিনষ্ট করা হয়। বাংলার ওপর সংস্কৃত ভাষার আগ্রাসন ঊনিশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত ভীষণভাবে লক্ষ্যণীয়। যদিও বাংলার ঘাড় থেকে সংস্কৃতের ভূত এখনো নামেনি।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এই সিদ্ধান্ত বাংলার মানুষ মেনে নিতে পারেনি। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসে। তাদের দাবি ছিল, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। তাদের স্লেøাগান ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। এই আন্দোলনে মুসলিম তরুণ সমাজই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ অনেকেই শাহাদাতবরণ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে কিছু শর্তে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়া হয়। বাংলাভাষার উন্নয়নে ‘বাংলা ভাষার উন্নয়ন বোর্ড’ গঠন করা হয়েছিল। ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বরে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষার উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল তা ছিল বায়ান্নর আন্দোলনের সুফল। যদিও বাংলাভাষা কার্যত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার সুযোগ পায়নি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়ে সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। পাকিস্তান সরকার যেভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেই দায় সেরেছে একই কায়দায় এ দেশের সরকার বাংলাকে সংবিধানে আবদ্ধ করেই কৃতিত্ব নিয়েছে। কাজীর গরু কিতাবেই রয়ে গেল, গোয়াল পেল না।
স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাভাষা উন্নয়নে সমগ্র দেশে ভাষাশহীদ স্মরণে শহীদ মিনার তৈরি করা হয় এবং প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুষ্পমাল্য দিয়ে শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। প্রভাত ফেরিতে মায়ের ভাষার জন্য গান করা হয়। কিন্তু ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এ স্লোগান আর ওঠে না। এভাবে বছরের পর বছর মাতৃভাষার গান শুনিয়ে জাতিকে রাষ্ট্রভাষার দাবি থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। এ দেশের সরকার ভাষাশহীদদের নামে ভাস্কর্য তৈরি করলেও তাদের দাবির প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
রাষ্ট্রভাষার দাবির বিপরীতে মাতৃভাষার আবেগকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনকে মাতৃভাষার মোড়কে উপস্থাপন করা হয়েছে। নতুন প্রজন্মের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। রাষ্ট্রভাষা বাস্তবায়ন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা না করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ১৯৫২ সালে ছাত্র-জনতার দাবির মুখে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়ে সংবিধানে যুক্তও করেছিল, কার্যকর করেনি। আমরাও তাই করেছি। সংবিধানে যুক্ত করেছি, কার্যকর করিনি বা করা হয়নি।
১৯৮৭ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭’ জারি করে। এটি একপৃষ্ঠার একটি আইন। এতে মাত্র চারটি ধারা রয়েছে। এতে বলা হয়-‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস আদালত আধা সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের ব্যতীত অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র আইন আদালতের সাওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনের কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিত হইবে।’ ভাষার প্রশ্নে সরকারি আর বেসরকারি আলাদা করার সুযোগ না থাকলেও এ আইনে বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে বাংলা ব্যবহারে জবাবদিহিতার বাইরে রাখা হয়েছে। আদালতের সাওয়াল-জবাব বাংলায় হবে, বলা হলেও রায় বাংলায় হবে কি-না তা এই আইনে বলা হয়নি। বেসরকারি ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। অথচ বেসরকারি ক্ষেত্রের পরিধি সরকারি ক্ষেত্রের কয়েক হাজার গুণ বিস্তৃত। কষ্টের বিষয় হলো- এই প্রচেষ্টাও বেশিদূর এগোয়নি। এখনো সরকারি দফতরে অনেক কার্যক্রম ইংরেজিতে চলে। বিশেষ করে, উচ্চ আদালতে রায় প্রদানসহ অধিকাংশ কার্যক্রম ইংরেজিতে নির্বাহ করা হয়। ক্যান্টনমেন্ট কার্যালয়গুলোতে বাংলা প্রচলনের ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি, পড়ে না। ১৯৮৭ এর পরে সর্বত্র বাংলা প্রচলনের বিষয়ে বিশেষ কোনো উদ্যোগ গৃহীত হওয়ার বিষয় নজরে আসেনি। তবে, ১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখকে জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়। এই স্বীকৃতি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কার্যকর করার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখেনি; বরং একুশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চেতনাকে মাতৃভাষা রক্ষার সংগ্রামের মোড়কে স্থায়ী রূপ দিতে সহযোগিতা করেছে। একুশের চেতনা হিসেবে মাতৃভাষার প্রতি এ দেশের মানুষের ভালোবাসাকে বাজারজাত করা হয়েছে। জাতীয় শহীদ দিবসের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস চালু করে মূলত একুশের চেতনাকে নতুন প্রজন্মের কাছে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রকারান্তরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি যে আন্দোলন হয়েছিল জাতিকে তা ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা ভুলতে পারিনি। ভুলতে পারিনি বলেই বারবার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সর্বক্ষেত্রে কার্যকর করার দাবি তুলে আসছি। বাংলা ভাষাকে কার্যকর রাষ্ট্রভাষায় রূপ দিতে হলে নতুন প্রজন্মকে একুশের প্রকৃত চেতনা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। বাংলা ভাষাকে তাদের চোখে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে হবে।
নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষাকে পরিচিত করে তোলার প্রধান মাধ্যম পরিবার। দ্বিতীয়ত শিক্ষাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে বিত্তশালী পরিবারগুলোতে বাংলার ব্যবহার দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ফলে, আমাদের শিশুরা মাকে মম, বাবাকে ড্যাড, চাচাকে আঙ্কেল, শিক্ষককে টিচার বলে সম্বোধন করছে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা ভয়াবহ। এখানে সরকার নিয়ন্ত্রিত বিদ্যালয় অপেক্ষা ব্যক্তি বা বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষালয়ের সংখ্যা অধিক। বেসরকারি এসব প্রাথমিক শিক্ষাদানকেন্দ্রে শিশু শ্রেণী থেকে শিশুদের ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান করা হচ্ছে। ইংরেজি বর্ণমালার সঠিক উচ্চারণ শেখানো হচ্ছে। মাদরাসা মক্তবে আরবি বর্ণমালা সঠিক উচ্চারণসহ পড়ানো হচ্ছে। অবাক করা বিষয় হলো- সেভাবে কোথাও বাংলা বর্ণমালা সঠিক উচ্চারণে পড়ানো হচ্ছে না। এমনকি, প্রাথমিক পর্যায়ের অধিকাংশ পাঠদানকারী বাংলা বর্ণের সঠিক উচ্চারণই জানেন না। এ দায় কার! নিশ্চয়ই কোনো ব্যক্তির নয়।
আমি বাংলা ভাষার ব্যুতপত্তি, উৎপত্তি, বিকাশ কিংবা লিখনরীতি ইত্যাদি নিয়ে কথা বলছি না। আমার শিশুকে জন্মের পর প্রথমে মা বলতে দিতে হবে। তারপর মম বলাতে আপত্তির কিছু নেই। আমি বলতে চাচ্ছি, আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মহাবিদ্যালয়, সরকারি থেকে বেসরকারি সর্বত্র বাংলা ব্যবহার করতে হবে। আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্র, আইন শাস্ত্র, প্রকৌশল বিভাগসহ অগুণতি ক্ষেত্রে এখনো বাংলা চালু করা যায়নি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যেসব গবেষণা হচ্ছে তার ৯৫ শতাংশই ইংরেজিতে হচ্ছে। রেফারেন্স বইগুলো বাংলায় রূপান্তর করা না গেলে গবেষকদের বাংলায় ফেরানো সহজ হবে না। একই সাথে বাংলাকে নতুন প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হলে বাংলা ভাষাকে ন্যূনতম আর্থিক উপযোগসম্পন্ন করে তোলার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।
ইংরেজি এখন শুধু ভাষা নয়, মূল্যবান সামগ্রীও বটে। ইংরেজি এখন অর্থ উপার্জনেরও মাধ্যম। বস্তুবাদি অনেকেরই ধারণা, বাংলার ভবিষ্যৎ নেই। মানে বাংলা টাকা উপার্জনের সহায়ক মাধ্যম নয়। বর্তমান বিত্তশালী সমাজে এ ধারণা প্রকট। এ ধারণা থেকে জাতিকে মুক্ত রাখার বিহিত সরকারকেই করতে হবে। এ ধারণা দূর করবার বিশেষ কোনো মন্ত্র নেই। বর্তমান বাংলাদেশে শিল্পের প্রসার ঘটেছে। সাথে সাথে বিদেশীদের আগমন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে তারা কাজ করছে। তাদের অধিকাংশ ব্যবহারিক বাংলা জানেন না। অথচ, আমরা বিদেশে কাজের জন্য ইংরেজি, আরবি, চায়না, কোরিয়ান ইত্যাদি ভাষা রপ্ত করার জন্য ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছি। বিদেশীরা এখানে উচ্চ বেতনে চাকরি করলেও তাদের বাংলা শিখতে হচ্ছে না। এ ছাড়া, অসংখ্য বিদেশী শিক্ষার্থী এ দেশে পড়াশোনা করছে। তাদেরও ব্যবহারিক বাংলা জানার বাধ্যবাধকতা নেই। অথচ, আমাদের ছেলেমেয়েদের দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে হলে বিদেশী ভাষা জানতে হয়।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাভাষাীক আন্তর্জাতিকতা প্রদান এবং আর্থিক উপযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে আমরা বিদেশী চাকুরেদের ব্যবহারিক বাংলায় দক্ষতার শর্তারোপ করতে পারি। যেসব বিদেশী চাকুরে ব্যবহারিক বাংলায় যত দক্ষ হবেন তার বেতন ভাতাদি অন্যদের চেয়ে অধিক হবে। ILTs-এর মতো ব্যবহারিক বাংলা দক্ষতা যাচাই কর্তৃপক্ষ করা যেতে পারে, যারা ব্যবহারিক বাংলায় দক্ষতার সনদ প্রদান করবেন। একইভাবে, বিদেশী শিক্ষার্থী যারা এ দেশে পড়তে আসে তাদের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক বাংলা বাধ্যতামূলক করতে পারি। যে সব শিক্ষার্থীর ব্যবহারিক বাংলায় দক্ষতা সনদ থাকতে তাদের বৃত্তি প্রদান বা শিক্ষা ব্যয় হ্রাসের নীতি গ্রহণ করা হলে বাংলা ভাষা আর্থিক উপযোগিতা পেতে শুরু করবে। বিদেশীরাও তখন ব্যবহারিক বাংলা শিখবে, এটি আমার বিশ্বাস। এর ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিকভাবেও গুরুত্ব পাবে। কেবল আইন করে আর উপদেশ দিয়ে বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে বাংলা ভাষা কখনোই আর্থিক উপযোগিতা ও আন্তর্জাতিকতা অর্জন করবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন। এ বিষয়ে গবেষণা করা হলে আরো নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হতে পারে যেখানে বাংলা ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করে এর আর্থিক উপযোগিতা তৈরি করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমিকে সামনে আনা যায়। অবশ্য, বাংলা ভাষার রক্ষণ, উন্নয়ন, প্রচার প্রসারে বাংলা একাডেমির যে ভূমিকা রেখেছে এবং রেখে চলেছে তা উল্লেখ করার মতো নয়। সরকারে উচিত হবে বাংলা একাডেমিকে শক্তিশালী ও কার্যকরী করা এবং বাংলা ভাষাকে তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবার উপযোগী করে নির্মাণের কার্যক্রম হাতে নেয়া।
বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক ময়দানে বাংলা ভাষার ব্যবহারকে নতুন প্রজন্মের কাছে প্রিয় করে তোলার কর্ম-কৌশল তৈরি করতে হবে। চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। চাপিয়ে দিলে কোনো কিছুই স্থায়ী হয় না, হবেও না। বাংলা যে, তার আত্মপরিচয়, এটি যে তার শেকড়-এ অনুভূতি জাগ্রত করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলা ভাষা শিক্ষার আঁতুড়ঘর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান বন্ধ করতে হবে। বাংলা বর্ণমালা সঠিক উচ্চারণে পাঠ দানের কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাকে প্রিয় করে তোলার পদক্ষেপ নিতে হবে। ভাষা সংস্কৃতিরই একটি উপাদান। এটি আপনাতেই মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেবে। এমন সব ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে যেখানে বাংলা ভাষার একটি আর্থিক উপযোগ থাকবে। নতুবা, তথ্যপ্রযুক্তির এ সময়ে অন্যান্য বিদেশী ভাষার সাথে প্রতিযোগিতায় বাংলা ভাষা টিকতে পারবে না। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে শহীদ মিনারে ফুল দেয়া। মাতৃভাষার গান বাজানো। একুশের কবিতা পাঠ। টেলিভিশনে টকশো। সারা দেশে প্রভাতফেরি, সভা-সমাবেশ। এসব কার্যাবলি বাংলা ভাষাকে সাধারণের দৃষ্টিতে সম্মানিত করলেও বৈশ্বিক স্রোতের বিপরীতে টিকিয়ে রাখতে পারবে না। অসুস্থ মায়ের শিয়রে বসে কান্না করলে মা সুস্থ হয়ে উঠেন না। জুতসই ওষুধ ও যতেœর প্রয়োজন হয়। ‘আ মরি বাংলা ভাষা’, ‘আমার প্রাণের বাংলা ভাষা’ বলে কান্নাকাটি করলেই বাংলা বেঁচে যাবে না। বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রভাত ফেরিতে আবার স্লোগান তুলতে হবে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার আবশ্যিক করতে হবে। তবেই কেবল অনাগত দিনের শিশুর কণ্ঠে ধ্বনিত হবে-
‘অ আ ক নিছক বর্ণ নয়
সোনার মোহর-জান্নাতি নূর- এ আমার পরিচয়।
বাংলায় আমি প্রথম কেঁদেছি
পৃথিবীতে রেখে পা
যে দিন যাব সে দিনও যেনো বাংলায় কাঁদি, মা।’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা