২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮ ফাল্গুন ১৪৩১, ২১ শাবান ১৪৪৬
`

একুশ আমাদের ভাষার অনুপ্রেরণার উৎস

-

একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এর সাথে এ জাতির গৌরব ও আনন্দ-বেদনার ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। মাতৃভাষার যথার্থ মর্যাদা রক্ষার্থে কয়েকজন তরুণের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল বলে এ দিনটি জাতির কাছে বেদনার রক্তে সিক্ত। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বাংলাদেশের মানুষ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে। ’৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়ে ছিনিয়ে এনেছিল ভাষার মর্যাদা। অনুরূপভাবে ২৪-এর ‘জুলাই ৩৬’-এ এসে জানবাজ তরুণরাই রচনা করেছে নতুন ইতিহাস। নতুন বাংলাদেশ। একুশ মোটাদাগে যুগে যুগে এ জাতিকে প্রতিটি সংগ্রামে অসীম সাহসের অনুপ্রেরণা দিয়ে যায় বারবার।
মানুষের জীবনে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিমেয়। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়ের সেরা কষ্টিপাথর মাতৃভাষা। মাতৃভাষা অবলম্বন করেই গড়ে উঠেছে বিশে^র প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। মাতৃভাষা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিশে^র সব মানুষের এক মৌলিক সম্পদ। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও তাই।
পৃথিবীর কোনো বড় ঘটনাই হঠাৎ করে ঘটে না। ভাষা আন্দোলনও নয়। ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা সাধারণত বায়ান্নর আন্দোলনের কথা স্মরণ করতে অভ্যস্ত। কিন্তু বায়ান্নর আন্দোলনও হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়নি। বায়ান্নর পেছনে ছিল আটচল্লিশের অবদান। আর আটচল্লিশের পেছনে ছিল সাতচল্লিশের বিভাগ-পরবর্তী আন্দোলন। অবশ্য প্রকৃত প্রস্তাবে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে বিভাগ-পূর্ব যুগেই। আর এর সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল পাকিস্তান আন্দোলন।
পাকিস্তান আন্দোলনের মূলভিত্তি ছিল লাহোর প্রস্তাব। বাংলার জননন্দিত নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত এই লাহোর প্রস্তাবে ছিল উপমহাদেশে মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে দু’টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা। ঘটনার স্রোতে প্রতিকূলতার কারণে সাতচল্লিশে দু’টির স্থলে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র হলে পূর্বাঞ্চলের রাষ্ট্রটির রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে- এ তো ছিল অবধারিত ব্যাপার। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব অনুসারে না হয়ে সাতচল্লিশে উভয় অঞ্চল মিলে একটি পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর দেখা গেল পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই বাংলা ভাষাভাষী। সুতরাং ভারত বিভাগ হলে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি হয়ে পড়েছিল অতি স্বাভাবিক ও অনিবার্য ব্যাপার।
বিভাগ-পূর্ব আমলে কলকাতাকেন্দ্রিক পাকিস্তানপন্থী বাঙালি লেখকদের প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটিতে বহুবারই পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন গুরুত্বসহকারে আলোচিত হয়। এ ব্যাপারে সবাই একমত হন যে, পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে অবশ্যই বিশেষ মর্যাদা দিতে হবে।
পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির সদস্যদের মধ্যে মুজিবুর রহমান খাঁ, ফররুখ আহমদ, তালেবুর রহমান প্রমুখ এ ব্যাপারে বেশ কতকগুলো নিবন্ধ রচনা করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় মুসলিম বিশ^বিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমদ স্বাধীন ভারতে হিন্দির মোকাবেলায় পাকিস্তানে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে সঙ্গে সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের খ্যাতনামা মনীষী ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার প্রতিবাদ করেন। এর পূর্বে হায়দরাবাদে ১৬ মে ইত্তেহাদুল মুসলেমিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে তাও বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভ সৃষ্টি করে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর নবজাত রাষ্ট্রের সিভিল সার্ভিসে উর্দু ভাষাভাষীদের ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। স্বাভাবিকভাবে বাংলাভাষীদের মনে নানা আশঙ্কা সৃষ্টি হতে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতেই পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ভাষার প্রশ্নে মারাত্মক সংশয় ও সমস্যা দেখা দেয়।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তাভাবনার পাশাপাশি সুপরিকল্পিত সাংগঠনিক প্রক্রিয়াও শুরু হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির ২-৩ সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকায় ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংস্থা গঠিত হয়। ইসলামী সাংস্কৃতিক লাইনের কর্মকাণ্ড ছাড়াও সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলা ভাষার দাবি তুলে ধরা ছিল এই মজলিসের কর্মসূচির প্রধান দিক। এই সংস্থার পক্ষ থেকে ১৯৪৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ এই নামে একখানি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এই পুস্তিকার লেখক ছিলেন তিনজন : ১. তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা- সম্পাদক ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার অধ্যাপক আবুল কাসেম, ২. তমিজউদ্দীন খান ও ৩. খ্যাতনামা সাহিত্যিক- কলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ।
