ইউনানি চিকিৎসার কথা
- ডা: মো: জহিরুল ইসলাম (রুবেল)
- ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০, আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ২০:১৫
ইউনানি চিকিৎসাপদ্ধতির উৎপত্তি গ্রিসে। বোকরাত তথা হিপোক্রেটিসকে এই চিকিৎসাপদ্ধতির জনক বলা হয়। আরবিতে বোকরাতের প্রকৃত নাম আবু কারাতিস। অধিক ব্যবহারের দরুণ ওই নাম সংক্ষিপ্ত হয়ে বোকরাতে রূপান্তর হয়। ইংরেজিতে তিনি Hippocrates নামে পরিচিত। গ্রিসের আরবি নাম ইউনান। ইউনান থেকে ইউনানি শব্দের উৎপত্তি।
জগৎ বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী আল রাজী, ইবনে সিনা, আল জাহরাবি ও ইবনে আন নাফিসসহ অন্য মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানীর মাধ্যমে ইউনানি চিকিৎসা সম্প্রসারিত ও বিকশিত হয়।
নবম শতাব্দীর প্রথমার্ধে আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদের প্রধান উজির নিজামুল মুলক বাগদাদে নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও স্পেনের উমাইয়া বংশের খলিফাগণ কর্ডোভায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে সেখানে ইউনানি বিভাগ খোলা হয়।
উপমহাদেশে ইউনানি চিকিৎসার সূচনা : খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষ ভাগে উপমহাদেশের পশ্চিম প্রান্তে প্রথম মুসলমানদের আগমন ঘটে। ৭১২ সালে আরব সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাশিম উপমহাদেশের সিন্দু অঞ্চল জয় করেন। ১৫২৬ সালে বিখ্যাত মুসলিম সম্রাট এবং মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর দিল্লি অধিকার করেন এবং মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। উপমহাদেশের মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা করেন, যা ইংরেজ আগমনের সময় ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।
এই সুদীর্ঘ সময় দিল্লির মুসলিম সুলতান ও মুঘল সম্রাটরা ইউনানি চিকিৎসকদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেন এবং তাদের অনেককে রাজকীয় তথা রাষ্ট্রীয় চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৩শ’ থেকে ১৭শ’ সাল পর্যন্ত ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের ইউনানি চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ। পরবর্তীতে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন চালু হলে তৎকালীন ইংরেজ সরকার ইউনানি চিকিৎসা থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার প্রচার ও প্রসারে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ফলে ইউনানি চিকিৎসাব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তখন ইউনানি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। গুরু, শিষ্য ও বংশপরম্পরায় এর শিক্ষাদান হতো। পরে ইংরেজ আমলে বিখ্যাত কয়েকজন ইউনানি চিকিৎসক ইউনানি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯১০ সালে উপমহাদেশের বিখ্যাত ইউনানি চিকিৎসক ও রাজনীতিবিদ মসীহুল মুলক হাকিম হাফেজ মুহাম্মদ আজমল খান অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার ব্যবস্থা উন্নতি সম্পর্কে জানতে ইউরোপ সফর করেন। তিনি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল ও ওষুধ কারখানাগুলো পরিদর্শন করেন; যাতে ইউনানি চিকিৎসার উন্নতির জন্য নতুন পথের সন্ধান করা যায়।
উপমহাদেশে ফিরে এসে তিনি তিব্বী কনফারেন্স নামে ইউনানি চিকিৎসকদের অধিকার আদায়ের জন্য একটি সংগঠন করেন। এ সময় ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিকভাবে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার প্রসার করার ব্যবস্থা করেন এবং ইউনানি চিকিৎসাব্যবস্থাকে কোণঠাসা করে দিলে আজমল খান সাহেব ইউনানি চিকিৎসকদের নিয়ে একটি সম্মেলন আহ্বান করেন। ওই সম্মেলনের প্রস্তাবের আলোকে আজমল খান দিল্লির করোলভাগে দ্য আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি তিব্বিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। ১৯১২ সালে আজমল খানের অনুরোধে ভারতের বড় লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ তিব্বিয়া কলেজের ভিত্তিপ্রস্তরের স্থাপন করেন। ইউনানি চিকিৎসাকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আজমল খান ওই কলেজে ইউনানি চিকিৎসাব্যবস্থার সাথে ইউরোপের আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার সমন্বয় করে পাঠ্যক্রম তৈরি করে পাঠদানের ব্যবস্থা করেন এবং ইউনানি ওষুধের গবেষণার জন্য এক লাখ টাকা ব্যয়ে ওই কলেজে একটি গবেষণাগার স্থাপন করেন। ইউনানি ওষুধকে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. সলিমুজ্জামান সিদ্দিকিকে জার্মানি থেকে নিয়ে এসে ওই গবেষণাগারের দায়িত্ব দেন। ড. সিদ্দিকি সর্পগন্ধার ওপর গবেষণা করে Ajmaline, Ajmalinine, Ajmalicine(C21 H24 O3) ও Isoajmaline নামক Alkaloid আবিষ্কার করেন, যা মানসিক ব্যাধি ও কার্ডিভাস্কুলার রোগে কার্যকরী। তার এ আবিষ্কার পৃথিবীর গবেষণা জগতে তাক লাগিয়ে দেয়।
বাংলাদেশে ইউনানি চিকিৎসার ইতিহাস : বাংলাদেশ একসময় উপমহাদেশের অংশ ছিল। মূলত তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমনের পর থেকে ইউনানি চিকিৎসাবিজ্ঞান ব্যাপক পরিচিতি পায়। তখন কোনো ইউনানি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। ঢাকার কৃতীসন্তান প্রখ্যাত ইউনানি চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদ শেফাউল মুলক হাকিম হাবিবুর রহমান খান আখুনজাদা উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চল তথা বাংলাদেশ ইউনানি চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার জন্য প্রচেষ্টা চালান।
তার প্রচেষ্টায় তদানীন্তন বাংলা সরকার ইউনানি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের যৌক্তিকতা যাচাইয়ের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটি ঢাকা ও কলকাতায় দু’টি সরকারি ইউনানি কলেজ করার জন্য সুপারিশ করেন। কিন্তু তৎকালীন সরকারের অর্থাভাবের অজুহাতের কারণে কলেজ দু’টি আর স্থাপন হয়নি। তখন হাবিবুর রহমান সাহেব ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৩০ সালে সর্বপ্রথম ঢাকায় তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বাংলাদেশের প্রথম ইউনানি মেডিক্যাল কলেজ। অবিভক্ত বাংলার তদানীন্তন গভর্নর লর্ড ফ্রেডারিক বোর্ন ১৯৪৪ সালে তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ছাত্রদের সনদ বিতরণ করেন। অতঃপর ১৯৪৫ সালে তৎকালীন আসাম সরকার সিলেট সরকারি তিব্বিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন; যা বাংলাদেশের প্রথম সরকারি ইউনানি মেডিক্যাল কলেজ।
১৯৬৫ সালে জানুয়ারি মাসে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী চৌধুরী আবদুল্লাহ জহিরউদ্দিন লাল মিয়ার সদিচ্ছায় পাস হয় ইউনানি, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক আইন ১৯৬৫। ওই আইনের অধীনে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক গঠিত হয় বোর্ড অব ইউনানি অ্যান্ড আয়ুর্বেদিক সিস্টেমস অব মেডিসিন, পাকিস্তান। পরে স্বাধীন বাংলাদেশ ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক প্র্যাকটিশনার্স অর্ডিন্যান্স জারি করা হয় এবং পূর্ণাঙ্গ ইউনানি আয়ুর্বেদিক বোর্ড গঠন করা হয়।
১৯৮২ সালে ইউনানি ওষুধের বাণিজ্যিক উৎপাদনকে প্রথমবারের মতো সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়।
পরবর্তীতে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সরকার এমবিবিএস সমমানের ইউনানি চিকিৎসক তৈরির উদ্দেশ্যে ঢাকার মিরপুর ১৩ নম্বরে সরকারি ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ওই কলেজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিইউএমএস ডিগ্রি কোর্স চালু করেন। ১৯৯০ সালের ১০ মার্চ ওই কলেজের প্রথম ব্যাচের ক্লাস শুরু হয়।
লেখক : চিকিৎসক ও মাইক্রোবায়োলজিস্ট এক্সিকিউটিভ অফিসার, ইটিল্যাব ইন্ডাস্ট্রিজ (ইউনানি), কুমিল্লা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা