বিশ্বের দেশে দেশে ভাষা
- মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
- ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০৭
পৃথিবীতে কত ভাষা আছে? তিন হাজার না তার চেয়ে বেশি? পৃথিবীর এই হাজার হাজার ভাষা আর তাদের অসংখ্য উপভাষাগুলোর উদ্ভব কি একটি আদিম ভাষা থেকে? ওই সব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা কোনগুলো, তাদের বয়স কত, কোন আদিম ভাষা কখন কোন অঞ্চলে কোন মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল? এসব প্রশ্নেরও সঠিক উত্তর আমরা দিতে পারব না, কারণ অনেক অনুসন্ধান করেও সব কথা জানা যায়নি। কত ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে কে জানে? আর তার সাথে সাথে কত মানুষের কত চিন্তা, কত ভাবনা, কত অভিজ্ঞতা? সভ্যতার যেমন উত্থান আছে পতন আছে ভাষারও হয়তো তেমনি কিন্তু অনেক সভ্যতা, অনেক জাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথচ তাদের ভাষা ধ্বংসে হয়ে যায়নি, আশ্চর্যজনকভাবে অনেক ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতার স্মৃতিকে বহন করে টিকে আছে কোন কোন ভাষা, তবে একটি ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলে একটি জাতিও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
একটি ভাষা বলতে আমরা কি বুঝি? ভাষা বলতে আমরা বুঝি ছোট বা বড় একটি জনসমষ্টির ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যম বা মৌখিক যোগাযোগের বাহনকে। পুঁথির ভাষা তো মুখের ভাষাকে ধরে রাখারই প্রয়াস মাত্র। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় এমন অনেক ছোট ছোট ভাষাগোষ্ঠী আছে যাদের সদস্য সংখ্যা কয়েকশতের বেশি নয় এবং দ্রুত ওইসব ভাষা অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বা মৃত ভাষায় পরিণত হতে চলেছে। আবার এমনো দেখা যায় যে ক্ষুদ্র একটি অঞ্চলের ভাষা পৃথিবীর বিরাট অংশ জুড়ে আধিপত্য করছে। যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ইংল্যান্ডের ভাষার একক আধিপত্য। ভাষার পৃথিবী এক আশ্চর্য পৃথিবী কারণ ভাষার কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক, ধর্মীয়, জাতীয় সীমারেখা নেই, একই ভাষা বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন জাতির মাতৃভাষা হতে পারে আবার একটি ভাষা কেবল একটি দেশের একটি জাতির, একটি ধর্মের মানুষের ভাষাও হতে পারে।
ভাষা ও জাতীয়তা সর্বদা একাত্ম নয় তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা সম্পর্কিত হতেও পারে। যে জাতি-বিজাতি দ্বারা বিজিত ও শাসিত সে জাতির ভাষা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বঞ্চিত। অনেক সময় সে ভাষা বিদেশী শাসক দ্বারা অবদমিত অথচ হয়তো সেই অবহেলিত ও নিষ্পেষিত ভাষাই ওই জাতির সংস্কৃতি এবং জাতীয় অধিকারের প্রতীক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা আমরা দেখেছি। অন্য দেশেও এমন ঘটনা ঘটেছে। দেশ বিভাগের সময় পোল্যান্ড এবং রুশ জারের অধীনে ফিনল্যান্ড ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঐতিহাসিক ঘটনা। আবার একই ভাষা একাধিক জাতির জাতীয় ও মাতৃভাষা হতে পারে। স্প্যানিশ বিজয়ে ফলে দক্ষিণ আমেরিকার বহু রাষ্ট্র এবং মধ্য আমেরিকার মেক্সিকোতে স্প্যানিশ ভাষা সে মর্যাদা পেয়েছে। একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অধীনস্ত একটি রাষ্ট্রে আবার একাধিক ভাষা রাষ্ট্রীয় বা সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করতে পারে, সুইজারল্যান্ডে ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয় ভাষা, বেলজিয়ামে ফ্লেমিশ এবং ফরাসি ভাষা, কানাডায় ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা যে মর্যাদার অধিকারী।
ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মধ্যে সীমারেখা কিন্তু সর্বদা স্পষ্ট নয়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে নরওয়ে ডেনমার্কের অধীনে ছিল বলে ডেনো-নরওয়েজিয়ান নামে যে সাহিত্যিক ভাষাটি গড়ে উঠেছিল, তা ওই দুই দেশের সাহিত্যকর্মেই ব্যবহৃত হতো, বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকার হেনরিক ইবসেন যে ভাষায় তার বিখ্যাত নাটকগুলো রচনা করেছিলেন। আজও একজন সুদক্ষ ডেনমার্কবাসী একজন নরওয়েজিয়ানের সাথে কথাবার্তা চালাতে পারেন। নরওয়ে ডেনমার্ক থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করলে দুই দেশের ভাষার বিকাশ ঘটে স্বাধীনভাবে ফলে আধুনিক নরওয়ে ও ডেনমার্কের ভাষা আলাদা কিন্তু ভাষা দু’টি বিবর্তনের ইতিহাসে যথার্থই স্বতন্ত্র কি না সে প্রশ্ন উঠতে পারে। বেলজিয়ামের জার্মানভাষীদের ফ্লেমিশ এবং হল্যান্ডের ডাচ ভাষা নিয়েও একই প্রশ্ন তোলা চলে। একজন ফ্লেমিশভাষীর পক্ষে হল্যান্ড গিয়ে কথাবার্তা চালাতে কোনো অসুবিধে নেই। স্পষ্ট রাজনৈতিক সীমারেখা থাকা সত্ত্বেও ওইসব ক্ষেত্রে ভাষাতাত্ত্বিক সীমারেখা অস্পষ্ট।
একই অঞ্চলে একই ভাষার মধ্যে ভৌগোলিক বৈচিত্র্য উপেক্ষণীয় নয়, ভাষার এই বৈশিষ্ট্যকেই আমরা উপভাষা বলে থাকি। বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে সম্প্রসারিত একটি ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক পার্থক্য কখনো-কখনো ব্যাপক। স্কটল্যান্ড ও গ্রেট ব্রিটেনের ভাষার কথা ধরা যাক। স্কটল্যান্ডের একটি স্থানীয় ও নিজস্ব সাহিত্যিক ভাষা আছে, এ ভাষা ইংল্যান্ডের শিষ্ট ইংরেজি ভাষা থেকে পৃথক। চতুর্দশ শতক থেকে বর্তমান কাল অবধি বহু বিশিষ্ট সাহিত্যিক ওই ভাষা ব্যবহার করে আসছেন; ওই ভাষার নিজস্ব অভিধানও রয়েছে। স্কটিশ উচ্চভূমিতে প্রাচীন কেল্টিক ভাষার অস্তিত্বের কারণেই স্কটল্যান্ডের ভাষায় ওই পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। ইংল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান প্রভাবের ফলে অ্যাংলো-স্যাক্সন উপভাষাগুলো তাদের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য লাভ করেছিল। এখন প্রশ্ন হলো স্কটিশ ভাষা কি একটি স্বতন্ত্র ভাষা না ইংরেজি ভাষার অন্তর্গত একটি উপভাষা? উত্তরাঞ্চলের ভাষার সাথে ইংল্যান্ডের অন্যান্য অঞ্চলের ভাষার গভীর যোগসূত্র থাকা সত্ত্বেও তাদের পার্থক্য উপেক্ষণীয় নয়। রবার্ট বার্নস বা আলেকজান্ডার গ্রে-র কবিতায় ওই বিশেষ ভাষার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। বস্তুত ভাষা এবং উপভাষার মধ্যে সীমারেখা টানা সর্বদা সম্ভবপর নয়। যখন একই ভাষা কিছু পার্থক্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন মানুষের মুখের ভাষারূপে গৃহীত হয় তখন ভাষাগত ঐক্যের কথা বলা চলে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ভাষার সাথে দেশ, কাল, জাতি, ধর্ম, রাষ্ট্র বা অঞ্চলের সঙ্গতি থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। উপরিউক্ত পটভূমিকায় আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করব।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা : ইউরোপের প্রায় সমগ্র এবং এশিয়ার অনেকটা জুড়ে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠী প্রচলিত। খ্রিষ্টের জন্মেরও কয়েক হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়া থেকে উদ্ভূত হয়ে যে ভাষা একদিকে ইউরোপে এবং অন্য দিকে পারস্য ও ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিক অবস্থায় পারস্য ও ভারতবর্ষে আগত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার দু’টি শাখার মধ্যে এতই সাদৃশ্য ছিল যে তাদের ইন্দো-ইরানীয় বলা হতো। পরে ঐতিহাসিক কারণে কালের বিবর্তনে পারস্য ও ভারতবর্ষে আগত ভাষার স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বিকাশ ঘটে। ইরানির শাখার আধুনিক বিবর্তন ফারসি, ভারতবর্ষে আগত ইন্দো-ইউরোপীয় বা ইন্দো-ইরানীয় ভাষার নাম ইন্দো-আর্যভাষা। আর্যভাষার প্রাচীন রূপ বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষায়, মধ্যরূপ পালি, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় আর আধুনিক রূপ পাঞ্জাবি, সিন্ধি, রাজস্থানি, মারাঠি, গুজরাটি, সিংহলি, হিন্দি-উর্দু বা হিন্দুস্তানি, উড়িয়া, বাংলা, আসামি ইত্যাদি ভাষা।
প্রাচীন ভারতবর্ষের ভাষার সাথে আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ করা যায় লিথু ও লেটিশ নামক একজোড়া উত্তর-মধ্য ইউরোপীয় ভাষার, এই দু’টি ভাষা নিয়ে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর বাল্টিক শাখা গঠিত। বাল্টিকের প্রতিবেশী শাখা সøাভিক, এই সøাভিক শাখার ভাষাগুলো পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়ানো। পোলিশ, চেক, সেøাভাক ভাষা নিয়ে পশ্চিম সøাভিক, বুলগেরীয়, সার্বো-ক্রোশীয় নিয়ে দক্ষিণ সøাভিক বা বলকান রুশ ভাষা নিয়ে পূর্ব সøাভিক উপশাখা গঠিত। রুশ ভাষা সøাভিক ভাষাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত। ইন্দো-ইরানীয় ও আর্য, বাল্টিক এবং সøাভিক শাখা নিয়ে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর শতম শাখা। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হেলেনিক, পুরাতন এথেন্স নগরীর সভ্যতার ভাষা এটিক এ ভাষারই অন্তর্গত। হেলেনিক শাখার গ্রিক ভাষা দীর্ঘদিন পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের যোগাযোগের বাহন ছিল। সাহিত্য ও সভ্যতার বাহন হিসেবে গ্রিক ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। ইতালিক ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর আর একটি উল্লেখযোগ্য ভাষা, গ্রিসের মতো প্রাচীন ইতালির ভাষাও বিভিন্ন উপভাষার সমন্বয়, যার একটি ওসকান আর একটি উমব্রিয়ান; কিন্তু ইতালীয় উপভাষাগুলোর মধ্যে লাতিন আর সব উপভাষাকে ছাড়িয়ে কেবল ইতালিতেই নয় সমগ্র বিশ্বে সঙ্গতকারণেই খ্যাতি অর্জন করেছে। লাতিন কেবল অমর সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা হিসেবেই নয় সাথে সাথে বিশাল রোমক সাম্রাজ্যের সরকারি ও সামরিক ভাষা হিসেবেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। প্রাচীন বা ক্লাসিক্যাল লাতিন জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষারূপে আর চলিত লাতিন সাধারণ সৈনিক, ব্যবসায়ী ও উপনিবেশ স্থাপনকারীদের ভাষা হিসেবে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই ভাষাই কালের বিবর্তনে বর্তমানকালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জাতীয় ভাষায় পরিণত হয়। রুমানীয়, ইতালীয়, ইতালি, পর্তুগিজ, স্পেন, ফ্রান্সের ভাষা রোমান্স শাখাভুক্ত; আধুনিক রুমানীয়, ইতালীয়, পর্তুগিজ, স্প্যানিস এবং ফরাসি ভাষা যার নিদর্শন। স্প্যানিস ভাষা আবার দক্ষিণ বা লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে আর পর্তুগিজ ভাষা ব্রাজিলে বিস্তারিত।
ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর জার্মানিক শাখাও বহুল বিস্তৃত। আইনল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইটজারল্যান্ড, জার্মানি ও অস্ট্রিয়াতে এই শাখার ভাষাগুলো জাতীয় ভাষা। ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর কেল্টিক শাখা এক সময়ে চেকোসেøাভাকিয়া, অস্ট্রিয়া, দক্ষিণ জার্মানি, উত্তর ইতালি, ফ্রান্স এবং বিট্রিশ দ্বীপপুঞ্জে চালু ছিল। আজও এ ভাষার স্বাক্ষর পাওয়া যায় আয়ারল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে, স্কটল্যান্ডের উত্তর উচ্চ ভূমিতে, ওয়েলসে আর ফ্রান্সের ব্রিটানিতে। ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর দু’টি শাখা আলবেনীয় এবং আর্মেনীয় আজও জীবিত ভাষা কিন্তু হিট্টি আজ একটি মৃত ভাষা।
ফিনো-উগ্রিক এবং বাস্ক : ইউরোপের ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠী বহির্ভূত ফিনিশ, ইস্টোনীয় এবং হাঙ্গেরীয় ভাষা ফিনো শাখাভুক্ত আর ল্যাপিস, পারসিয়ান ও উত্তর সাইবেরিয়ার স্যামোয়েড ভাষা উগ্রিক শাখাভুক্ত। বাস্ক ভাষা স্পেন ও ফ্রান্সে প্রচলিত।
সেমেটিক-হামিটিক : সেমেটিক ভাষা পুরাতন বিশ্বের আশিরীয় এবং ব্যাবিলোনীয় সভ্যতার বাহন ছিল। বাইবেলের পুরাতন টেস্টামেন্টের ভাষা হিব্রু সেমেটিক শাখার। আরবি ভাষাও সেমেজিক শাখাভুক্ত, পবিত্র কুরআন মাজিদের, ইসলাম ধর্মের এবং বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রের ভাষা হিসেবে আরবি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। হামিটিক ভাষা প্রাচীন মিসরের আর আধুনিক হামিটিক ভাষা উত্তর ও মধ্য আফ্রিকায় প্রচলিত। ইথিওপিয়ার আবিসিনিয়ার ভাষা এ শাখাভুক্ত।
আল্টাইক এবং পোলিও-সাইবেরীয় : মধ্য এশিয়ার আল্টাই পার্বত্য অঞ্চল থেকে উদ্ভূত এ গোষ্ঠীর শাখা তুরস্কের তুর্কি ভাষা এবং মঙ্গোল তুঙ্গুজ ভাষা। সাইবেরিয়ার উত্তর-পূর্বের ইয়াকুত ভাষা, সাইবেরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমের কাজাক, উজবেক এবং তুর্কমেন ভাষাও এ শাখার সাথে সম্পর্কিত।
সিনো-টিবেটান : চীনা ভাষা এ গোষ্ঠীর প্রধান শাখা, পৃথিবীর বৃহত্তম জনগোষ্ঠী চীনা ভাষাভাষী। চীনা ভাষাকে অবশ্য অনেকে একটি মাত্র ভাষা না বলে কয়েকটি ভাষা বলেছেন কারণ চীনের এক অঞ্চলের মানুষ আরেক অঞ্চলের ভাষা বুঝতে পারেন না। তবে চৈনিক লিখন প্রণালি চীনা ভাষার ঐক্য ও যোগসূত্রের বাহন। তিব্বতি ও বার্মি ভাষা চীনা ভাষার সাথে বংশগতভাবে সম্পর্কিত, এসব ভাষার শাখা-প্রশাখা ভারতীয় উপমহাদেশ ও চীনের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে বা ইন্দো-চীনে প্রচলিত। কোরীয় ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে তিব্বতি ও বার্মি ভাষার সাথে জাপানি ভাষার লিখন প্রণালি চীনা লিখন প্রণালির মতোই যদিও জাপানি ভাষার ইতিহাস পৃথক। মালয়-পলিনেশীয় ভাষা মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নিউজিল্যান্ড ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিস্তৃত। অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের ভাষা আবার ভিন্ন বংশজাত। ভারতে আর্য ভাষা বহির্ভূত ভাষা গোষ্ঠী হলো দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় ভাষা গোষ্ঠী, তামিল, তেলেগু, কানাড়া, মালায়ালাম এ শাখার ভাষা। ককেশাস ভাষা ককেশাসের পার্বত্য অঞ্চলে প্রচলিত, জর্জিয়ান ভাষা এ শাখাভুক্ত।
আফ্রিকার ভাষা : উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে পূর্ব আফ্রিকার গিনি উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের বহু ভাষা সুডানিজ-গিনি শাখাভুক্ত। আরো দক্ষিণ ভাগে প্রচলিত বান্টু শাখা, যে শাখার ভাষাগুলো মধ্য আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়ানো। দক্ষিণ আফ্রিকার আঞ্চলিক ভাষাগুলো খোইন নামে পরিচিত, এর দু’টি শাখা- একটি বুশম্যান অপরটি হটেনটট।