জনাব আবুল কাসেমের নিবন্ধে আন্দোলনের মূল দাবি সন্নিবেশিত হয়। এতে বলা হয় :
ক. বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের অফিস-আদালতের ভাষা।
খ. বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন।
গ. পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দু’টি- বাংলা ও উর্দু।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বেনিয়ার হাত থেকে স্বাধীনতা লাভে পূর্ব থেকে নতুন দেশ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সমাজে প্রচুর আলোচনা হতে থাকে। পূর্ব বাংলার জনসম্পদের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের লোক সংখ্যা ছিল কম। তবুও শাসক গোষ্ঠীর মনোভাব উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা শুরু হয়। রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক সওগাত পত্রিকায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অভিমত রাখেন :
‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে যথেষ্ট বাদানুবাদ চলছে। আর সবচাইতে আশার কথা এই যে, আলোচনা হয়েছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, জনগণ ও ছাত্রসমাজ অকুণ্ঠভাবে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং এটা দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে, পাকিস্তানের জনগণের বৃহৎ অংশের মতানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত হবে।
যদি তাই হয়, তা হলে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।
পাকিস্তানের, অন্তত পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে এ কথা সর্বসম্মত হলেও আমাদের এই পূর্ব পাকিস্তানেই কয়েকজন তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি বাংলা ভাষার বিপক্ষে এমন অর্বাচীন মত প্রকাশ করেছেন যা নিতান্তই লজ্জাজনক। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় রূপান্তরিত করলে ইসলামী ঐতিহ্যের সর্বনাশ হবে এই তাদের অভিমত।
কী কুৎসিত পরাজয়ী মনোবৃত্তি এর পেছনে কাজ করছে এ কথা ভেবে আমি বিস্মিত হয়েছি। যে মনোবৃত্তির ফলে প্রায় ২০০ বছর বাংলাভাষায় ইলামের প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ ছিল, সেই অন্ধ মনোবৃত্তি নিয়েই আবার আমরা ইসলামকে গলাটিপে মারার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছি। [সওগাত, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৪৭]
সম্ভাব্য স্বাধীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, মূলত ১৯৪৫ সাল থেকেই সে ব্যাপারে কথা উঠেছিল। তখন তথাকথিত কিছু সুবিধাভোগী বাঙালি অভিজাত শ্রেণীর উর্দুর পক্ষে রায় দেয়। কারণ প্রশসানের বাঙালি আমলা, অভিজাত শ্রেণীর রাজনীতিক ও নবাব পরিবারের অনেকের ঘরে ছিল উর্দুভাষী বউ, ব্যবসা বাণিজ্য ছিল উর্দুভাষীদের সাথে, তারা দৈন্দিন কথাবার্তা বলতেন উর্দুতে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছ থেকে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্যও এই গুটিকয়েক সুবিধাবাদী লোক উর্দুর পক্ষে গিয়েছিল। স্বাধীনচেতা ফররুখ তখনই মাসিক মোহাম্মদীতে ‘উর্দু বনাম বাংলা’ শীর্ষক এক কবিতায় সেই অভিজাত শ্রেণীর প্রতি আঘাত হানেন:
দুই শো পঁচিশ মুদ্রা যে অবধি হয়েছে বেতন,
বাংলাকে তালাক দিয়ে উর্দুকে করিয়াছি নিকা,
বাপান্ত শ্রমের ফলে উড়েছে আশার চামচিকা।
১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এটিই সর্বপ্রথম সংগ্রাম পরিষদ। পরিষদের আহ্বায়ক নিযুক্ত হন অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়া। তিনি তমদ্দুন মজলিসের একজন দায়িত্বশীল সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
সংসদীয় পর্যায়েও বাংলাভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উঠানো হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলাকে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি গণপরিষদে বাংলায় বক্তব্য প্রদানের অধিকার দাবি করেন। কিন্তু তা প্রতাখ্যাত হয়।
উর্দু বনাম বাংলার এই বাদানুবাদ রক্তঝরা ইতিহাসে পরিণত হয়। পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী আমাদের মায়ের ভাষা বাংলাকে বুলেটের আঘাতে স্তব্ধ করে দিতে চায়। কিন্তু বাংলার সচেতন নাগরিক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক তথা গোটা জাতি এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে রাজপথে মাতৃভাষার জন্য মিছিলসহ নেমে পড়ে। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি হায়েনার মারণাস্ত্র কেড়ে নেয় বাংলা মায়ের দুলাল- বরকত, সালাম, জব্বার, রফিক, শফিক, আব্দুল আউয়াল ও অহিউল্লাহর অমূল্য জীবন। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ।
১৯৫২ সালে বুকের রক্ত দিয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা বিশ^-ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাদের পবিত্র রক্তের বিনিময়ে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। এই রক্তের স্বীকৃতি ও পূর্ণ সুফল আমরা পেয়েছি বিগত বিংশ শতাব্দীতে।
একুশের জমিনে প্রোথিত হয় আমাদের মহান স্বাধীনতার বীজ। লাখো প্রাণের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে আমরা স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছি। আমরা পেয়েছি লাল সবুজের স্বাধীন পতাকা। বিশে^র মানচিত্রে এক নতুন দেশ ‘বাংলাদেশ’। এ আমাদের গর্বের ধন। আমাদের সুন্দর করে বেঁচে থাকার স্বাধীন মাতৃভূমি।
বিশ^ আজ এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমাদের মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদার স্বীকৃতি এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩১তম সম্মেলনে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের স্বীকৃতি পায়। যে দিবসটি কেবল ‘ভাষা শহীদ দিবস’ হিসেবে পালিত হতো আজ তা ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।
২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, শুধু বাংলাদেশেই বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। বলা হচ্ছে, এখন জনসংখ্যা ১৮ কোটি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, আন্দামান-নিকোবর, ধানবাদ, মানভূম, সাঁওতাল পরগনা প্রভৃতি এলাকায়ও বাংলা ভাষার প্রচলন রয়েছে। এর বাইরে নেপাল, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ইতালি ইত্যাদি দেশে বিপুল পরিমাণ বাংলাভাষী অভিবাসী ও প্রবাসী রয়েছেন।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষের মাধ্যমে বাংলা পাচ্ছে বৈশ্বিক ব্যাপ্তি। বাংলাভাষী মানুষ ছড়িয়ে আছেন নানান দেশে। তাদের মধ্যে কায়িক শ্রমের মাধ্যমে বিদেশী শ্রমবাজার এবং দেশী অর্থনীতির হাল ধরা মানুষ যেমন আছেন, তেমনি ব্যবসায়িক প্রয়োজনে, উচ্চশিক্ষা কিংবা চাকরিসহ বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত প্রবাসী বাংলাভাষীদের সংখ্যাও এখন ক্রমে ক্রমে বেড়ে চলেছে। আর তাদের অনেকেই দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষাকে তুলে ধরতে প্রবাসে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাভাষী বিভিন্ন বিদ্যালয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্য কোথায় নেই এই বিদ্যালয়। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ও কানাডা থেকে বাংলা ভাষায় বর্তমানে একাধিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে, টিভি-বেতার চ্যানেলে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হচ্ছে। এসব বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্যই হলো বাংলা ভাষাকে বিদেশের মাটিতে নতুনভাবে তুলে ধরা। বইমেলা, সঙ্গীত-কবিতা সন্ধ্যা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সব কিছুতেই বাংলা ভাষার জয়ধ্বনি আজ শোনা যায় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী নিজ নিজ অভিবাসী দেশে এখন সংবাদমাধ্যম চালু করেছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই বাংলাদেশী অনলাইন বাংলা পত্রিকার অনুমোদন মিলেছে। ফলে বাংলা পত্রিকা এখন কেবল বাংলাদেশ বা ভারতের ছাপাখানা থেকেই নয়, বরং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে।
বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহের কারণে বিশ্বের প্রায় ১০টি দেশের রাষ্ট্রীয় বেতারে বাংলা ভাষার আলাদা চ্যানেল রয়েছে। আরো ১০টি দেশের রেডিওতে বাংলা ভাষায় আলাদা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে ১০টি ও যুক্তরাষ্ট্রে ২০টি বাংলাদেশী মালিকানাধীন ও বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। রয়েছে কানাডাতেও। বাংলা ভাষায় যুক্তরাজ্য থেকে মোট ১২টি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হয়। বেতার বাংলা নামে সেখানে একটি বাংলা রেডিও স্টেশন রয়েছে। ধূমকেতু, জন্মভূমি, প্রতিদিন, স্বদেশ-বিদেশ নামে পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকাও প্রকাশিত হচ্ছে।
ইউরোপের ইতালিতে বর্তমানে পাঁচটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা এবং রোম ও ভেনিস শহর থেকে তিনটি বাংলা রেডিও স্টেশন পরিচালিত হচ্ছে।
বিশ্বজুড়েই বাংলাভাষীদের উপস্থিতি এবং মাতৃভাষাপ্রেম বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীর পথে প্রান্তরে। একুশ শতকের (সিকি শতাব্দীর) ২৫ সালে এসে বিশ্বজুড়ে বাংলার এই অহঙ্কারদীপ্ত পদচারণা ১৯৫২ সালের ভাষাশহীদদের পবিত্র রক্তদানের ফসল।
’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল মাতৃভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ থেকে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে সেদিন জেনেশুনেই মৃত্যুকূপে ঝাঁপ দিয়েছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। শাসকের রক্তচক্ষু, ভয়ভীতি কোনো কিছুই তাদের পিছু হটাতে পারেনি। সেই একুশের শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে আমরা ৭১-এ ছিনিয়ে এনেছি স্বাধীনতা, ৯০-এ তাড়িয়েছি স্বৈরাচার আর ২৪ শে এসে জেন-জি প্রজন্ম ফ্যাসিবাদের কবর রচনা করেছে। আজ আমরা অর্জন করেছি নতুন স্বাধীনতা। এই জন্যই মহান একুশের শহীদরা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে। একুশ আমাদের জাতির ইতিহাসে অপরিসীম অনুপ্রেরণার উৎস।


আরো সংবাদ



premium cement