২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯ মাঘ ১৪৩১, ২২ রজব ১৪৪৬
`

হাবিবুর রহমানের পঙ্খিরাজ

হাবিবুর রহমানের পঙ্খিরাজ -


বাবা-মায়ের অভাব অনটন আর লেখাপড়া শেখায় ব্যর্থতা হাবিবুর রহমানকে ঘোড়ার সওয়ার হতে বাধ্য করে
ছয় কন্যা আর দুই ছেলের জনক মো: হাবিবুর রহমান। আশপাশে কয়েক গ্রামের লোকের কাছে ঘোড়া ফকির নামে পরিচিত। মাগুরা জেলার শালিখা থানাধীন দরিখাটর গ্রামে জন্ম হলেও গত ২০ বছর ধরে নড়াইল জেলার সিঙ্গিয়া গ্রামের জীর্ন-শীর্ণ ছোট্ট একটি ঘরে জীবন কাটাচ্ছেন। সংসারে মাত্র দুইজন। তিনি আর তার স্ত্রী। আর তার একটি প্রাণপ্রিয় শখের ঘোড়া। আমি যখন জানতে চাইলাম, এখন আপনার পরিবারে কয়জন সদস্য তখন তিনি কিছু না ভেবেই বলে দিলেন, তিনজন। কে কে জানতে চাইলে তিনি বলে দিলেন, আমি আর আমার স্ত্রী আর আমার পঙ্খিরাজ ঘোড়া।
হাবিবুর রহমানের বয়স যখন সবেমাত্র সাত। তখন থেকেই শখের বশে এক দিন দুই দিন করে গ্রামের কোনো এক চাচার ঘোড়ার পিঠে ওঠে। এ থেকে ঘোড়ার পিঠের জীবনযাপনের সূত্রপাত হয়েছিল হাবিবুর রহমান ওরফে ঘোড়া ফকিরের। তখন গ্রাম-গঞ্জে ঘোড়া দাবড়ের খুব কদর ছিল। এখানে ওখানে ঘোড়া দাবড় লেগেই থাকত।

শীতকাল এলেই চার দিকে হিড়িক পড়ে যেত ঘোড়া দাবড়ের। হাবিবুর রহমানের বয়স তখন মাত্র আট। গ্রামের লোকজন শখের বশেই আয়োজন করেছিল সেবার ঘোড়া দাবড়ের। গ্রামের ঘোড়া বলতে শুধু একটি ঘোড়া ছিল। আর সেটি ছিল হাবিবুর রহমানের ঘোড়া গুরুর ঘোড়া। গ্রামের লোকজনের অনুরোধে সেবার প্রথমবার হাবিবুর রহমান কোনো ঘোড়া দাবড়ের সওয়ার হয়েছিলেন। মেলায় বিভিন্ন এলাকার ঘোড়ার উপস্থিতি হয়েছিল। তা প্রায় ১০-১২টার মতো। সেবার আল্লাহর রহমতে সবাইকে তাক লাগিয়ে ব্যাপক ব্যবধানে হাবিবুর রহমানের ঘোড়া প্রথম হয়েছিল। তারপর গ্রামের লোকজনের বাহ! বাহ! আর উৎসাহ-উদ্দীপনায় মুগ্ধ হয়ে ঘোড়ার প্রতি হাবিবুর রহমানের আগ্রহ আরো শতগুণ বেড়ে যায়। আর সেবার থেকেই মেলায় গিয়ে ঘোড়ার সওয়ার হওয়ার সূচনা হাবিবুর রহমানের।

বাবা-মায়ের অভাব অনটন আর লেখাপড়া শেখায় ব্যর্থতা হাবিবুর রহমানকে ঘোড়ার সওয়ার হতে বাধ্য করে। দীর্ঘ ৩০ বছর শুধু অন্যের ঘোড়ার পিঠে উঠে মেলা দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন হাবিবুর রহমান। হাবিবুর রহমানের ভাষায়- ‘আমি অন্যের ঘোড়ায় চড়ে মেলায় ঘোড়া দাবড়াতাম, ফার্স্ট হলাম ও আনন্দ পেলাম। লোকজনের আনন্দ দেখে মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম জীবনে কোনো দিন কি নিজে একটি ঘোড়ার মালিক হতে পারব না?
যখন বয়স ৪০ বছর তখন বাবার কাছ থেকে পাওয়া সামান্য সম্পত্তি সবটুকু বিক্রি করে সেই আমলে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে জীবনের প্রথম ঘোড়া কিনেন হাবিবুর রহমান। ভিটেমাটি বিক্রি হওয়ার পরও কয়েক বছর সেই ভিটায় ছিলেন। পরে সেখান থেকে বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে গিয়ে বাড়ি বানান ফাঁকা মাঠের এক প্রান্তে। সেখানে কাটান কিছু বছর। এরপর ছেলেমেয়ে বিয়ে দিলেন। ছেলেগুলোকে আলাদা সংসারের জোয়াল কাঁধে দিয়ে নিজের স্ত্রী আর নিজের ভালোবাসার ঘোড়াকে নিয়ে চলে আসেন সিঙ্গিয়া গ্রামে। ২০ বছর পার করেছেন এখানেই কিন্তু আজ অবধি নিজে এক হাত জায়গার মালিক হতে পারেননি।

নিজের ভায়রার জায়গায় একটি ছোট খিঞ্জির ঘর বেঁধে টোনাটুনির মতো পার করে যাচ্ছেন জীবনতরী। সংসার চালানোর এক মাত্র হাতিয়ার হলো তার ঘোড়া। ঘোড়া ছাড়া তিনি কিছু চেনেন না। সারাটা দিন তার কাটে ঘোড়ার সাথেই। গত পাঁচ বছর আগে অনেক দূর থেকে কিনে এনেছিলেন একটি ঘোড়া। যেটি নাকি তার সাথে আছে এখনো। মাত্র ৫৫ হাজার টাকা দিয়ে কিনে এনেছিলেন এই ঘোড়াটিকে। পাঁচ বছর সেবাযতœ করে ঘোড়ার চেহারা একদম পাল্টে দিয়েছেন ঘোড়াপ্রেমিক হাবিবুর রহমান। এখন এই ঘোড়ার দাম দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত হয়েছে কিন্তু হাবিবুর রহমান এটিকে বিক্রি করতে নারাজ।

হাবিবুর রহমান বলেন, এই ঘোড়াটিকে কেনার পর অনেক দাবড়ে গেছেন। পটুয়াখালী, শিবচর, যশোর, বহরপুর, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনা, কাপাসিয়া- আরো অনেক জায়গায় গিয়েছেন প্রায় শতখানেক জায়গায় শত শত ঘোড়ার ভেতরেও প্রথম স্থান অধিকার করে ছিনিয়ে এনেছেন প্রথম প্রাইজ। প্রাইজ কথা উঠতেই হাতটা ধরে নিয়ে গেলেন তার ঘরের ভেতর। দেখালেন অনেকগুলো ছোট ছোট টেলিভিশন, রেড়িও, পিতলের কলস- আরো অনেক কিছু। আমি জানতে চাইলাম এত দূর থেকে গিয়ে আপনি প্রথম পুরস্কার নিয়ে আসতেন আপনার কোনো সমস্যা হতো না? তিনি বললেন, না। আমার সাথে কোনো জায়গা থেকে এমনটি করেনি। তবে অনেক জায়গা আছে সেখানে মেলা কর্তৃপক্ষ এমনটি করে। পুরস্কার নিয়ে ঝামেলা পাকায়। দিতে চায় না আমন্ত্রণপত্রে উল্লিখিত প্রাইজ।

তিনি বলেন, রাজবাড়ীর এক মেলা থেকে যখন আমার ঘোড়া প্রথম হয়ে বের হয়ে আসছিল তখন মাইকে বার বার একটি কথা বলছিলেন- নড়াইলের পঙ্খিরাজ প্রথম হয়েছে। সেখান থেকে আমার ঘোড়াটার নাম সব জায়গায় নড়াইলের পঙ্খিরাজে রূপ নেয়। ঘোড়া জগতে এখন আমার ঘোড়া পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় খেতাব পেয়েছে। দেশে ঘোড়া দাবড়ের অনুকূল পরিবেশ না থাকায় ঘোড়া দাবড় এখন প্রায় বিলীনের পথে। খুব কম শোনা যায় ঘোড়া দাবড়ের গল্প। ঘোড়া ফকির হাবিবুর রহমান এখন বাড়ি থেকেই দিন পার করছেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘোড়ার পিঠে চড়ে মনোখালীর মোড়ে চা খেতে আসেন। বাড়ি ফিরে ঘোড়াটার পিঠে চড়েই নদীর ঘাটে গোসল করতে যান। নিজে গোসল করেন ও পঙ্খিরাজকেও করান। পঙ্খিরাজকে গোসল করিয়ে বাড়ি থেকে সাইকেলে করে বেরিয়ে পড়েন পঙ্খিরাজের খাদ্যের সন্ধানে।
দুপুর গড়াতেই মাঠ থেকে বস্তা ভরে ঘাস কেটে নিয়ে বাড়ি ফেরেন হাবিবুর রহমান। বিকেল হলে ঘোড়ার পিঠে চড়ে আবার বেরিয়ে পড়েন মাঠে ঘোড়াকে খাওয়াতে। ঘোড়াকে ঘাসে বেঁধে দিয়ে চুপটি করে বসে থাকেন। নির্বিঘ্নে পর্যবেক্ষণ করেন পঙ্খিরাজের ঘাস খাওয়া। কখনো আবার নিজে হাত দিয়ে কয়েক মুঠো ঘাস ছিঁড়ে ডাক দিতেই পঙ্খিরাজ এসে হাতের থেকে খেয়ে যায়। হাবিবুর রহমান ঘোড়ায় চড়ে বাজারে যান। সিঙ্গিয়ার হাটে সপ্তাহে দুইবার যান সদাই করতে, সেটিও ঘোড়ায় চড়েই।

আমি জানতে চাইলাম, ঘোড়ার ওপর এই যে আপনি এত বছর পার করলেন, কখনো কি কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন? হাবিবুর রহমান বললেন, হ্যাঁ, অনেক হয়েছে। তবে মারাত্মকভাবে কোনো দুর্ঘটনার শিকার হননি। ঘোড়ারা তো অবলা জীব। এরা খুব সহজে পোষ মানে। খুব সহজে মনের কথা বুঝতে পারে এরা। ভালোবাসা দিয়ে বোঝাতে হবে সব কিছু। এই তো সেদিন বাজারে যাচ্ছিলাম হঠাৎ পেছন থেকেও গাড়ি-সামনে থেকেও গাড়ি এসে হাজির হলো। ঘোড়া এমন একটা জিনিস, এরা যান্ত্রিক সব কিছু খুব ভয় পায়। ঘোড়াটা এদিক-ওদিক করে রাস্তার খাদে পড়ে যায়। সাথে আমিও পড়ে যাই। আমার পাঁজরে একটু ব্যথা পাই আর পঙ্খিরাজের পেছনের একটি পায়ে খুব চোট খায়। এখনো ঠিক সেরে ওঠেনি।
বললাম, আপনি কি এই পঙ্খিরাজকে বিক্রি করবেন না কখনো? তিনি বললেন, আমার বয়স অনেক হয়েছে। তা প্রায় ৯৭-৯৮ আর বাঁচব কয় দিন। বাকি জীবনটা এই পঙ্খিরাজের সাথেই কাটাতে চাই। খুব ভালোবাসি ওকে। পঙ্খিরাজও খুব ভালোবাসে আমাকে। আমি একবার অসুস্থ হয়েছিলাম, মাত্র দুইদিন বিছানায় ছিলাম। খুব জ্বর হয়েছিল আমার। পঙ্খিরাজ নিজের দড়ি ছিঁড়ে এসে আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আমার কপাল চেটে চেটে আদর করছিল। ওই দু’দিন পাড়ার একটি ছেলেকে দিয়ে প্রতি বস্তা ১০ টাকা দরে ঘাস কাটিয়ে ছিলাম কিন্তু ওই দুই দিন পঙ্খিরাজ একটি দানা পানিও মুখে দেয়নি। সব সময় চোখ দিয়ে পানি ঝরাত। বড্ড ভালোবাসে আমাকে বড্ড ভালোবাসি ওকে।
নিকুঞ্জ-২, খিলক্ষেত, ঢাকা-১২২৯

 


আরো সংবাদ



premium cement