আমে রেড ইন্ডিয়ান ভাষা : পশ্চিম গোলার্ধের প্রাচীন ভাষাগুলোকে ইদানীং আমে রেড ইন্ডিয়ান ভাষা বলা হচ্ছে। উত্তর আমেরিকার কানাডার উত্তর থেকে মেক্সিকো পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে পশ্চিমী উপনিবেশ স্থাপনের পূর্বে আদিবাসীদের বা রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে প্রচলিত অসংখ্য ভাষা মোটামুটিভাবে ছয়টি শ্রেণীতে বিন্যস্ত। এক্সিমো-এলিউশিয়ান শাখা এলিউশিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, উত্তর কানাডা এবং গ্রিনল্যান্ডে প্রচলিত। এলগোনকুইন-ওয়াকাশ শাখা- দক্ষিণ কানাডা ও উত্তর আমেরিকার বিস্তীর্ণ ভূভাগে ছড়ানো ছিল। হোকা-সিউ শাখা-উত্তর আমেরিকা থেকে মেক্সিকো পর্যন্ত বিস্তৃত। না-দেনে শাখা-পশ্চিম কানাডা ও আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের ভাষা। পেনুশিয়া শাখা-ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, ওরিগন এবং ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের ভাষা। উটো-আজটেক শাখা-পশ্চিম আমেরিকা, মধ্য মেক্সিকো এবং পানামা পর্যন্ত সম্প্রসারিত।
উপরোল্লিখিত রেড ইন্ডিয়ান ভাষাগুলোর মধ্যেও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিল উটো-আজটেক ভাষা গোষ্ঠী। এ গোষ্ঠীর নাহুয়াটল ভাষা আজটেক সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রভাষা ছিল। দক্ষিণ মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ ভাষা ছিল মায়া-সোকো, মায়া সভ্যতার ভাষা। আরওয়াক শাখা এন্টিলেসে প্রচলিত ছিল এবং এ শাখার ভাষা এক সময়ে দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাংশ জুড়ে ছিল। কারিব ছিল আমাজনের উত্তরাঞ্চলের ভাষা আর কিচুয়া পেরুর ইন্কা সভ্যতার ভাষা। আজটেক, মায়া এবং ইন্কা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সমৃদ্ধ প্রচীন সভ্যতা।
পৃথিবীর ভাষাগুলোর উপরিউক্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণী থেকে বোঝা যায়, এ বিশ্বে বিচিত্র ও অসংখ্য ভাষা প্রচলিত, কত ভাষা বিলুপ্ত আবার কত ভাষা বিস্তৃত ভৌগোলিক অঞ্চলে বিপুল মানবগোষ্ঠীতে প্রসারিত। ভাষা বিস্তারের প্রধান উপায় যেমন এক ভাষাভাষী জাতি কর্তৃক অপর ভাষাভাষী অঞ্চল বিজয় তেমনি ভাষা বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ এক ভাষাভাষী জাতির কাছে অপর ভাষাভাষী জাতির পরাজয়। বিজয়ী এবং বিজিত জাতির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল বিজয়ী ও বিজিত জাতির ভাষার পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিবর্তন, বিশেষত বিজিত ভাষার ভবিষ্যৎ। বর্তমানে বিভিন্ন পাশ্চাত্য উপনিবেশ স্বাধীনতা লাভ করে তাদের উপেক্ষিত, অনাদৃত, অবহেলিত ভাষাগুলোকে দ্রুত উন্নত করার কাজে ব্যাপৃত। এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশে বর্তমানে জাতীয় ভাষাগুলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীক হিসেবে আদৃত হয়েছে। এসব দেশে বোধগম্য কারণেই ভাষা জাতীয় স্বাধীনতা, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় মর্যাদাবোধের প্রতীক। বাংলাদেশেও বাংলা ভাষা স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীন বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদাবোধের প্রতীক।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা