বায়োস্কোপ
- হাসান মাহমুদ রিপন
- ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
বায়োস্কোপের সাথে বাঙালিকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। বিশেষ করে গ্রাম বাংলার জনপদে বেড়ে ওঠা মানুষকে তো বটেই। তবে যারা শহরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী জীবন যাপন করে অভ্যস্ত কিংবা যাদের জন্ম এই মাত্র একযুগ আগে তাদের কাছে হয়তো হাস্যকর এক বোকা বাক্স মনে হবে। কিন্তু বায়োস্কোপ মোটেও হাস্যকর কোনো বস্তু ছিল না, কিংবা ছিল না কোনো বোকা বাক্সও!
প্রকৃতপক্ষে বায়োস্কোপ গ্রাম বাংলার সিনেমা হল। রঙ-বেরঙের কাপড় পরে, হাতে ঝুনঝুনি বাজিয়ে বিভিন্ন রকমের আলোচিত ধারা বর্ণনা করতে করতে ছুটে চলত গ্রামের স্কুল কিংবা সরো রাস্তা ধরে। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো তার পেছন পেছন বিভোর স্বপ্ন নিয়ে দৌড়াত গ্রামের ছেলেমেয়েরা। বায়োস্কোপওয়ালার এমন ছন্দময় ধারা বর্ণনায় আকর্ষিত হয়ে ঘর ছেড়ে গ্রামের নারী-পুরুষ ছুটে আসত বায়োস্কোপের কাছে। এক সাথে সবাই ভিড় জমালেও তিন কি চারজনের বেশি একসাথে দেখতে না পারায় অপেক্ষা করতে হতো। সিনেমা হলের মতো এক শো এরপর আবার আর তিন বা চারজন নিয়ে শুরু হতো বায়োস্কোপ।
বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করলেই ‘কি চমৎকার দেখা গেলো’ বলে ফের শুরু হতো বায়োস্কোপওয়ালার ধারা বিবরণী। আর এই বায়োস্কোপ দেখানোর বিনিময়ে দু’মুঠো চাল কিংবা দুই টাকা নিয়েই মহা খুশি হয়ে ফিরে যেত বায়োস্কোপওয়ালা।
কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে বাংলার বিনোদনের এই লোকজ মাধ্যমটি। টিভি আর আকাশ সংস্কৃতি স্যাটেলাইট ও ডিজিটালের যুগে সহজলভ্যতার কারণে আপনা আপনিই উঠে গেছে বায়োস্কোপ। তবুও কোথাও না কোথাও একজন থাকে। তেমনি একজন আব্দুল জলিল মণ্ডল।
রাজশাহী জেলার বাঘমারা থানার চায়ের শারা গ্রামের মরহুম বকশি মণ্ডলের ছেলে জলিল মণ্ডল। বাবা বকশি মণ্ডল দীর্ঘ ৪১ বছর এ পেশায় জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে বাবার উত্তরসূরি হিসেবে ১০-১২ বছর বয়সে জলিল মণ্ডল এ পেশায় আসেন। এরই মধ্যে এ পেশায় দীর্ঘ ৩৯ বছর পার করে দিয়েছেন তিনি। এ পেশার আয়রোজগার দিয়েই স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে কোনোরকমে তার দিন চলে যাচ্ছে।
বায়োস্কোপ পেশায় তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেন। একটা সময় ছিল যখন গ্রাম-গঞ্জের পথে ঘাটে, হাট-বাজারে তিনি ও তার বাবা বায়োস্কোপ দেখিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। তখন ধান, চাল ও অর্থের বিনিময়ে বায়োস্কোপ প্রদর্শন করতেন। বায়োস্কোপ প্রদর্শনের বিষয়বস্তু সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে বিভিন্ন প্রেম কাহিনী, তার পর যুদ্ধ, বিশ্বের দর্শনীয় স্থান, ধর্মীয় বিষয় ও রাষ্ট্রনায়কদের নিয়ে বায়োস্কোপ প্রদর্শন করা হয়। এ জন্য তাদেরকে অনেক বেশি জানতে হয়। তার পর সেটি প্রদর্শনের সময় এক এক করে ছন্দ মিলিয়ে বলতে হয়। তা হলেই দর্শক বায়োস্কোপ দেখতে আগ্রহী হয়। তার বাক্সে এক সাথে ছয়জন দর্শক বায়োস্কোপ দেখতে পারে।
আ: জলিল মণ্ডলের মতে, ঘরে ঘরে টেলিভিশন ও হাতে মোবাইল ফোন চলে আসায় এখন আর আগের মতো এর প্রতি দর্শকদের চাহিদা নেই বললে চলে। তবে অনেকেই কৌতূহল নিয়ে এটি দেখতে এগিয়ে আসেন। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন মেলায় এ বায়োস্কোপ প্রদ র্শন করে থাকেন।
তিনি বলেন, দীর্ঘ ৩১ বছর ধরে গ্রামে গ্রামে গিয়ে বায়োস্কোপ দেখিয়েছেন। এক যুগ আগেও বায়োস্কোপের যে জৌলুস ছিল, প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় তা আজ বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু জলিল মণ্ডল আর আগের মতো অকেজো জিনিস হিসেবে ছুড়ে দেননি বায়োস্কোপকে। জড়িয়ে ধরে রেখেছেন সন্তানের মতো। মানুষ এই বায়োস্কোপ না দেখলেও যখনই তার মনে চায়, তিনি গ্রামের সরু রাস্তা ধরে বায়োস্কোপ নিয়ে ছুটে চলেন। জলিল মণ্ডল জানেন বায়োস্কোপ এখন আর কেউ টাকা দিয়ে দেখবে না, তারপরও তিনি বায়োস্কোপ নিয়ে বের হয়ে পড়েন। কিছু উপার্জনের আশায় সুদূর রাজশাহী থেকে তিনি ছুটে এসেছেন সোনারগাঁওয়ে লোক কারুশিল্প মেলায়। তিনি জানান, দীর্ঘ ৩৯ বছর ধরে পূর্বসূরিদের এই পেশাকে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরে বায়োস্কোপ দেখিয়ে আসছেন তিনি। মনের আনন্দে বায়োস্কোপকে মাথায় তুলে নিলেও একটা সময়ে তা জীবিকা নির্বাহ করার মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এখন আগের মতো মানুষ আর বায়োস্কোপ না দেখায় বাংলার এই ঐতিহ্যকে বহন করে আসা জলিল মণ্ডলও আশাহত, ক্রমাগত আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
তিনি বলেন, এইটা আমার পেশা। ছেলে পেলেদের দেখায় আনন্দ দিতাম। মানুষের কাছে বায়োস্কোপটা ছিল এক মহা রহস্যময় ব্যাপার। এটি অনেকের কাছে ছিল জাদুর বাক্সের মতো। এইটা দিয়াই আমার সংসারটা চলত। এখন আর আগের মতো স্কুলের পোলাপান বায়োস্কোপ দেখে না। বিভিন্ন অনুষ্ঠান হলে পরে আমাকে ডাকে, ওইখানে গিয়ে বায়োস্কোপ দেখাই।
জলিল মণ্ডলের এই বায়োস্কোপ দেখতে লাগে মাত্র ২০ টাকা। তবু আধুনিক মাল্টি মিডিয়ার যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বায়োস্কোপেও ছবি পাল্টান, নতুনত্ব আনেন। চেষ্টা করেন দর্শকের মনোরঞ্জনের।
সোনারগাঁওয়ে লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে বায়োস্কোপের উপস্থিতি শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ নানা পেশার মানুষদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তাদের মন্তব্য এ আধুনিতার যুগেও বায়োস্কোপ টিকে রয়েছে। বয়োজ্যেষ্ঠদের মতে- এ বিনোদন মাধ্যমের সাথে তাদের অতীত জড়িয়ে রয়েছে। কেউ কেউ বায়োস্কোপের কলাকুশলী জলিল মণ্ডলকে কাছে পেয়ে জমিয়ে আড্ডা দিতে শুরু করেন। এসময় উভয়ের মধ্যে কথা হয় সময়ের পরিবর্তনে মানুষের ধ্যান ধারণার পরিবর্তন নিয়ে।
মেলায় আগত দর্শনার্থী নরসিংদী থেকে আসা সাব্বির আহমেদ পলাশ জানান, বায়োস্কোপের সাথে তার অতীত জড়িয়ে রয়েছে। তিনি তার বাবার সাথে যখনই হাটে যেতেন তখন বায়োস্কোপ দেখার বায়না করতেন। এত বছর পর বায়োস্কোপ দেখে তিনি তার অতীত ও বাবার হাত ধরে হাটে যাওয়ার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে বলে জানান।
কুমিল্লার বুড়িরচং থেকে আগত দর্শনার্থী সিরাজুল আলম জানান, আমি নিজে দেখেছি ওই বায়োস্কোপ। দুপুরে বাড়ির উঠোনে বাক্সটা নিয়ে বসত। বাড়ির সবাই একে একে দেখতাম। আস্তে আস্তে সব বিলীন হয়ে যাবে আমাদের অতীত ঐতিহ্য। আমরা এখন আকাশ সংস্কৃতির ঘেরাটোপে বন্দী।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক কাজী মাহবুবুল আলম জানান, বাংলার প্রায় হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় ঘটিয়ে দেয়ার জন্যই মাসব্যাপী এ মেলার আয়োজন। এবারের মেলায় নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় ঘটনোর জন্য বায়োস্কোপ নিয়ে আসা হয়েছে। গত কয়েকটি মেলাও তাকে আনা হয়েছিল। বায়োস্কোপ আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির একটি ঐতিহ্য বহন করে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা